কয়লানীতি, বিশেষজ্ঞ কমিটি ও বাস্তবতা by হাসান কামরুল

কয়লানীতি প্রণয়ন নিয়ে দীর্ঘ এক জটিলতায় আটকে আছে কয়লা খাত। সাত-আট বছর ধরেই কোল পলিসি নিয়ে একটার পর একটা কমিটি হচ্ছে; কিন্তু নীতি চূড়ান্ত হচ্ছে না। কারণ এ যাবৎ যত কমিটি হয়েছে, প্রত্যেকটি কমিটির প্রতিবেদনের প্রায়োগিক দিক নিয়ে কারিগরি কমিটি গঠন,


কারিগরি কমিটির রিপোর্টকে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় যাচাই-বাছাই নিয়ে মূল্যায়ন কমিটি গঠন- এভাবেই একের পর এক কমিটিনির্ভর হয়ে পড়েছে কয়লা খাত। আর তাতে সাত-আট বছর চলে গেছে। মোটের ওপর এটা বলা যায়, কয়লা খাতে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়েছে, যেটা পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক। আর এ দুরবস্থা সৃষ্টি হওয়ার শুরুটা চারদলীয় জোট সরকারের আমল থেকে। ২০০৫-০৬ সালে আইআইএফসি নামক একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান সরকারপ্রধানকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে প্রচলিত খনি ও খনিজ বিধির বাইরে প্রাকৃতিক কয়লার সুষম ব্যবহারের লক্ষ্যে একটি কোল পলিসি বা কয়লানীতি থাকা দরকার। ব্যস, সরকারপ্রধানও বিষয়টিতে সম্মতি দিয়ে দেশি কয়লার সর্বোত্তম ব্যবহারের লক্ষ্যে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে কয়লানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেন। আইআইএফসি ৯০ দিনের মধ্যেই একটা খসড়া নীতি দাঁড় করিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে দাখিল করে। অনেকের ধারণা, আইআইএফসি টাটা এনার্জির পক্ষে কয়লানীতি প্রণয়নে তড়িঘড়ি করে রিপোর্ট দাখিল করেছে। কারণ টাটা এনার্জি তখন বাংলাদেশে কয়লা খাতে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁর এক উপদেষ্টার পরামর্শে আইআইএফসির রিপোর্টের টেকনিক্যাল বা কারিগরি দিক যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বুয়েটের প্রফেসর আবদুল মতিন পাটোয়ারীকে প্রধান করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন। যেখানে জিএসবির প্রতিনিধিও ছিল। কিন্তু পাটোয়ারী কমিটির রিপোর্ট দাখিলের পরপরই বিএনপি সরকারের শেষ সময় চলে আসায় কয়লানীতি চূড়ান্তকরণে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ১-১১-এর পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাটোয়ারী কমিটির রিপোর্ট নিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসে এবং পাটোয়ারী কমিটির রিপোর্ট যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আরেকটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারও শেষ পর্যন্ত কোল পলিসি নিয়ে অব্যাহত সমালোচনার কারণে চূড়ান্তকরণের দিকে এগোয়নি। এ সরকারও ২০১০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত রিপোর্টের কিছু অংশ বিয়োজন-সংযোজনের মাধ্যমে তৎকালীন জ্বালানিসচিবকে প্রধান করে একটি আমলানির্ভর কমিটি দিয়ে খসড়া কয়লানীতি প্রণয়ন করে তা জনসাধারণের মতামতের জন্য পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ তিন মাস ওয়েবসাইটে মাত্র ২০টি মতামত পড়ে, ফলে সরকার খসড়া কয়লানীতি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয় এবং পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনকে দিয়ে পুনরায় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। যে কমিটি কয়েক দিন আগে মতামতসংবলিত একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করে।
মোশাররফ কমিটির রিপোর্টে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়ায় পরীক্ষামূলক উন্মুক্ত খনি স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে বলে তেল-গ্যাস-বন্দর ও বিদ্যুৎ রক্ষা কমিটি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছে। একদিকে সরকার পলিসি নিয়ে এগোচ্ছে, অন্যদিকে সিভিল সোসাইটির এ গ্রুপটি সরকারের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সরাসরি বিরোধিতা করে রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। ফলে কোল পলিসিতে একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। আর এ থেকে কেন জানি সরকারগুলো বের হতে পারছে না। বহুজাতিক কম্পানি এশিয়া এনার্জি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য অনেক দিন ধরেই নানা উপায়ে চেষ্টা-তদবির করছে। ঘটনার সূত্রপাত ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে এবং ফুলবাড়ী শহরে বিশাল এক গণজমায়েতের আয়োজন করে। তাদের দাবি ছিল, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ীতে কয়লা তোলা যাবে না। এ দাবিতে গ্রুপটি যখন লক্ষাধিক লোককে ফুলবাড়ীতে জড়ো করে, তখন একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বেধে যায় এবং পুলিশ মিছিলকারীদের প্রতি গুলিবর্ষণ করে তিনজনকে মেরে ফেলে। আর এ ঘটনায় বিএনপি সরকার বিব্রতকর এক অবস্থায় পতিত হয় এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি একট্টা ঘোষণা করেন এবং ফুলবাড়ী চুক্তির প্রতি তাঁর দলের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। সরকার সিভিল সোসাইটির চাপের মুখে এশিয়া এনার্জিকে বিতাড়ন, উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধকরণ ও জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে কয়লা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ ৩০ আগস্ট 'ফুলবাড়ী' চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির পর অবশ্য এশিয়া এনার্জি বাংলাদেশ ত্যাগ না করলেও ফুলবাড়ী ত্যাগ করে ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। ঢাকা থেকেই ফুলবাড়ীর ব্যাপারে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি সূত্রে চাপ দিতে থাকে। এ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের পেছনে এশিয়া এনার্জির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ রয়েছে বলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ করেছেন।
সত্যি কথা বলতে গেলে ফুলবাড়ীতে পুলিশের গুলি করে মানুষ মারার কারণেই কয়লানীতি প্রণয়ন নিয়ে সরকারগুলো গড়িমসি করছে। প্রতিটি সরকারই ঠিক তাদের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে কয়লানীতি নিয়ে বেশ নড়েচড়ে ওঠে। পরে সিভিল সোসাইটির অব্যাহত সমালোচনায় কয়লানীতি চূড়ান্ত না করে একটা রাজনৈতিক ইস্যু জিইয়ে রাখে এবং নির্বাচনী ম্যানুফেস্টোতে দলগুলো কয়লানীতি চূড়ান্তকরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। আসলে কয়লানীতি এখন রাজনীতির ঢাল হয়ে গেছে। এ সরকারও যে কয়লানীতি চূড়ান্ত করবে, তা বিশ্বাস করাও বোকামি। কারণ এ কমিটির সদস্যসচিব খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) সেফাউল আলম তো বলেই দিয়েছেন, বিশেষজ্ঞ কমিটির এ সুপারিশনামা আবার পরীক্ষা করে দেখা হবে।
কয়লা খনি বাস্তবায়ন নিয়ে পদ্ধতিগত জটিলতার আবর্তে দেশের বিশেষজ্ঞ মহল। কারো মত উন্মুক্ত পদ্ধতি, আবার কেউ কেউ ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির পক্ষে। অন্যদিকে কেউ কেউ বলে আসছেন, বাংলাদেশের কয়লা মাটির নিচ থেকে ওঠানোরই দরকার নেই। কিন্তু এ কথা কেউ বলছেন না যে কয়লানীতির দরকার কতটুকু। কারণ মিনারেল সেক্টর উন্নয়নের জন্য প্রচলিত খনি ও খনিজবিধি রয়েছে। কেন এ খনিজবিধির মাধ্যমে কয়লা খাতের উন্নয়ন করা যাবে না? যদি রয়্যালটি নিয়ে আপত্তি থাকে তাহলে বিধি সংশোধন করে রয়্যালটির হার নতুন করে ধার্য করা যেতে পারে। অথবা বিধি সংশোধন করলেই হলো। আর খনিজবিধিতে বলা আছে, কয়লা এলাকার প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় নিয়ে পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। কয়লা রপ্তানির ব্যাপারে বলা হয়েছে, দেশের চাহিদা মেটানোর পর বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে। প্রচলিত খনিজবিধির দিকে না গিয়ে কোল পলিসি নিয়ে সরকারগুলো কেন এত উৎসাহী হয়ে পড়ে তাও ভাবার বিষয়।
বর্তমান বিশেষজ্ঞ কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদনের আগাগোড়া যতটুকু জানতে পেরেছি, তা হলো, উন্মুক্ত ও ভূগর্ভস্থ খনি- উভয় পদ্ধতির অপশনই রাখা হয়েছে রিপোর্টে। তবে বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীতে কম গভীর কয়লাস্তরের উন্মুক্ত খনি স্থাপনের প্রাকসম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পাইলট প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। জামালগঞ্জ কোল ফিল্ডের গভীরতা এক কিলোমিটার হওয়ায় সেখানে কোল বেড মিথেন (সিবিএম), ভূগর্ভস্থ কোলগ্যাসিফিকেশন (ইউসিজি) ও ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সুপারিশ করা হয়েছে। দিঘিপাড়ার ব্যাপারে পিপিপি বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে উন্নয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হবে। কারণ সরকার এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় মাপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব প্রকল্পে কয়লা সরবরাহ করতে গেলেও অন্তত দুটি কয়লা খনির উন্নয়ন করতে হবে। কারণ ভিশন-২০২১ অনুসারে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা রয়েছে, যার শতকরা ৫৩ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে কয়লা থেকে। আর তাতে বছরে ৩০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রচলিত বড়পুকুরিয়া কয়লার খনি থেকে বছরে এক মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা উৎপন্ন হয়, যা খনিমুখে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কয়লানীতির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কয়লা দেশের উন্নয়নে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। এ নিয়ে বিরোধিতার অবসান হওয়া জরুরি। বিদেশি কম্পানি করবে না দেশি কম্পানি করবে, সে সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। বিদেশি কম্পানি করলে কিভাবে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা যায়, তার জন্য অসংখ্য কমিটি করা যেতে পারে। তা নিয়ে বিরোধিতা করা যেতে পারে, সমালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু কয়লানীতি প্রণয়ন করা দরকার। এ ক্ষেত্রে বিরোধিতা না করে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য সিভিল সোসাইটিকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : ভূতত্ত্ববিদ
hkgeologist@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.