সুচি স্বতন্ত্র কেন

সম্প্রতি আউং সান সুচি’র ভারত সফরের সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল বর্মার সামরিক বাহিনী সম্পর্কে তাঁর কি বক্তব্য। সুচি বলেছিলেন, তিনি উর্দি- পরা লোকদের সামরিক শাসন ও স্বেচ্ছাচারী কর্মকা-ের বিরোধী, তবে সামরিক বাহিনীর নন।
না হওয়াটাই স্বাভাবিক। বর্মার সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা যেখানে ছিলেন স্বয়ং তার পিতা সেখানে সুচি এই বাহিনীর বিরোধী হতে পারেন না। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, সামরিক বাহিনী তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত নীতিমালায় ফিরে গিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে নয় বরং জাতির জন্য কাজ করবে।
পিতার আদর্শের প্রতি এমন আনুগত্য শুধু আউং সান সুচি’র মধ্যে নয়, আরও অনেকের ক্ষেত্রেই আছে। যেমন পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। তাঁর অনেক বক্তৃতাতেই বেনজির বলেছেন, তাঁর পিতা একটা গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখতেন এবং সেই স্বপ্ন পূরণ করতে তিনি বদ্ধপরিকর।
বেনজিরের কাছে তাঁর পিতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন পরম পূজনীয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাবার হাত ধরেই তাঁর রাজনীতিতে আগমন। ১৯৭৭ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানে ভুট্টো ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৯৭৯ সালে তাঁর ফাঁসি হয়। এর দশ বছর পর বেনজির ক্ষমতায় আসেন এবং নিহত পিতার স্বপ্নপূরণে ব্রতী হন। পাকিস্তানের দূতাবাসগুলো ভুট্টোর প্রশাস্তিমূলক অসংখ্য প্রচারপত্র ও পুস্তিকায় ভরে যায়। সেগুলোতে তাঁকে জিন্নাহর পর শ্রেষ্ঠ পাকিস্তানী আখ্যায়িত করা হয়। এ ছিল পিতার প্রতি কন্যার ভালবাসার স্বাক্ষর।
কিন্তু বেনজির তাঁর কোন ভাষণেই পিতার কিছু কলঙ্কিত ভূমিকার ধার কাছ দিয়েও যাননি। তার একটি হচ্ছে ১৯৭১ সালে আজকের বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই অধ্যায়ে ভুট্টো ও জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক হয়ে গিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে যেমন বেনজিরের আগমন হয়েছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমনি আবির্ভাব ঘটে শেখ হাসিনার। বেনজিরের মতো তিনিও ছাত্র রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে কতিপয় সেনা অফিসারের হাতে তাঁর পিতা, মাতা ও ভাই নিহত হন। শেখ হাসিনা সে সময় জার্মানিতে ছিলেন। নইলে তাঁকেও হত্যা করা হতো। দেশে ফিরলে ঘাতকদের হাতে মারা পড়তে হবে ভেবে শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন কাটান। ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফেরেন এবং পিতার গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। সামরিক বাহিনী কিংবা সেনাসমর্থিত রাজনীতিকরা ক্ষমতায় থাকাকালে দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি সরকারবিরোধী ভূমিকা পালন করেন। পরিশেষে ১৯৯৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পাঁচ বছরের একটি মেয়াদ শেষে ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার দলের কাছে পরাজিত হন। খালেদা জিয়া একজন নিহত রাষ্ট্রপতির পতœী। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে আসেন এবং পিতার আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন।
শেখ হাসিনা ও বেনজির উভয়েই দুই প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর কন্যা যারা পরবর্তীকালে ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। তাদের আগে একই ভূমিকায় দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এবং তার আগে শ্রীলংকার শ্রীমাভো বন্দরনায়েককে। ১৯৫৯ সালে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী এস ডব্লিউ আর ডি বন্দরনায়েক নিহত হন। এর বেশ কয়েক মাস পর উপদলীয় কোন্দলে সরকারের পতন ঘটে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন শ্রীমাভোকে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির উপদলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নিয়ে আসা হয়। ১৯৬০ সালে সাধারণ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে দলটি বিপুল বিজয় লাভ করে। শ্রীমাভো প্রধানমন্ত্রী হন এবং তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকেন।
শ্রীমাভোর মতো আরেক নেতৃত্বের আগমন ঘটে ভারতে প্রায় তিন দশক পর। তিনি সোনিয়া গান্ধী। স্বামী রাজীব গান্ধী নিহত না হলে তাঁর রাজনীতিতে আসার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। রাজনীতিতে তাঁকে টেনে আনতে ৭ বছর সময় লেগেছিল। কংগ্রেস দলের কা-ারি হয়ে আসেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী পদ ইচ্ছা করেই গ্রহণ করেননি।
এখানেই হলো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এখানে জনজীবনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারীদের আগমন ঘটেছে সন্ত্রাসবাদী কিংবা সেনা অফিসারদের হাতে তাদের স্বামী অথবা পিতা নিহত হবার পর। এদিক থেকে আউং সান সুচির ব্যাপারটা আলাদা। তাঁর পিতা সেনা অফিসারদের হাতে নিহত হয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে। কিন্তু সুচি রাজনীতিতে আসেন পুরো চল্লিশ বছর পর এবং তাও আবার ঘটনাচক্রে। প্রবাস জীবন থেকে তিনি বর্মায় এসেছিলেন তাঁর অসুস্থ মাকে দেখতে। কাকতালীয়ভাবে সেসময় দেশে সামরিক শাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থান চলছিল। সুচি এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর ছেলেরা দেশের বাইরেই থাকেন। সুচি যদি কোন সময় প্রধানমন্ত্রীও হন তারপরও তাদের কোন একজনের বর্মায় ফিরে রাহুল অথবা বিলাওয়ালের মতো ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক নারীদের সঙ্গে আরেক দিক দিয়েও সুচির পার্থক্য আছে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে কারাগারে অথবা গৃহবন্দী অবস্থায়। তাঁকে এই জীবন শুরু করতে হয়েছে শীর্ষদেশ থেকে নয় বরং তৃণমূল থেকে। অন্যদিকে শ্রীমাভো, বেনজির, হাসিনা, খালেদা ও সোনিয়া সবাই উত্তরাধিকার সূত্রে এমন পার্টি সংগঠন লাভ করেছিলেন যা ছিল সুবিকশিত এবং আর্থিক সম্পদে বলীয়ান যার ফলে রাজনীতিতে প্রবেশের কয়েক মাস বা কয়েক বছরের মধ্যে তাদের ক্ষমতায় উত্তরণ ঘটেছিল। ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে সুচি তাঁর প্রথম রাজনৈতিক ভাষণ দেন। এর ২৪ বছর পর তিনি কেবলমাত্র পার্লামেন্টের সদস্য হতে পেরেছেন- তাঁর বেশি কিছু নয়। সরকার এখনও সামরিক বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে।
ক্ষমতার উত্তরসূরি অন্য নারীদের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায়, সুচির রাজনৈতিক পথ অনেক বেশি বন্ধুর। তাঁর রাজনৈতিক দুর্ভোগ তাঁকে শারীরিক ও নৈতিক শক্তি যুগিয়েছে। তেমনি শক্তি যুগিয়েছে সামরিক জান্তার প্রতি তাঁর সুদীর্ঘ সময়ের বিরোধিতা। অন্যদের মতো কোন স্বত্ব বা অধিকারবোধ নিয়ে তিনি রাজনীতিতে আসেননি। কখনও যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে অংসানের কন্যা হবার সুবাদে নয় বরং নিজের কারণেই তিনি বর্মায় গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতীক ও কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন।

চলমান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.