মারের অপেক্ষা ঘোচার বছর

ধপ করে বসে পড়লেন বেসলাইনে। র‌্যাকেটটা পড়ে রইল মাঝামাঝি, তিনি এক কোণে। উবু হয়ে বসে আছেন দুই হাতে মুখ ঢেকে।
কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না অ্যান্ডি মারে। বিশ্বাস করাটাই কঠিন। পৌনে এক শতাব্দীর অপেক্ষা! ৭৬ বছর পর যে কোনো ব্রিটিশের হাতে উঠল কোনো গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা। ইউএস ওপেন জিতলেন মারে।
২০১২ সালের টেনিস ব্রিটিশদের অপেক্ষার মরুভূমিতে অবশেষে প্রাপ্তির বর্ষণ ঝরিয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে স্কটিশ মারের এই অর্জন। সেদিন চকচকে ট্রফিটা হাতে নিয়েই বলেছেন, ‘এতবার এত কাছে থেকেও ফিরে এসেছি যে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল, সত্যিই আমি পেরেছি।’ আসলেই। ব্রিটিশদের প্রত্যাশার চাপ জোয়াল হয়ে কাঁধে চেপে বসেছিল। মারে নিজেও বারবার গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপার কাছাকাছি এসেও ফিরে যাচ্ছিলেন খালি হাতে। এই ইউএস ওপেনেই প্রথম ফাইনালে উঠেছিলেন, ২০০৮ সালে। ২০১০ ও ২০১১-এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালেও হেরেছেন। এবারের ইউএস ওপেনের ঠিক আগে উইম্বলডনেও ফাইনালে উঠে হেরেছেন রজার ফেদেরারের কাছে। অবশেষে নোভাক জোকোভিচকে ৭-৬ (১২/১০), ৭-৫, ২-৬, ৩-৬, ৬-২ গেমে হারিয়ে মারের অমন কোর্টে উবু হয়ে বসা। বসলেন ঠিকই, কিন্তু আসলে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করলেন নিজেকে।
২০১১ সালটি ছিল পুরোপুরি নোভাক জোকোভিচের। সে বছর তিনটা গ্র্যান্ড স্লাম উঠেছিল এই সার্বিয়ানের হাতে। এ বছরটাও শুরু করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একক কোনো খেলোয়াড়ের হয়ে যায়নি ২০১২। বছরের বাকি তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম উঠেছে ভিন্ন তিনজনের হাতে। ফ্রেঞ্চ ওপেনের রাজত্ব ফিরে পেয়েছেন রাফায়েল নাদাল। উইম্বলডনের রাজত্ব ফিরে পেয়ে ফেদেরার বুঝিয়ে দিয়েছেন, এখনো তাঁর বুড়ো হাড়ে যথেষ্ট ভেলকি আছে। মারের অপেক্ষা উইম্বলডনেই ঘুচবে বলে মনে করেছিলেন অনেকে। ১৯৩৮ সালে বানি অস্টিনের পর প্রথম ব্রিটিশ খেলোয়াড় হিসেবে উইম্বলডন ফাইনালে উঠেছিলেন এবার। কিন্তু ফেদেরার ঘাসের কোর্টে তাঁর হারানো ঝলক ফিরে পাওয়ায় খালি হাতে ফিরতে হয় মারেকে।
তবে একেবারেই খালি হাতে ফিরেছেন বলাটা ঠিক হলো না বোধ হয়। আগের তিনটি ফাইনালে মারে হেরেছিলেন সরাসরি সেটে। বারবার এত কাছে থেকে ফিরে এলে আত্মবিশ্বাসের দেয়ালেও ফাটল ধরে। কিন্তু কোচ হিসেবে ইভান লেন্ডলকে পাওয়া মারেকে অনেকটাই বদলে দেয়। উইম্বলডন ফাইনালে একটি সেটও জেতেন। সেখানে যে সূর্য উঁকি দিয়েছিল, সেটা শেষ পর্যন্ত উদিত হলো ইউএস ওপেনের আকাশে।
মেয়েদের কোর্টেও একক দাপট ছিল না কারও। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছেন ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কা। ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে ক্যারিয়ার স্লাম পূর্ণ করেছেন মারিয়া শারাপোভা। কিন্তু এরপর বছরের দ্বিতীয় ভাগটা নিজের করে নিয়েছেন সেরেনা উইলিয়ামস। হাঁটুর বয়সী প্রতিপক্ষদের একটা বার্তাও পাঠিয়েছেন, উইলিয়ামসদের পতাকা আরও কিছুদিন উড়বেই। উইম্বলডন আর ইউএস ওপেনের পাশাপাশি সেরেনা জিতেছেন অলিম্পিক সোনাও। পুরুষ এককে অলিম্পিক সোনার অপেক্ষা ঘোচেনি ফেদেরারের। ফেদেরারকে ৬-২, ৬-১, ৬-৪ গেমে হারিয়ে শুধু অলিম্পিক সোনাই জেতেননি, মারে নিয়েছেন উইম্বলডনে হেরে যাওয়ার শোধও, সেই একই কোর্টে। কারণ, এবারের অলিম্পিক টেনিস হয়েছে উইম্বলডনেই।
বছরটা টেনিসের শীর্ষ চার তারকাকেই একটি করে গ্র্যান্ড স্লাম দিয়েছে বটে, কিন্তু তার পরও নাদালের জন্য তা হয়ে থাকল ভীষণ আক্ষেপের। উইম্বলডনের দ্বিতীয় রাউন্ডে লুকাস রসল নামের অখ্যাত এক খেলোয়াড়ের কাছে হেরে যাওয়ার পর ছয় মাস ধরেই কোর্টের বাইরে। হাঁটুর ইনজুরি নাদালকে দর্শক বানিয়ে রেখেছে বছরের দ্বিতীয় ভাগের প্রায় পুরোটাই। ২০১২ সালের দিকে তৃপ্তি নিয়ে একজনই শুধু পেছন ফিরে তাকাতে পারছেন—অ্যান্ডি মারে!

No comments

Powered by Blogger.