জাপানের পারমাণবিক প্রস্তুতি by এনামুল হক

এ বছর পূর্ব চীন সাগরের কতিপয় দ্বীপ নিয়ে চীন ও জাপানের মধ্যে সংঘাত যথেষ্ট উদ্বেগ সঞ্চার করেছে। কিন্তু তার চেয়েও উদ্বেগজনক একটা ব্যাপারকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না।
সেটা হলো জাপান আগামী বছর তার দীর্ঘ বিলম্বিত রোকসাকো রিপ্রসেসিং প্ল্যান্টকে চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই কারখানায় বছরে ব্যয়িত রিঅ্যাক্টর জ্বালানি থেকে অস্ত্রমানের প্রায় ৮ টন প্লুটোনিয়াম পাওয়া যেতে পারে যা প্রায় এক হাজার বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট। জাপানের বর্তমানে ৪৪ টন প্লুটোনিয়ামের মজুদ আছে। তার মধ্যে ৯ টন অভ্যন্তরীণ স্থাপনাগুলোতে রাখা হয়েছে।
জাপান বার বার অঙ্গীকার করে এসেছে, তারা কখনই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে না। এ নিয়ে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই, কিন্তু উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণটা অন্য। রিপ্রসেসিংয়ের মধ্য দিয়ে অস্ত্রমানের যে প্লুটোনিয়াম বা ইউরোনিয়াম পাওয়া যায় সেটা সন্ত্রাসবাদীদের প্রলুব্ধকর টার্গেটে পরিণত হতে পারে। তাছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য তা একটা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গত বছর ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর জাপান পারমাণবিক জ্বালানি পুনর্প্রক্রিয়াকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেটা করছে আন্তর্জাতিক চাপকে অগ্রাহ্য করে। গত মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছিলেন, ‘পৃথকীকৃত প্লুটোনিয়ামের মতো উপাদান যা আমরা সন্ত্রাসবাদীদের নাগাল থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছি, সেটাকে বিপুল পরিমাণে জমিয়ে রাখা যেতে পারে না।’ জাপান কর্তৃপক্ষ তাঁর এই বক্তব্য আমলে তো নেয়ইনি উপরন্তু এমন উদ্যোগের সমর্থক কেউ কেউ দাবি করে বসে যে, ওবামা প্রশাসন বাস্তবে জাপানের প্লুটোনিয়াম রিপ্রসেসিং কর্মসূচীকে সমর্থন করেছেন।
জাপান জোর দিয়ে বলে থাকে যে, তাদের প্লুটোনিয়াম নিরাপদে মজুদ রাখা হয়েছে। কিন্তু ভারি পরমাণু সন্ত্রাসবাদীদের এই প্লুটোনিয়াম চুরির একটি মাত্র চেষ্টাও যদি সফল হয় তাহলে বিশ্বব্যাপী মহাসংকট দেখা দেবে। তার চেয়েও বড় উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে এই রিপ্রসেসিয়ের ছত্রছায়ায় অন্যান্য দেশ পরমাণু অস্ত্র করায়ত্ত করার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায, ১৯৭৪ সালে ভারত আমেরিকান এটমস ফর পিস কর্মসূচীর সহায়তায় প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধ করেছিল। পরবর্তীকালে শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের নামে ওটা দিয়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। জাপানই একমাত্র পরমাণু অস্ত্রহীন রাষ্ট্র, যে পরমাণু জ্বালানি পুনর্প্রক্রিয়াজাত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়াও ইদানীং দাবি করছে যে, জাপানের মতো প্লুটোনিয়াম পুনর্প্রক্রিয়াজাত করার একই অধিকার তাকেও দিতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া একা নয়, দক্ষিণ আফ্রিকাও প্লুটোনিয়াম পুনর্প্রক্রিয়াজাত করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। পুনর্প্রক্রিয়াজাতকরণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এমন এক ব্যয়বহুল কাজে দক্ষিণ আফ্রিকা কেন হাত দিতে চাইছেÑ এই প্রশ্নের জবাবে সে দেশের এক পরমাণু কর্মকর্তা একবার বলেছিলেন, “রিপ্রসেসিং হলো আধুনিক বিশ্বে ক্ষমতার চাবিকাঠি।” এদিকে ইরানও বলেছে যে, তাঁরও জাপানের মতো একই অধিকার আছে। ভারত তার প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদনে যে ধরনের পরমাণু চুল্লি বানিয়েছিল অনুরূপ চুিল্ল ইরানও এখন তৈরি করছে।
রিপ্রসেসিংয়ের খরচ অনেক বেশি নতুন স্থাপনার ক্ষেত্রে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার। তারপরও জাপান জোর দিয়ে বলছে যে, ব্যয়িত পারমাণবিক জ্বালানির জন্য এটাই তার আয়ত্তসাধ্য একমাত্র পথ। গোড়াতে অন্যান্য দেশের মতো জাপানও ব্যয়িত পারমাণবিক জ্বালানি রিপ্রসেসিংয়ের কথা ভেবেছিল যাতে নতুন প্রজন্মের ব্রিডার রিঅ্যাক্টরের জন্য প্লুটোনিয়াম পাওয়া যায়। এই ব্রিডার রিঅ্যাক্টের আরও দক্ষতার সঙ্গে ইউরোনিয়াম ব্যবহার করতে পারবে। তবে সমস্যা হচ্ছে ইউরোনিয়াম এখনও সস্তা ও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। অন্যদিকে ব্রিডার রিঅ্যাক্টরগুলো ব্যয়বহুল ও অনির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে। ইতোমধ্যে এক দুর্ঘটনায় জাপানের নিজস্ব ব্রিডার রিঅ্যাক্টর চার মাস চালু থাকার পর বন্ধ হয়ে যায়। এখনও এটাকে পুনরায় চালু করার চেষ্টা চলছে। জাপান এরপর ব্যয়িত জ্বালানি থেকে পৃথক করা প্লুটোনিয়ামকে প্রচলিত রিঅ্যাক্টরগুলোর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের কৌশল নেয়।
বেশির ভাগ দেশের পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের চৌবাচ্চায় জায়গা থাকার দরকার হয়। এখান থেকে পুরনো এবং অপেক্ষাকৃত শীতল জ্বালানির খানিকটা সরিয়ে নিয়ে কেন্দ্রের চৌহদ্দির মধ্যকার বায়ুশীতল পিপায় ভরে রাখা হয়। এতে রিপ্রসেসিংয়ের খরচের মাত্র ৫ শতাংশ খরচ হয়। শেষ পর্যন্ত ওই ব্যয়িত জ্বালানি ভূগর্ভের আধারে চালান দেয়া হয়। রিপ্রসেসিংয়ের প্রবক্তা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বক্তব্য, পরমাণু কেন্দ্রের চারপাশের জনগোষ্ঠী ব্যয়িত জ্বালানি পিপায় জমিয়ে রাখতে দেবে না বলেই তা রিপ্রসেসিংয়ের ব্যবস্থা করেছে।

No comments

Powered by Blogger.