তুরস্কের নাগরিকদের ঝটিকা সফর নিয়ে নানান প্রশ্ন

পর্যবেক্ষক হিসেবে তুরস্কের ১৪ সদস্যের আইনজীবী প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় অবস্থানকালে যুদ্ধাপরাধীদের কয়েক আইনজীবীসহ কয়েক জামায়াত নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
পরে অবশ্য তাঁরা আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার সঙ্গেও দেখা করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শেষ পর্যায়ে কোন উদ্দেশ্যে তাঁরা ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসেছেন এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, এটি কোন বিদেশী প্রতিনিধি দলের স্বাভাবিক সফর। বিশ্বের যে কোন নাগরিক বৈধভাবে বাংলাদেশ সফর করতে পারেন। এ ছাড়া তাঁরা যদি ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করে থাকেন তাতেও সমস্যা নেই। সরকার কোন গোপন ট্রাইব্যুনালে বিচার করছে না। যে কেউ এই ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এদিকে পরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, তুরস্কের এই প্রতিনিধি দলের ট্রাইব্যুনালে ঢোকা ঠিক হয়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, টার্কিস এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে করে বিগত ২০ ডিসেম্বর ১৪ জনের এই আইনজীবী শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বিমানবন্দরে নেমে তাঁরা ‘পোর্ট এন্ট্রি’ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ‘স্যুট-কোট’ পরিহিত তিন ব্যক্তি তাঁদের বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে গুলশানে ‘ইন’ হোটেলে নিয়ে যান। হোটেলটিতে আগে থেকে তাঁদের জন্য রুম বরাদ্দ রাখা হয়। এই হোটেলটিতে তাঁরা টানা চার দিন কাটান। সেখানে থেকে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করেছেন। পর দিন ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর অন্য একটি হাসপাতালে অজ্ঞাত পরিচয়ের বেশকিছু লোকের সঙ্গে তাঁদের বৈঠক হয়।সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, গুলশানের ইন হোটেলে অবস্থানকালে এই আইনজীবীরা ঢাকার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় রবিবার বনানীর হোটেল সেরেনায় ট্রাইব্যুনালের জামায়াতের আইনজীবী তাজুল ইসলামসহ কয়েক জামায়াত নেতার সঙ্গে অপর একটি বৈঠকে মিলিত হন। টানা প্রায় তিন ঘণ্টা চলে এই বৈঠক। এই হোটেলে থেকে তাঁরা জামায়াতসমর্থিত কয়েক নেতার সঙ্গেও বৈঠক করেন।
সোমবার তাঁরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসেন। সে সময় তাঁরা নিজেদের পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। ১৪ জনের মধ্যে একজন রয়েছেন বেলজিয়ামের। রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা সরাসরি ট্রাইব্যুনালে এসে পাস চেয়েছেন। যেহেতু এটি পাবলিক ট্রায়াল সে কারণেই তাঁদের শর্তসাপেক্ষে পাস দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে কঠোর নিরাপত্তা থাকলেও কিভাবে প্রধান গেট দিয়ে তাঁরা প্রবেশ করেছেন এ বিষয়ে খোদ ট্রাইব্যুনাল অঙ্গনেই প্রশ্ন উঠেছে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর অংশ হিসেবেই তুরস্কের মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা সোমবার ট্রাইব্যুনালে আসেন। সোমবার দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত তাঁদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ পরিদর্শনের অনুমতি দেয়া হয়। ১৪ প্রতিনিধি দলে ছিলেন, ফাতেমা বেনলি, বৈরাম সাকারতেপ, ইব্রাহিক ওস্তাক, নেকাটি সেলেন, ইউনুস ওমর ক্যানবি, হসনো টোনা, সাউথ পামকুচ, লুটফো ইসেন জন, আহমেদ সুরগুন, মোস্তফা ইয়াগমার, ইয়াসিন সামউ, মেহমেদ রেফিক করকুজ, জেহারা ইয়াম্যান ও বেলজিয়ামের রবিয়া ইওয়াড।
ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে তাঁরা সুপ্রীমকোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জয়নাল আবেদীন, ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর সঙ্গে দেখা করেন। পরে তাঁরা আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে দেখা করেন।
সাক্ষাতকালে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী শফিক আহমেদ তাঁদের উদ্দেশে বলেন, বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন করা। এ জন্য বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বিচারের পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। বিচার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে হচ্ছে। বিচার ও আইনের স্বচ্ছতা আনতে আইন সংশোধন করে ট্রাইব্যুনালকে সম্পূর্ণ বেসামরিক রূপ দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিধান করেছে। ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবে বিচারকাজও পরিচালনা করছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে এদেশে যারা গণহত্যা, লুণ্ঠন, বুদ্ধিজীবী হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ নানা মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে সেসব অভিযুক্তর বিচার ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুযায়ী চলছে। অপরাধে অভিযুক্তদের আইনজীবীরা অনেক সময় নিয়ে সাক্ষীকে জেরা করার সুযোগ পাচ্ছেন। অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থন, পছন্দমাফিক আইনজীবী নিয়োগ ও রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের সুযোগ পাচ্ছেন। নুরেমবার্গসহ বিশ্বের এ ধরনের অন্যান্য ট্রাইব্যুনালের জন্য প্রণীত নীতি ও বিধানের চেয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন যে অনেক উন্নতমানের এ কথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বহু খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্বীকার করেছেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, সব মান বজায় রেখেই এ বিচার চলছে। বিচারের মান ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই। দেশীয় আইনে, দেশীয় ট্রাইব্যুনালে, দেশের অভিজ্ঞ বিচারক ও আইনজীবীদের নিয়ে এ বিচার পরিচালিত হচ্ছে। বিচার প্রকাশ্যে হচ্ছে। সাক্ষীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে। বিচারের কোন পর্যায়ে বৈষম্য দেখানো হচ্ছে না।
আইনমন্ত্রী মঙ্গলবার বিবিসিকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রতিরোধে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে, অনেক টাকা খরচ করা হচ্ছে। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেউ বিদেশ থেকে এসে এই বিচার নিয়ে মন্তব্য করলে তা হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, তুরস্কের এই প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে সফর নিয়ে দেশটির দূতাবাসের কাছে প্রশ্ন চাওয়া হতে পারে।
তুরস্কের প্রতিনিধি দলের এই সফর এবং ভিসাপ্রাপ্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর জনকণ্ঠকে বলেন, ট্যুরিস্ট ভিসায় যে কেউ বাংলাদেশে আসতে পারে। বিমানবন্দরে তাঁদের অন এরাইভাল পোর্ট এট্্ির ভিসারও সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগে কেউ যদি অন্য কোন অশুভ উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করে, তাহলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে সরকারের এক উপদেষ্টা জনকণ্ঠকে বলেন, এ নিয়ে সরকারের চিন্তিত হওয়ার কোন কারণই নেই। ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এতে বিদেশী কেউ এলে ট্রাইব্যুনালের কাজে কোন প্রকার প্রভাব পড়বে না। উপরন্তু এর স্বচ্ছতাই বিশ্ববাসীর কাছে প্রতীয়মান হবে। আমাদের দেখতে হবে অবৈধভাবে কেউ আসছে কি না। নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে কেউ এলে আমাদের ঠেকানোর কোন কারণ নেই।

No comments

Powered by Blogger.