যুদ্ধাপরাধী বিচারে দক্ষ আপীল বিভাগ প্রয়োজন by মমতাজ লতিফ

আমি যখন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল-১-এর মাননীয় প্রধান বিচারপতির কোন এক প্রবাসী বাঙালী জিয়াউদ্দীনের কথোপকথনের তথ্য ফাঁসের খবর সংবাদপত্রে পড়ে জানলাম, পরে টিভি চ্যানেলের সূত্র থেকেও জানলাম তখনই মনে পড়ে গেল এক প্রবাসী জিয়াউদ্দীনকে! মনে পড়ল,
প্রবাসী ও বাঙালী জিয়াউদ্দীন নামক এক ব্যক্তিকে ২০০৯-এ ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় উপস্থিত হতে দেখেছিলাম এবং তার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্য বিনিময় হয়। বলতে দ্বিধা নেই, সেদিন আমাদের উপস্থিত সকলেরই তাকে মনে হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির প্রতি বিরূপ একজন ব্যক্তি। আমরা সে সময় এ ব্যক্তি সম্পর্কে এ সিদ্ধান্তে এসেছিলাম যে, ইনি জামায়াতপন্থী এবং আমাদের ভেতরে নানা কৌশলে ঢুকে পড়বেন আর যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের কিছু এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ এক কথায়, সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হবেন। আমাদের এও প্রশ্ন ছিল এ ব্যক্তি কি নিজের খরচে ইউরোপের কোন দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে এই যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে? নাকি তাকে যুদ্ধাপরাধী পক্ষই তাদের স্বার্থে কাজ করতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে? সম্ভবত ভদ্রলোক আমাদের সবার পারিবারিক কিছু কিছু তথ্য জেনেই ঐ আলোচনা সভায় এসেছিলেন। সেদিন উনি ঘুরে ঘুরে অনেকের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বা বসে এক একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন যা আমরা বিশেষ গুরুত্ববহ মনে করিনি। তবে, হঠাৎ উনি যখন আমার পাশে একটা চেয়ার টেনে এনে বসলেন এবং আমাকেই প্রশ্ন করলেন ‘আচ্ছা, আপনি কেন যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি করছেন? আপনার কাছের কোন আত্মীয় তো নিহত হয়নি?’ প্রশ্নটি আমাকে যেন চাবুকের প্রহারসম আঘাত করল। তৎক্ষণাৎ আমি বুঝলাম জাতিকে, শিক্ষিত-নিরক্ষর নির্বিশেষে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিরত ব্যক্তি, দলকে বিভ্রান্ত করতে, লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে, এ লক্ষ্যে জাতির ঐক্যকে বিভক্ত করতে এরা কাজে নেমেছে। আমি ধনুকের ছিলার মতো মুহূর্তে ঘুরে বসে তাকে উত্তরে বলেছিলাম ‘আমার শিক্ষক, আমার প্রতিবেশী, আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইরা যারা প্রাণ দিয়েছে, নিহত হয়েছে, তারা আমার স্বজন না হলে কারা আমার স্বজন? ত্রিশ লাখ শহীদ যারা এ জাতিকে আমাকে স্বাধীন মাতৃভূমি এনে দিয়েছে তারা আমার ও সব বাঙালীর প্রাণের আত্মীয়, রক্তের সম্পর্কে স্বজন।’ আমার তীব্র বাক্যবাণে উনি বিস্মিত হয়েছেন বলে মনে হয়নি। তবে, এরপর উনি এভাবে আরও উপস্থিত অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজটি ঐভাবে শুরু হয়েছিল।
যা হোক, ঐদিন স্বপ্নেও ভাবিনি এ ধরনের শত্রুপক্ষের হয়ে ঐ একই ব্যক্তিই আজকের ২০১২ সালে ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারপতিকে কথোপকথনে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। হায়, আমার মতো সাধারণজন সাধারণ বুদ্ধিতে যাদের এড়িয়ে চলি, অথবা উচিত কথা শুনিয়ে দিতে সক্ষম, একজন আইনজীবী কি তার তুলনায় আরও অনেক বেশি সতর্ক, সচেতন, সাবধান হবার কথা নয়? আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের পশ্চিমে অবস্থিত লাল রঙের জেলা জজের বাড়িটি। বাবার কাছে শুনেছিলাম, জজেরা কারো বাড়িতে বেড়াতে যান না; আত্মীয়-স্বজনের বিয়েতেও যান না, অনেক লোকের মধ্যে তাঁরা যান না, তাঁদের দেশ-বিদেশের বড় বড় মামলার রায় পড়তে হয়, আইনের আধুনিক ব্যাখ্যা জানতে হয়, সে জন্য তাঁরা খুব ব্যস্ত থাকেন। শুনে খুব দুঃখ বোধ করেছিলাম যে, এত বন্দী জীবন ওঁদের যাপন করতে হয়! শাহরিয়ার কবিরকে কি ভেবে জিজ্ঞেস করলাম যে এই জিয়াউদ্দীন ব্যক্তিটি কে? শাহরিয়ার বলল, ‘এ তো সেই ২০০৯-এ ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আলোচনা সভায় এসেছিল, সেই জিয়াউদ্দীন।’ আমি এ উত্তরটি একদম আশা করিনি। তাছাড়া ২০০৯ পার হয়ে বর্তমান ২০১২ তে যখন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বয়স প্রায় দুই বছর, জামায়াতের নেতৃত্ব পর্যায়ের বড় বড় ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ভালভাবেই বিচারকাজ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ঐ জিয়াউদ্দীনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু ছবির মতো মনে পড়ল। লোকটিকে তখনই তো আমরা জামায়াতের পক্ষের লোক হিসেবে গণ্য করেছিলাম। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, তিন বছর পরে ঐ ব্যক্তি ঠিকই তার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে গেছে এবং একটি অনৈতিক অপঘটনা সংঘটিত করেছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী বাঙালীরা ‘ভোলা মন’ নিয়ে ভুলের ফাঁদে পা দিয়েছি। আশা করি, সাইবার ক্রাইম-এর আইনে দোষীদের বিচার হবে। তবে, ’৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্টটিতে যে নতুন ধারা সংযোজন করে এইসব জঘন্য গণহত্যাকারীকে আপিলের সুযোগ দেয়া হলো, পৃথিবীতে তার কোন দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। সম্ভবত ২০০৯-১০-এ এই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য প্রণীত এ্যাক্টটি সম্পর্কে বিদেশী নানামহল থেকে এটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার পরামর্শ আসছিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, আন্তর্জাতিক মানের আইনজীবীদের ফোরাম ও ব্যক্তি, বিদেশী সরকার বার বার এ আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানের নয় বলে দাবি করে এটির উন্নয়নের জন্য তাগাদা দিতে থাকার কারণে বর্তমান সরকার এ্যাক্টটিতে আপিলের সুযোগ দিতে নতুন একটি ধারা যুক্ত করে। আপিলের এ বিরল সুযোগ আজ পর্যন্ত গঠিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কোন ট্রাইব্যুনালে ছিল না। ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে নাজি দলের প্রধান নেতৃবৃন্দের বিচার হয়, সঙ্গে সঙ্গে রায় কার্যকর হয়, কেননা বিচার হচ্ছে অপরাধ ও অপরাধীর বিপক্ষে ভিক্টটিম বা নিহত আহত, ক্ষতিগ্রস্তের সপক্ষে মানবসভ্যতার একটি প্রধান ভিত্তি। অপরাধ ও অপরাধীর শাস্তি না হলে মানবসভ্যতা টিকে থাকতে পারে না, সভ্যতা ছিনতাই হয়ে যায় হালাকু খানদের মতো, বাচ্চায়ে সাক্কো, হিটলার, ফ্রাঙ্কোর মতো নরদানবদের হাতে এবং এর ফলে আইন, বিচার, রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলাদেশের জনগণ ’৭১-এ পাকিস্তানী ও তাদের দাসÑ বর্তমানে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের খুন, গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের তা-ব, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর খুনী রক্ষার ইনডেমনিটি আইন দেখেছে এবং সর্বশেষ ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দেখেছে খালেদা-নিজামী ও তারেক রহমানের আইন ভাঙ্গা, আইনকে নিজ ইচ্ছার দাসে পরিণত করে ’৭১-এর মতোই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তি হত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দেবার লক্ষ্যে জামায়াতের সাহায্যে মৌলবাদী, খুনী, জঙ্গী দলের জন্মদান ও তাদেরকে প্রগতিশীল রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় নিয়োগ করার এক দানবীয় অপশাসন দেখেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতি যখন ৪১ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু ও চলতে দেখছে, তখন অতীতে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মিত্রদের আইন ভাঙ্গা অপশাসনের কথা স্মরণ করে এই খুনী, ধর্ষক ও গণহত্যাকারীদের উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ রাখার কারণে খুবই শঙ্কিত বোধ করছে। কারণ,
০ প্রথমত, আপিল বিভাগে উচ্চমানের যুক্তিতর্ক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী বিচারকের প্রয়োজন হবে।
০ দ্বিতীয়ত, আপিল বিভাগের সব যুক্তিতর্ক ইংরেজীতে উপস্থাপন করতে হবে, সুতরাং ইংরেজীতে কথা ও যুক্তি তুলে ধরতে সক্ষম বিচারপতি দরকার হবে।
০ তৃতীয়ত, আপিল বিভাগে বিদেশী পর্যবেক্ষক উপস্থিত থাকবে যাদের ইংরেজীতে উপস্থাপিত মানসম্পন্ন যুক্তিতর্ক দিয়ে সন্তুষ্ট করতে হবে এবং ট্রাইব্যুনালে নিরপেক্ষ উচ্চমান প্রমাণ করতে হবে।
অনেকেই মনে করেন, ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচার সাক্ষ্য-প্রমাণ মানসম্মত হচ্ছেÑ এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আপিল বিভাগে উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা করে উচ্চ মানসম্পন্ন বিচারকদের পরামর্শক বা উপদেষ্টা হিসেবে রাখার কোন বিকল্প নেই। তাদের জন্য শর্ত একটাইÑ তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী কিনা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমর্থক কিনা। তাঁরা দলীয় ব্যক্তি কিনাÑ তা দেখার প্রয়োজন নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসীরাই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.