জার্সি নম্বর ১০

পেলে, ম্যারোডোনা, মেসি।
নাম তিনটি পড়ে কী মনে হচ্ছে? না, তিন সময়ের তিন গ্রেটের কোনো তুলনা নয়। সেটা নিয়ে প্রচুর কাগজ এমনিতেই খরচ হচ্ছে।
এখানে একই বাক্যে তিনজনকে আনার একটাই কারণ, তিনজনেরই গায়ে উঠেছে ১০ নম্বর জার্সি!
আচ্ছা, বাংলাদেশে কারা ১০ নম্বর জার্সি পরতেন? বা এখন পরেন? কে বেশি বিখ্যাত ছিলেন ১০ নম্বর জার্সিতে? কুইজের প্রশ্ন হতেই পারে। কারণ, ১০ নম্বর জার্সি মানে বিশেষ কিছু। সবচেয়ে বেশি আগ্রহ থাকে এটিকে ঘিরে। বাংলাদেশে এখন হয়তো ১০ নম্বরের আলাদা কোনো আবেদন নেই, কিন্তু একটা সময় ঠিকই লোকে ১০ নম্বরকেই আগে খুঁজে নিত।
স্বাধীনতার আগ থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অনেকেই ১০ নম্বর পরেছেন। দর্শক মাতিয়ে গেছেন আবেগের স্রোতে। সেই তালিকায় জনপ্রিয়তম নাম অবশ্যই কাজী সালাউদ্দিন। এই জায়গায় কারোরই দ্বিমত নেই। সালাউদ্দিন ছিলেন প্রতিপক্ষের জন্য আতঙ্ক। তিনিই দেশের একমাত্র ফুটবলার, অবসরের পর আবাহনী যাঁকে দিয়েছে বিরল সম্মান। শুধু সালাউদ্দিনকে সম্মান দেখাতেই পরবর্তী ১০ বছর ১০ নম্বর জার্সিটা আর কাউকে দেয়নি আবাহনী।
১৯৮৪ সালে বুট জোড়া খুলে রাখেন সালাউদ্দিন। ১৯৭২ সালে আবাহনী দিয়ে শুরু, আবাহনীতেই শেষ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরতেন ১০ নম্বরই। জাতীয় দলে শুধু এক বছর ১০ নম্বর পাননি। ’৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়া কাপের বাছাইয়ে সালাউদ্দিনের কাছ থেকে নিয়ে ১০ নম্বর দেওয়া হয় মোহাম্মদ মহসিনকে। মহসিন জাতীয় দলের অধিনায়কত্বও পান সে বছর। তাঁর নেতৃত্বে এশিয়ান বাছাইয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ চ্যাম্পিয়নও হয়। ঘরোয়া ফুটবলে ’৭৩ থেকে ’৮৫ পর্যন্ত ব্রাদার্সের ১০ নম্বরটা বরাদ্দ ছিল মহসিনের নামেই। এটা তাঁকে আপ্লুত করছে আজও, ‘১০ নম্বর জার্সি পরতে সবকিছু আগে দরকার একজন ভালো খেলোয়াড় হওয়া।’
পরের বছরই আবার সালাউদ্দিন ফিরে পান ১০ নম্বর এবং তখনই নাকি ১০ নম্বরের মাহাত্ম্যটা ভালো করে বুঝেছিলেন, ‘যে বছর জাতীয় দলে ১০ নম্বর আমাকে দেওয়া হয়নি, সেই বছর বুঝেছি এর মর্যাদা। আর বুঝেছি আবাহনী যখন আমার সম্মানে আট-দশ বছর ১০ নম্বর জার্সিটা তুলে রাখল। তবে আমি কখনো ১০ নম্বর চেয়ে নিইনি। ক্লাবই আমাকে দিয়েছে।’
শুধু বাংলাদেশেই নয়, হংকংয়ের ক্যারোলিন হিলেও পেশাদার ফুটবলে গিয়ে সালাউদ্দিনের গায়ে ছিল ১০ নম্বর। নিজে না চেয়েই পেয়েছেন। সেই গল্পও উঠে এল তাঁর কণ্ঠে, ‘বিমানবন্দর থেকেই ওরা আমাকে প্রেস কনফারেন্সে নিয়ে গেল। সেখানেই দিল ১০ নম্বর। আমি জানতামই না ব্যাপারটা।’
ওই ১০ নম্বর জার্সিগুলো কি রেখে দিয়েছেন? কোনো স্যুভেনিয়র কি আছে? সালাউদ্দিন ফিরে যান অতীতে, ‘একটিও রাখিনি। ১৯৮২ সালে জেলে যাওয়ার ক্ষোভে কিছু জার্সি পুড়িয়ে ফেলেছি। কিছু অন্যদের দিয়ে দিয়েছি।’
১০ নম্বর পরে আলোড়ন তুলেছিলেন এনায়েতুর রহমানও (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী)। তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ এক ফুটবলার। বিজেএমসি হয়ে মোহামেডানে এসেছেন, দুদলেই খেলেছেন ১০ নম্বর নিয়ে। বাংলাদেশের সেরা দুই ফুটবলারই ১০ নম্বর পরতেন, ১০ নম্বর তাঁদের গায়েই সৌরভ ছড়িয়ে গেছে সবচেয়ে বেশি। মেজর হাফিজ ’৭৩ সালে মোহামেডানের হয়ে ফের খেলা শুরু করে ১০ নম্বর পরতেন। তারপর ’৭৮ সালে এনায়েত মোহামেডানে এলেন। ’৭৯ সালে এনায়েত মোহামেডানে শুরুই করলেন ১০ নম্বর জার্সি নিয়ে।
উঠে আসছে স্বাধীনতার আগের কথাও। সাবেক ফুটবলার ও কোচ গোলাম সারোয়ার টিপু জানাচ্ছেন, পঞ্চাশের শেষ দিকে কবির-আশরাফ-মারী ত্রয়ী মোহামেডানের হয়ে মাঠে ত্রাস ছড়াতেন। কবির আহমেদ তখন ডান প্রান্তে খেলতেন আট নম্বর নিয়ে। আশরাফ (৯) ছিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ড। লেফট ইনসাইড ফরোয়ার্ড মারী দা খেলতেন ১০ নম্বর নিয়ে।
টিপুর দেওয়া তথ্য, স্বাধীনতার আগে জার্সি নম্বর খেলোয়াড়দের জন্য নয়, পজিশনের জন্য বরাদ্দ থাকত। যেমন ১৯৬৯ সালে মোহামেডানে গোলরক্ষক সাহিদুর রহমান শান্টু খেলতেন এক নম্বর জার্সি নিয়ে। একই দলে গোলরক্ষক হিসেবে নূরন্নবীও (মেজর জেনারেল) পরতেন এক নম্বর জার্সি। মোহামেডানে রাইট ব্যাকে জহিরুল হক দুই নম্বর জার্সি নিয়ে খেললে তাঁর জায়গায় অন্য কেউ খেলতে এলে তিনিও ওই দুই নম্বর জার্সিই পরতেন। সব দলেই একই চিত্র ছিল।
আশির দশকের মোহামেডানে ১০ নম্বর পরেছিলেন বাদল রায়। আজও তিনি আপ্লুত, ’৭৭ সালে ক্যারিয়ারের শুরুতে পেয়েছিলাম ৭ নম্বর জার্সি। এনায়েত ভাইয়ের অবসরের পর ’৮১ সালে মোহামেডান একদিন হঠাৎ আমাকে ১০ নম্বর দিয়েছে। আমি চাইনি। মোহামেডানে ওই জার্সি পরে মাঠ কাঁপিয়েছেন মেজর হাফিজ ভাই, এনায়েত ভাইয়েরা। ওনাদের রেখে যাওয়া ১০ নম্বরের উত্তরাধিকার হওয়া ছিল বিশাল ব্যাপার।’
মোহামেডানে এরপর বছর চারেক ১০ নম্বর পরেছেন সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বির। ওই সময় জাতীয় দলেও ১০ নম্বর পেতেন এই স্ট্রাইকার। তাঁর স্মৃতিতে আজও তা জ্বলজ্বলে, ‘সম্ভবত চার বছর ১০ নম্বর পরেছিলাম মোহামেডানে। অসাধারণ অনুভূতি ছিল।’ মোহামেডানে সাব্বিরের কাছ থেকে ১০ নম্বর পেয়েছেন আলফাজ, যিনি এখন শুনছেন শেষের বাঁশি। বলছেন, ‘১০ নম্বরের প্রতি বিশেষ একটা আকর্ষণ ছিলই। সাব্বির ভাইয়ের পর এটা আমি পাই।’ ক্যারিয়ারের বেশিরভাগই ১০ নম্বর জার্সিতে কেটেছে ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবের। মুক্তিযোদ্ধায় ৫ বছর, মোহামেডানে ৭ বছর।
সালাউদ্দিনের পর আবাহনী ১০ নম্বর অবমুক্ত করল ১৯৯৪ সালে। পেয়েছিলেন ইরাকি স্ট্রাইকার নজর আলী। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে আরও দুজন পেয়েছেন। বর্তমান এমিলি আবাহনীতে থাকতে ১০ নম্বর, আলফাজ পরেছেন আকাশি-নীলের ১০ নম্বর। তবে লম্বা সময় নয়। গত বছর আবাহনীর ১০ পরেছেন রবীন। চোট আঘাতে মাঠেই ঠিকমতো নামতে পারেননি। ১০ নম্বরের উজ্জ্বলতাও তাই ছড়ায়নি।
আবাহনীতে শেখ মোহাম্মদ আসলাম পরতেন নয়। কখনো কি ১০ নম্বর পরার ইচ্ছে হয়নি? ‘পেলের প্রতি সম্মান রেখে আমি কখনো ১০ নম্বর পেতে চাইনি। কারণ, ১০ নম্বর পরে খারাপ খেললে পেলের অসম্মান হবে মনে করতাম আমি’—বলছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার।
নয় নম্বর জার্সি পরার একটা রহস্য উন্মোচন করলেন আসলাম, ‘ইয়োহান ক্রুইফ বার্সেলোনার হয়ে নয় নম্বর জার্সি পরতেন। ’৭৪ সালের বিশ্বকাপ কাঁপানো ক্রুইফই আমাকে নয় নম্বর নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।’ নয় নম্বর পরতেন বাংলাদেশের আরেক নামী স্ট্রাইকার সালাম মুর্শেদী। ১৯৮২ সালে লিগে মোহামেডানের হয়ে তাঁর করা ২৭ গোল এখনো লিগ রেকর্ড। কিন্তু তিনি কখনো ১০ নম্বর চেয়েছেন? ‘আমি নয় নম্বর নিয়েই তৃপ্ত ছিলাম। কাজেই ১০ নম্বর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কখনোই আমার হয়নি’—এই হলো ১০ নম্বর জার্সি নিয়ে সালামের স্মৃতিচারণা।
ফেরা যাক এখনকার সময়ে। এখন কারা ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলছেন, তা নিয়মিত খেলা দেখা দর্শকেরাও ঠিকভাবে মনে করতে পারবেন না। ঁজাহিদ হাসান এমিলি ১০ নম্বর নিয়ে নিয়মিতই খেলছেন। যখন যে ক্লাবে যান, ১০ নম্বরটা তিনিই পান। এবার আছেন শেখ রাসেলে। এর বাইরে আর কোনো নাম সেভাবে নেই।
বাংলাদেশ লিগে বর্তমান নয় দলের পাঁচ দলেই ১০ নম্বর পরেন বিদেশিরা। আবাহনীতে নাইজেরিয়ার লাকি পল, তাঁরই স্বদেশি সানডের গায়ে শেখ জামালের ১০ নম্বর, বিজেএমসিতে গিনির ইসমাইল বাঙ্গুরা, ব্রাদার্সের বেনিনের ওয়াসিও ওলালেকান, আরামবাগে উগান্ডান ইদ্রিস কাসুরি। এঁরা দল পাল্টালে হয়তো আগামী বছর অন্য কোনো জার্সি নিয়ে খেলবেন।
এভাবেই চলছে এখনকার ঘরোয়া ফুটবল। আগে খেলোয়াড়েরা যেমন লম্বা সময় এক দলে খেলতেন, এখন আর ক্লাব-প্রেম অবশিষ্ট নেই। কোথাও থিতু হয়ে সেই ক্লাবের প্রতীক হওয়ার মানসিকতা এখন নেই বললেই চলে। তাই ১০ নম্বর আজ আর আলোকিত নয়। বিবর্ণ। আড়ালে ঢাকা সূর্যের মতো।

No comments

Powered by Blogger.