কে নেবে মোরে by সমরেশ বসু

সুরজিৎ মণ্ডল বাঁধানো ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে সামনের দিকটা একবার দেখে নিচ্ছে। তার পিছনেই সেই প্রকাণ্ড বিল। স্থানীয় লোকেরা কখন কে কী বলে, বোঝা যায় না। মনেও থাকে না। হাওড়া নাকি সায়র, কী যেন সব বলে। বিল ঝিল, তাও বলে। ওরা যা খুশি তাই বলতে পারে। আরশিয়া বিল, এই হচ্ছে আসল নাম।


বাবা_বাবাই তো? হ্যাঁ, বাবাই বোধ হয় একবার বলেছিলেন, আরশিয়া বিল মানে হচ্ছে আরশি বিল। আরশি, মানে আয়না। আয়নার মতো বিলের জল। স্বচ্ছ, গভীর, টলটলে। জলের গভীরে অনেক নিচের জিনিসও পরিষ্কার দেখা যায়। কথাটা ঠিক। নামটা সেদিক থেকে সার্থক। সুরজিৎ নিজেই দেখেছে, জলের অনেক নিচে পর্যন্ত যেন রোদ ঢুকে যায়। তা না হলে পুচ্ছ নাড়ানো মাছের রুপোলি ঝলক দেখা যায় কেমন করে? অবিশ্যি রোদ না থাকলেও দেখা যায়। মাছ তো দেখা যায়ই। মানুষও দেখা যায়। গতকাল বিকেলে বা আজ সকালে ঝর্ণা যখন জলের পাঁচ ছ হাত নিচে ডুবসাঁতার দিচ্ছিল, তখন ওকে প্রায় স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। সুইমিং কস্ট্যুম পরে নামেনি। শায়া আর ব্রা পরে নেমেছিল। সুরজিৎ ব্রা-টা খুলে ফেলতে বলেছিল। ঝর্ণা খোলেনি। ভুরু কুঁচকে ঠোঁট ফুলিয়ে সোহাগের সুরে বলেছিল, 'কী যা-তা বলছো? কে কখন এসে পড়বে?'
'কে আসবে?' সুরজিৎ হেসে উঠেছিল, 'এখানে কে আসবে? ধানু, ধানুর বউ? কলকাতার রসুইকরেরা? তারা জানে, এখন তুমি আর আমি ঘাটে চান করতে এসেছি। এখন এদিকে কেউই আসবে না। ওরা কি বোঝে না, আমরা দুজনে ঘাটে এসেছি। আমরা কী অবস্থায় থাকবো না থাকবো, সেটা ওরা বুঝতে পারে। বরং কেউ এদিকে আসতে গেলে ধানু আর ধানুর বউ আটকে দেবে। আমাদের আবরু বাঁচানোটা ওদের ডিউটি। তুমি ইচ্ছে করলে সবই খুলে ফেলতে পারো। এদিকে কেউ আসবে না। আর ওপারের কোনো কথাই নেই। প্রায় মাইলখানেক চওড়া বিল। এখন বোধ হয় শুকিয়ে আধমাইল। তার পরেও বাড়ি-ঘর কিছু নেই, চাষের মাঠ। গ্রাম বেশ দূরে। নর্থ আর সাউথ তো ধু-ধু, কোথাও কারোকে দেখতে পাচ্ছো? পাচ্ছো হয় তো, ঐ-ঐ দূরে নর্থে দু তিনটে নৌকো। বোধ হয় মাছ ধরছে লোকেরা। কিন্তু ওদের দেখাচ্ছে কাক-শালিকের মতো ছোট। এত দূরে ওদের নজরই আসবে না।'
ঝর্ণা ঠোঁট ফুলিয়ে সোহাগী ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছিল, 'না, সে তুমি যাই বলো, আমি সব খুলেটুলে ফেলতে পারবো না। এর আগে নিশ্চয়ই অনেক মেয়েকে নিয়ে এসে সব খুলেটুলে এই সব করেছো?'
ঝর্ণার পালটা প্রশ্ন শুনে সুরজিৎ খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসেছিল, 'আমার কিছু করবার দরকার হয়নি। যারা এসেছে, তারা নিজেদের ইচ্ছেমতোই যা খুশি তাই করেছে।' বলতে বলতে ঘাড় ঝাঁকিয়েছিল, 'যারা এখানে এসেছে, সবাই জানে এখানে লাজলজ্জার কিছু নেই। বরং এখানে এসে সবাই একটু হাঁফ ছেড়ে খোলাখুলিই হতে চেয়েছে। আমার এখানে কেউ জামাকাপড় এঁটে সভ্য হবার জন্যে আসে না। এখানে এসে সবাই সভ্যতার খোলসগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়। রুবি ধরকে চেনো তো_অ্যাঁ? নাউ ইমাজিন, সেই টল ফর্সা দুর্দান্ত ফিগার। নিচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটানে সব জামাকাপড় খুলে ফেলেছিল। ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়েছিল। অবিশ্যি একটু হাই ছিল।'
'রুবি ধর পারে, আমি পারব না।' ঝর্ণার ঠোঁট ফোলানোর মধ্যে ঈষৎ ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল।
সুরজিৎ হেসে বলেছিল, 'পেরো না, দরকার নেই। আমার তো আর তোমার কোনো কিছু নতুন করে দেখবার নেই। আছে? উম্? নেই। তবে? গো অন্। নেমে পড়।'
গতকাল বিকালে কথাগুলো হয়েছিল। আজ সকালে আর সুরজিৎ কিছু বলেনি। কিন্তু লাভটা কী হয়েছে? ঝর্ণা কি জানে, শায়া পরে জলে ডুব দিলে শায়ার হাল কী হয়? আর এই আয়নার মতো স্বচ্ছ জলের তলায়? জলের তলায় যে থাকে, সে দেখতে পায় না। ওপরে যে থাকে, সে সবই দেখতে পায়। ঝর্ণা হয়তো জানে। তবু ওটাই ওর সান্ত্বনা। ভালো কথা। সুরজিৎ যা দেখবার দেখেছিল। ভুলে গেলে হবে কেন, এর নাম আরশিয়া বিল। লেক, আরশিয়া লেক।
সুরজিতের স্নান হয়ে গিয়েছে। পাজামার ওপরে রঙিন সুতোর কলিদার পাঞ্জাবি। বুকের বোতামগুলো সব খোলা। পাউডার ছড়ানো লোমশ বুক খোলা। লম্বা চওড়া শরীর। রঙটা ময়লা। মেদের ছড়াছড়ি, বিশেষ করে পেটে। চওড়া মুখ, মোটা নাক, মোটা ঠোঁটের ওপর এক জোড়া সরু গোঁফ। মোটা ভুরু-জোড়ার নিচে বাদামি রঙের চোখ দুটো ঝকঝকে। চিলের মতো সতর্ক সন্ধানী দৃষ্টি। মাথার চুল নিপাট উল্টে আঁচড়ানো। পাউডার পারফিউম আর চুলের তেলের গন্ধ ছড়াচ্ছে। ডান হাতের আঙুলে দুটো জড়োয়ার আংটি। ডান হাতের কবজিতেই ঢাউস একটা ঘড়ি। বয়স মধ্য চলি্লশ। সে ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে, বিল পিছনে রেখে, তীক্ষ্ন চোখে সব দেখে নিচ্ছে।
কুড়ি বিঘা জমির ওপরে ক্যাসেলের মতো বাড়িটা। দোতলার দুই দিকে ছোট লাল টালির চার চালার মতো ছাদ। মাঝখানটা চার্চের মতো সরু আর লম্বা হয়ে ত্রিকোণ খোঁচায় আকাশে বিঁধে আছে। জানালা দরজার খিলান সবই ত্রিকোণ। লাল নীল কাচের ছড়াছড়ি, জানালা দরজার মাথায়। গোটা বাড়িটার রঙ হালকা হলুদ। তার সঙ্গে লাল ছোট টালি_একেই নাকি বিলিতি টালি বলে, রঙটা খোলতাই হয়েছে চমৎকার। ঠাকুর্দা কিনেছিলেন, কোন এক সাহেবের কাছ থেকে। আসলে, ঠাকুর্দা ছিলেন সাহেবের জমিদারি দেখাশোনা করার লোক। এই আরশিয়া বিল আর বিলের চারপাশে গোটা তালুকটাই ছিল সাহেবের। অনেকগুলো মৌজা নিয়ে এই তালুক। ঠাকুর্দা সাহেবের কাজের সুবাদে নিজেও কিছু জমিজমা করেছিলেন। সাহেবের প্রসাদ। প্রসাদ ভালোই ছিল। তা না হলে আর সাহেবের কাছ থেকে এ বাড়ি আর কুড়ি বিঘা জমি বাগান কিনেছিলেন কেমন করে।
জায়গাটার অবস্থান, পূর্বোত্তর চবি্বশ পরগনা। বিলের উত্তর সীমান্তেই নদীয়া জেলা। মোটর চলার রাস্তাই শুধু হয়নি। বিদ্যুৎও এসে গিয়েছে। আরশিয়া বিলের এই বাড়ি, এখন বাগানবাড়িই বলা চলে। বাবা ভালোমতো মেন্টেন করতেন। সুরজিৎও করে। আলো পাখা এমনকি ফ্রিজও আছে? জলের ট্যাংক, পাম্প, শাওয়ার, বাথটব, বেসিন, কমোড, সব ব্যবস্থা পাকা। অবিশ্যি শ্বেতপাথরের মেঝে, বিরাট বড় বড় বাথরুম-সাহেব জমিদারেরই তৈরি। ঢাকা দেওয়া ইঁদারার সঙ্গে লোহার পাইপ লাগিয়ে হাতে পাম্প করে জল তোলার ব্যবস্থাও আগেই ছিল। কমোড বাথটব বেসিনও ছিল। সুরজিৎ সবই নতুন আর আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে সাজিয়েছে। নিচে বিরাট হলঘর, ডাইনিং রুম, কিচেন। হলঘরের একদিকে বিলিয়ার্ড রুম। অতিথি অভ্যাগতদের জন্য বিশেষ ঘর। ওপরে ছটি বিরাট বেডরুম, সংলগ্ন বাথরুম। এ ছাড়াও আছে আউট হাউস। আস্তাবল আর গোয়ালঘর তার মধ্যে প্রধান। খিদমতগার খানসামা নোকর বাবুর্চি আয়া ইত্যাদির জন্য আলাদা থাকবার ঘর। সুরজিৎ আউট হাউসকে গ্যারেজে পরিণত করেছে। ঘোড়ার যুগ নেই। গরু পোষার কোনো প্রশ্নই নেই। আধডজন গাড়ি রাখবার মতো বিরাট গ্যারেজ। ফুলের বাগান কোনো এক কালে ছিল। এখন নেই। কিন্তু ফলের বাগান বলতে যা বোঝায় তা আছে সুপ্রচুর। সবই সেরা আর বাছাই ফলের গাছ। আম লিচু গোলাপজাম সবেদা জাম। তা ছাড়া সৌন্দর্যরক্ষার্থে গেটের সামনে পাম। উত্তরে সারি সারি দেবদারু। নারকেলগাছও প্রচুর। বাড়ির সামনে বিরাট লন। ঘাট পর্যন্ত তার সীমানা।
সময়টা ফাল্গুন মাস। সুরজিৎ লনের মাঝখানে বিরাট গার্ডেন ছাতা পুঁতেছে। অনেকটা রঙিন শামিয়ানার মতো। তাকে ঘিরে স্টিলের কয়েকটা ফোলডিং টেবিল আর চেয়ার। দেবদারু সারি ঘেঁষে ছায়ার নিচে রীতিমতো গদি শয্যা। অনেকগুলো লাল মখমল মোড়া তাকিয়া। ওদিকে রান্নার ব্যবস্থা পাকা। সকাল সাড়ে ন'টা বেজে গেলেও, ব্রেকফাস্টও রেডি। সেই রকমই কথা ছিল। অতিথিরা_যারা আজ আসছে, এখানে এসে ব্রেকফাস্ট করবে। ব্রেকফাস্ট যা হবে, তা জানা আছে। চা কফির ধারেও কেউ যাবে না। গোটা কুড়ি বিয়ারের বোতল ফ্রিজে ঢোকানো আছে। ওগুলো শেষ হতে হতেই আরও গোটা কুড়ি তিরিশ পর পর ঢুকবে। তা ছাড়া আট বোতল স্কচ্ হুইস্কি, চার বোতল জিন, চার বোতল ভোদকা। ফ্রেশ লাইম, অরেঞ্জ স্কোয়াশ্, টোমাটো জুস্ সব রাখা আছে। সকাল সাতটায় পেঁৗছে গিয়েছে তিনটে রুই আর কাতলা। মোট ওজন কুড়ি কেজি। গোটা কুড়ি মুরগি। আজকাল কেউ চারপেয়ে জানোয়ারের মাংস খেতে চান না। হৃদরোগ থাক বা না থাক, রেড মিট সবাই এড়িয়ে চলে। তা ছাড়া, গতকাল রাত্রে সুরজিৎ কলকাতা থেকে আট কেজি বাগদা চিংড়ি নিয়ে এসেছে। বেশ বড় সাইজের। গতর বড়, ছোট মুণ্ডু, বাগদার যা বৈশিষ্ট্য। কাল রাত্রেই সঙ্গে করে কলকাতার পাকা রসুইকর নিয়ে এসেছে। পানভোজনের মতোই নিয়ে এসেছে ঝর্ণাকেও।
এমন কিছু রূপসী ফুলকুমারী দেখতে না। চোখমুখ মোটামুটি। গায়ের রঙ ফরসা। মাংসালো চেহারা বলতে যা বোঝায়, তা-ই। খাটো, আঁটোসাঁটো শরীরে, চলায় ফেরায়, কথায় হাসিতে আর চোখ ঘুরিয়ে যে-সব ছলাকলাকৌশল দরকার, ভালোই জানে। পেটে বিদ্যে তেমন না থাক, ইংরেজি কপচাতে পারে। সুরজিতের এ রকম কয়েকটি ঝর্ণা আছে। ব্যবসার জন্য সবই দরকার হয়। সময় বিশেষে নিজেরও প্রয়োজন মেটে। অবিশ্যি, অতিথিরা সকলেই সস্ত্রীক আসছে। তবু বলা যায় না, কার মেজাজ কখন কী রকম হয়ে উঠবে। চবি্বশ ঘণ্টার প্রোগ্রাম। সারা দিন, গোটা রাত। একটি মেয়ে রাখা দরকার। অতিথিরা সবাই সস্ত্রীক নাও আসতে পারে। এলেই বা কী। সকলের স্ত্রী থাকলেও ঝর্ণাকে দরকার হতে পারে। আগন্তুক অতিথিদের চরিত্র তো সুরজিতের ভালোই জানা আছে। ঝর্ণাকে দেখলে অনেকেই খুশি হবে। অবিশ্যি অতিথিদের স্ত্রীদের সুরজিৎ চেনে। মাতাল হয়ে কে যে কখন কী করবে, কিছুই বলা যায় না। স্বামীদের তুলনায় স্ত্রীরাও কিছু কম যায় না। তবে তাদের জন্য একটি তাজা জোয়ান রাখা সম্ভব না।
কথাটা ভেবে সুরজিতের হাসি পেলো। দরকার হলে অতিথিরা বউ বদলাবদলি করতে পারে। রেকর্ড প্লেয়ার চালিয়ে দিয়ে যখন নাচ শুরু হবে, তখন কে কার বুকে ঢলবে, তারাই জানে। মোটের ওপর সুরজিৎ আতিথেয়তার আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখতে চায় না। মিনিমাম পাঁচ কোটি টাকার কাজ বাগাতে হবে। যারা আসছে, তারা কেউ বুরোক্রাট, কেউ টেকনোক্রাট। সব বাঘা-বাঘা কর্তাব্যক্তি। লোকে ভাবে, বুরোক্রাট আর টেকনোক্রাটদের মধ্যে বিরোধ আছে। থাকতে পারে। সুরজিতের পার্টিতে সবাই এক হয়ে যাবে। আপ্যায়নে কারোর প্রতি উনিশ-বিশ করা হবে না। এখানে এসে এই পরিবেশে, পানভোজনে সবাই মত্ত হয়ে যাবে। বিভাগীয় বিবাদ বিরোধের কথা কারোর মনেই থাকবে না। মাঝখান থেকে সুরজিতের কাজ হাসিল হয়ে যাবে। অবিশ্যি বাগানবাড়ি এই ফুর্তির আয়োজনই সব না। কাজ হাতে পাবার আগে, নগদে লেনদেনও হবে। বাগানবাড়ির এক আয়োজন হচ্ছে বেস তৈরি করা। ভিত পাকা হয়ে গেলে তখন আর ইমারত খাড়া করতে অসুবিধা হবে না।
ঝর্ণা লনের ওপর দিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে এলো। চমৎকার সেজেছে। লাল পাড়ের বাসন্তী সিল্ক শাড়ি। স্লিভলেস বাসন্তী রঙের কাঁচুলি। নাভির নিচে শাড়ির বন্ধনী। আই শার্টার মেখে চোখ ভুরু জব্বর এঁকেছে। ঠোঁটে লেপেছে লাল রঙ। ঘাড় অবধি ছাঁটা মোলায়েম রেশমি চুল খোলা। ফাল্গুনের বাতাসে উড়ছে। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, 'কী ব্যাপার? সাড়ে ন'টা বেজে গেল। তোমার গেস্টদের যে এখনো পাত্তা নেই।'
'আসবে আসবে। সুরজিৎ নিজের ঘড়িটা দেখলো, ফাঁকা রাস্তায় ঠিকমতো এলে কলকাতা থেকে দেড় দু'ঘণ্টার বেশি লাগা উচিত নয়। পথ ভুল করারও কোনো চান্স নেই। আমার ড্রাইভার পাইলটের কাজ করবে। এ জন্যই তাকে কাল রাত্রে ছেড়ে দিয়েছি। তাছাড়া জিপসহ আরো তিনটে গাড়ি আসবে। সবই আমার গাড়ি। সব ড্রাইভারই এখানে আগে এসেছে। আসলে, যারা আসছে, তারা কাল রাত্রে কখন বিছানায় গেছে তার ওপর নির্ভর করছে, কখন এসে পেঁৗছুবে। এখনো হয়তো কেউ কেউ ঘুম থেকেই ওঠেনি। সবাইকে ঠিকমতো তুলে একসঙ্গে জড়ো করে নিয়ে আসতে হবে। ড্রাইভার অনিলের ওপর দায়িত্ব দিয়েছি। সব মালকেই ও চেনে। ঠিক নিয়ে আসবে। আমার তো সব রেডি। তুমি ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছো?'
'নিয়েছি।' ঝর্ণা সুরজিতের পাশে এসে দাঁড়ালো, 'স্রেফ দু কাপ লিমন টি। কাল রাত্রে ড্রিংকটা বড় বেশি হয়ে গেছে। তোমার জন্য।' ঠোঁট ফুলিয়ে চোখের কোণে তাকালো।
সুরজিৎ ঝর্ণার পা থেকে মাথা অবধি দেখলো। সে মোটেই ঝর্ণাকে বেশি ড্রিংক করতে বলেনি। ঝর্ণা নিজেই মেতে গিয়েছিল। ফাল্গুনের দুরন্ত বাতাস। বাগানে ঝড়ের শব্দ। চারদিক জ্যোৎস্নায় ফটফট করছিল। বাগান লন বাড়ি আর আরশিয়া বিল, সব যেন জ্যোৎস্নার আলোয় আর বাতাসে দুলছিল। আর রাত্রেও কোকিল ডাকছিল। ঝর্ণা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিল। আর মাতাল হয়ে নিজেই হাসছিল। সুরজিৎ বললো, 'আজ যেন বেশি খেও না। খাবার ভান করো। আর যা বলে রেখেছি, খুব সাবধান। মিস্টাররা তোমাকে নিয়ে যে যাই করুক, মিসেসরা যেন চটে না যায়। মিস্টাররা এমনিতে সব এক-একটি বাঘ। মিসেসদের সামনে সব ভ্যাড়া। তবু মাতাল হয়ে তোমাকে নিয়ে টানাটানি করতে পারে। মিসেসদের সামনে তুমি সমঝে চলবে। আড়ালে আবডালে যে যা খুশি করুক। তা ছাড়া তোমাকে নিয়েও মিস্টারদের মধ্যে রেষারেষি হতে পারে। ম্যানেজ করা চাই। আসলে আমার কাছে ব্যাপারটা কী জানো তো? সার্কাসের একপাল বাঘের ঘরে ঢুকে খেলা দেখানোর মতো। খেলাটা ঠিকমতো দেখাতে হবে, হাততালি পাওয়া চাই। তবু মনে রাখতে হবে, জানোয়ার জানোয়ারই। যতোই পোষ মানা হোক, কখন কে কী কারণে বিগড়ে যাবে, কিছুই বলা যায় না।'
ঝর্ণা অবাক চোখে তাকিয়ে সুরজিতের কথাগুলো শুনছিল। আর অবাক স্বরেই বললো, 'ওহ কতো কী জানো। কতো রকম ভাবতে হয়। কী অভিজ্ঞতা।'
'সহজে কি আর এত অভিজ্ঞতা হয়েছে?' সুরজিতের বিস্তৃত সরু গোঁফে আত্মপ্রসাদের হাসি। 'অনেক ঘা খেয়ে, ঠেকে শিখতে হয়েছে। তবে ইট'জ্ ইন মাই ব্লাড। দিস্ ইজ বিজনেস। মানি অ্যান্ড প্রপার্টি করতে হলে অনেক কিছু জানতে হয়।'
ঝর্ণা কনুই দিয়ে সুরজিতের ভুঁড়িতে একটা খোঁচা দিল, 'ও রকম তুচ্ছ করে মানি অ্যান্ড প্রপার্টি বোলো না। মানি অ্যান্ড প্রপার্টি অনেকেই হয়তো করে, কিন্তু সেসব কতোটুকু? তোমার তো কুবেরের ধন। কোটি-কোটিপতি তুমি। প্রপার্টি কতো করেছ, নিজেও বোধ হয় জানো না।'
'হ্যাঁ, তা করেছি, তবে একলা নয়।' গর্বিত সুরজিৎ বিনীত হবার চেষ্টা করলো, 'ঠাকুর্দা থেকে শুরু। আমি হাতে-কলমে বাবার কাছ থেকে শিখেছি। দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকে বাবা খোদ সাহেবদের ট্যাকল্ করতে শিখেছিলেন। স্বাধীনতার পরে নতুন দেশী সাহেবরা শাদা সাহেবদেরও ছাড়িয়ে গেছে। ঘুষ খাওয়া, ফুর্তি করা তাদেরও ছিল। কিন্তু ওরা যে সাহেব, সেটা কখনো ভুলতে পারতো না। সে জন্যই বোধ হয় কালা লোকদের কাছে নিজেদের একটা মুখোশ এঁটে রাখতো। দেশী সাহেবরা তাও রাখে না। ডেঁড়েমুশে যতোটা পারে নিংড়ে নেবার চেষ্টা করে। এদের চোখের পাতা নেই। বাবা এদের খুব ভালো চিনতেন। আমাকেও চিনিয়ে দিয়ে গেছেন। সে জন্যই বলছিলাম, ওটা আমার রক্তে আছে। তা ছাড়া আজকাল আর কেবল বুরোক্রাট আর টেকনোক্রাটদের দিয়ে সব হয় না। পলিটিকাল পার্টির আড়কাঠিগুলো আছে। পুজো খাবার দেবতার দল বেড়েই যাচ্ছে। বখ্রার ব্যাপারে এদের নিজেদের মধ্যে লড়ালড়ি, সে-ঝক্কিও আমাদেরই পোয়াতে হয়। পোয়াই। সে রকম পাই বলেই পোয়াতে পারি। ইট'জ্ এ গেম্, ওয়াইল্ড গেম্।'
ঝর্ণার চোখে আর এখন বিস্ময় নেই। ঠোঁটের কোণে চটুল হাসি, চোখের নজরে চাটুকারিতা, 'বাব্বা! যাকগে, এত সব বুঝিনে। এবার তোমার দুটো ডিল। পাস্ হয়ে গেলেই আমাকে কী দেবে, মনে আছে তো?'
'নিশ্চয়ই মনে আছে।' সুরজিৎ পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিংসাইজ সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করলো, 'একটা জড়োয়ার নেকলেস। পাবে। আমি কথা দিলে কথা রাখি।'
ঝর্ণা সোহাগী ভঙ্গিতে সুরজিতের হাত থেকে লাইটারটা নিল। লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল। সুরজিৎ বললো, 'থ্যাংকস।'
সুখী ঝর্ণা লাইটারটা গালে ঘষতে ঘষতে বিলের দিকে তাকালো। ফাল্গুনের বাতাসে বিলের জলে নদীর মতো ঢেউ লেগেছে। ওর চুল উড়ছে। বুক থেকে খসে যাওয়া আঁচল উড়ছে। বাগান থেকে কোকিলের ডাক ভেসে আসছে। পৃথিবী কী সুন্দর। আর কতো সুখ এখানে আছে। কেবল তার অন্ধিসন্ধিগুলো জেনে নেওয়া চাই।
বেলা এগারোটার সময় অতিথিরা এলো। ছ'জনের মধ্যে চারজন সস্ত্রীক। বারোজনের হিসাবে দশ। মিঃ গুহ, মিঃ বিশ্বাস, মিঃ কেলকার, মিঃ সেন, মিঃ নন্দী, মিঃ চ্যাটার্জি। আসেনি মিসেস গুহ আর মিসেস চ্যাটার্জি। সুরজিৎ জানে এর মধ্যেও কিঞ্চিৎ ইচ্ছাকৃত ব্যাপার আছে। মিঃ গুহর মিসেসের কেলকারের ওপর বিশেষ দুর্বলতা। মিঃ চ্যাটার্জির দুর্বলতা মিসেস নন্দীর ওপর। হয়তো দুজনেই মিসেসদের চেষ্টা করে এড়িয়ে এসেছে।
সবাই এসে আহ্লাদে আটখানা। খুশি আর উল্লাসে 'হাই হাই' উচ্চস্বরে চিৎকার। শিশুর মতো ছোটাছুটি লাগিয়ে দিল। সত্যি, একদল শিশুই যেন। মিসেসরা মুগ্ধ উল্লাসে বালিকাদের মতো চারদিকে ছুটে ছুটে সব দেখতে লাগলো। মিস্টাররাও তা-ই। সকলের মুখেই, 'ইট'জ এ হেভেন!' 'ওয়ান্ডারফুল!' লনের গার্ডেন আমব্রেলা, চেয়ার টেবিল, দেবদারুর ছায়ায় রাজকীয় শয্যা, সব দেখে সকলের মুখেই মুগ্ধ বিস্মিত প্রশংসা 'কী অ্যারেঞ্জমেন্ট!' মিঃ কেলকার বললেন, 'মণ্ডল, ইয়ু আর এ কিং।'
'স্যার, ডোন্ট সে স্যো। ইফ আয়াম এ কিং, ইউ অল আর কিং মেকারস।' সুরজিৎ বিনয় নম্রভাবে প্রায় সকলের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে কুর্ণিশ করার ভঙ্গি করলো। ভয়ও আছে। সুরজিতের বৈভব দেখে এদের কার মনে আবার ঈর্ষার জ্বালা ধরে যাবে, বলা যায় না। চাকরির পদাধিকার বলে, এরা সব কেউকেটা। আসলে এরা তো সামান্য বেতনভোগী। উপরি পাওনা দিয়ে সব আকাঙ্ক্ষা মেটানো সম্ভব না।
মুহূর্তের মধ্যেই, বাড়ি দেখার নাম করে কে কোথা ঢুকে পড়লো, টেরই পাওয়া গেল না। কেবল একতলা আর দোতলা থেকে মহিলা-পুরুষদের নানারকম হর্ষোৎফুল্ল ধ্বনি ভেসে আসছে। ঝর্ণা তাদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছে। পরিচয়টা আগেই পেয়েছে। ঝর্ণা সুরজিতের গার্লফ্রেন্ড। সুরজিৎ ঝর্ণাকে বলে রেখেছে, মিঃ গুহ আর মিঃ সেনের দিকে একটু বিশেষ নজর রাখতে। ঐ দুজন প্রধান। বাকিদেরও মোটেই হেলাফেলা করা চলবে না।
সুরজিৎ রসুইখানার দিকে একবার গেল। রান্নার আয়োজন চলছে পুরোদমে। ড্রাইভাররা সেখানেই খাবার খাচ্ছে। ধানু আর ধানুর বউ, দুজনেই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া। তবে দুজনেই যথেষ্ট পরিশ্রমী। তারাই এ বাগানবাড়ি দেখাশোনা করে। তাদের দুই ছেলেও কাজের জন্য রয়েছে। সুরজিৎ রসুইকরকে বললো, 'কিছু ডিমের ওমলেট, পোচ আর ছাঁকা তেলে আলুভাজা করে ফ্যালো। চা কফির দরকার হলে বলবো! সবাই এসে লনে বসুক।' ড্রাইভারদের প্রধান অনিলকে বললো, 'দরকার হলে তোমরাও একটু হাত লাগিও।'
'এ আবার বলতে হবে নাকি স্যার।' অনিল মাখন টোস্ট চিবোতে চিবোতে বিনীত হেসে বললো।
সুরজিৎ ডাইনিং হল থেকে মেইন হলে ঢোকবার মুখেই মিঃ সেনকে দেখলে। ঝর্ণার কোমরে হাত দিয়ে একটা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। চমৎকার! তারপর ওপর থেকে সব কলকল করতে করতে নেমে এলো। মিঃ সেন তখন ঝর্ণার কোমর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে। ওপর থেকে সকলের পিছনে নেমে এলো মিঃ গুহ আর মিসেস কেলকার। সকলের মুখেই কেবল গোটা বাড়ির আর সাজসজ্জার প্রশংসা।
সুরজিৎ সকলের সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বললো, 'কিন্তু সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। ব্রেকফাস্ট করবেন না?'
'হোয়াট? ব্রেকফাস্ট!' মিঃ চ্যাটার্জি যেন এমন অদ্ভুত কথা আর কখনও শোনেননি। বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো, 'চক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষজুড়ে।'
সবাই হেসে উঠলো। মিঃ নন্দী বললো, 'সত্যি গলা বুক শুকিয়ে কাঠ।'
'তাহলে ঠাণ্ডা বিয়ার?' সুরজিৎ প্রশ্নটা আলগোছে ছুঁড়ে দিল, 'বাইরের ছাতার তলায় বসে_।'
'হাই হাই!' সবাই একসঙ্গে ধ্বনি দিল। হলঘরের উঁচু ছাদে তার প্রতিধ্বনি শোনালো যেন, 'খাই খাই।'
মিসেস সেন বললো, 'সত্যি মিঃ মণ্ডল, আপনার অ্যারেঞ্জমেন্টের তুলনা নেই। বাড়িটা কী দারুণ! আপনার গ্র্যান্ডফাদার কোন সাহেবের কাছ থেকে কিনেছিলেন, তাই বলেছিলেন না?'
'হ্যাঁ।' সুরজিৎ নম্র হেসে বললো, 'নইলে আমার মতো লোকের পক্ষে এ বাড়ি কেনা সম্ভব হতো না।'
মিঃ বিশ্বাস বললো, 'বিনয় করবেন না মিঃ মণ্ডল। আপনিও পারেন। এনি হাউ আমরা এখন বাইরে গিয়ে বসি।'
মিঃ গুহ তাকিয়েছিল মিসেস কেলকারের দিকে। দুজনের চোখে চোখে হাসি। সবাই হৈহৈ করে বাইরে বেরিয়ে গেল। সকলেরই বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বা ছুঁয়েছে। কেবল গুহ আর বিশ্বাসের বয়স চলি্লশের মাঝামাঝি। মিসেস কেলকারের বয়স অনধিক চলি্লশ। মারাঠি মহিলার স্বাস্থ্যটি ভালো। রূপও আছে। বাকি মহিলাদের বয়স চলি্লশের অধিক। তার মধ্যেই মিসেস নন্দীকে বয়সে সকলের থেকে কম দেখায়। বব্ড চুল, আর পোশাকে নিজেকে আরও কম বয়সী করে তোলবার কারুমিতি আয়ত্তে আছে। রূপও কিছু কিঞ্চিৎ আছে।
সুরজিৎ সংকেত পেয়ে গিয়েছে। ধানুর ছেলেদের হাত দিয়ে সে ফ্রিজ থেকে দশ বোতল বিয়ার পাঠিয়ে দিল। ধানুকে বলে দিল, 'আরও দশটা বোতল ভেতরে ঢুকিয়ে দাও। চাইলেই আগের ঠাণ্ডা বোতলগুলো পাঠিয়ে দেবে, আবার নতুন বোতল ভেতরে ঢুকিয়ে দেবে। রান্নার লোককে বলে রেখেছি, কী খাবার পাঠাতে হবে।'
ছাতার তলায় টেবিলের ওপর গ্লাস সাজানো ছিল। সুরজিৎ ওপ্নার দিয়ে দ্রুত হাতে বিয়ারের বোতলের মুখ খুলে দিল। দু-চারটে বোতল থেকে ফেনিলোচ্ছল বিয়ার গড়িয়ে পড়লো। অতিথিরা ঠিক যে যার জায়গায় বসে গিয়েছে। মিঃ গুহ মিসেস কেলকারের পাশের চেয়ারে। মিঃ চ্যাটার্জি মিসেস নন্দীর পাশে। ঝর্ণা মিঃ সেনের পাশে দাঁড়িয়ে। ঠিকই করেছে। ওর এক পাশে সেন, আর এক পাশে নন্দী। গুহ তো মিসেস কেলকারকে পাশেই রেখেছে।
ফেনিলোচ্ছল বিয়ারের গেলাস তুলে, সবাই চিয়ার্স করলো, 'মিঃ মণ্ডল যুগ যুগ জীও।' সকলেই এত তৃষ্ণার্ত, প্রথম গেলাস নিমেষেই শেষ। তারপরে মিঃ চ্যাটার্জির খেয়াল হলো। বললো, 'আরে মণ্ডল আর মিস রায়ের (ঝর্ণা) হাত যে শূন্য। গেলাস কোথায়? 'নিচ্ছি স্যার, নিচ্ছি।' সুরজিৎ সকলের গেলাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে বললো, 'ঝর্ণা, আমার দিকে আরো দুটো গেলাস এগিয়ে দাও তো।'
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই কুড়ি বোতল বিয়ার শেষ। তার সঙ্গে ডিমের পোচ ওমলেট, টোমাটো আর চিলি সসের সঙ্গে আলুভাজাও ভালোই চলেছে। আরও দশ বোতল বিয়ার এসে গেল। ফাল্গুনের বাতাস উত্তাল। এ বাতাস আরও বেশি মাতাল করে। রৌদ্রালোকিত আরশিয়ার ঝিলে ঢেউ ঝলকাচ্ছে।
মাঝেমধ্যে অফিসের কথা উঠছে। নিজেদের মধ্যেই হাসি-ঠাট্টা-বিদ্রূপ আর খোঁচা মারামারি চলছে। অবিশ্যি আপসে। কিন্তু বিয়ারের প্রভাবে অফিসের কথা টিকছে না। মি. গুহর এক হাত মিসেস কেলকারের হাঁটুর কাছে। মি. চ্যাটার্জির গা ঠেকেছে মিসেস নন্দীর কাঁধে। কেউ কেউ উঠে পড়ছে। ছুটে গিয়ে দেবদারুর ছায়ায় গদিতে লুটিয়ে পড়ছে। গুহ আর চ্যাটার্জিও তাদের প্রিয় সঙ্গিনীদের নিয়ে বাগানের দিকে হারিয়ে যাবার তাল করছে। মিসেস সেন সুরজিতের কাছে কাছে থাকছে। মিসেস বিশ্বাস কেলকারকে গাছ চেনাচ্ছে। মি. বিশ্বাস আর মিসেস নন্দী ঘাটের ওপর বসে বকছে আর হাসছে।
ধানুর দুই ছেলে সবাইকে বিয়ার ভরতি গেলাস এগিয়ে দিচ্ছে। একসময়ে প্রায় সবাই দেবদারুবীথির ছায়ায় গদীতে ওলটপালট। যে যেমনভাবে খুশি হাত-পা ছড়িয়ে বা গুটিয়ে এলিয়ে পড়ল। সকলের চোখ লাল। ফাল্গুনের প্রকৃতিও খেলায় মেতেছে। বেলা দুটো নাগাদ তিরিশ বোতল বিয়ার শেষ। সুরজিৎ হিসাব রেখেছে। সে আর ঝর্ণা দুই বোতলের বেশি নেয়নি। আটাশ বোতল দশজনে। এবার বোধহয় খাওয়ার জন্য ডাকা দরকার। দুপুরের খাবার রেডি। ইতিমধ্যে মি.-মিসেসরা কয়েকবারই বাড়ির ভিতর থেকে ঘুরে এসেছে। বাথরুমের প্রয়োজন সকলেরই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
মিসেস কেলকার মাতলামি কাটাবার জন্যই বোধহয় ঘাটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর তার চোখেই প্রথম ঘটনাটা ধরা পড়ল, 'ওয়াট ইজ দ্যাট? দেয়ার ইন দ্য লেক।' হাত তুলে বিলের জলের দিকে দেখাল।
প্রথমে কেউ তার কথায় কান দিল না। একমাত্র গুহ এগিয়ে গেল। সেও অবাক চোখ কচলে নিয়ে আবার দেখল। বলল, 'তাই তো? মানুষ না কুমির, কী? মনে হচ্ছে দুটো এদিকেই আসছে।'
সুরজিৎ এগিয়ে গেল। অবাক চোখে দেখল, দুটো জীব বিলের মাঝখান ছাড়িয়ে এদিকে আসছে। জীব দুটো কি মানুষ? সাঁতার কেটে আসছে? সাঁতার কাটলে কি হাত-পা ছোড়ার দরকার হয় না? কিন্তু সেরকম হাত-পা ছুড়ছে না। জলচরের মতোই জল কেটে এগিয়ে আসছে। তবে মাঝে মাঝে হাত তুলতে দেখা যাচ্ছে। তাদের চারপাশের জলে মৃদু তরঙ্গ। যেন তরল রোদ চলকে উঠছে। মানুষ মাথা আর মুখ দেখলে সন্দেহ থাকে না। সুরজিৎ এরকম ব্যাপার আর কখনো দেখেনি। সে পিছন ফিরে দেখলো ধানুর দুই ছেলে ছাতার নিচের টেবিল থেকে গেলাস তুলছে। একজনকে হাত তুলে ডাকল, 'এই, এদিকে এসো তো।'
ধানুর বড় ছেলে কালো এগিয়ে এলো। সুরজিৎ হাত তুলে বিলের দিকে দেখাল, 'ওগুলো কী?' কালো ভ্রূকুটি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল। বিড়বিড় করে বলল, 'মানুষ নাকি?'
'বুজতি হতিছে। হ্যাঁ, মানুষই তো।'
'কুমির-টুমির নয়?' সুরজিৎ তবু সন্দেহ প্রকাশ করল।
কালো বলল, 'না। এ বিলে দু-একটা মেছো কুমির আছে, লোকে কয়। দেখি নাই কোন দিন। ও দুটো তো মানুষ। একটা মেয়েমানুষ মনে হতিছে।'
ইতিমধ্যে অনেকেই সেখানে ভিড় করেছে। মিসেস সেন লাল মাতাল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কুমির আছে? তবু ওরা ঐ জলে সাঁতার কাটছে?'
'মেছো কুমির, ছোট।' কালো নির্বিকার স্বরে বলল, 'মানুষ খায় কিনা জানি না। কিন্তু কারা?'
চ্যাটার্জি জিজ্ঞেস করল, 'মেয়েমানুষ কী করে বোঝা গেল?'
'মাথার উপরি চুল চুড়ো করি বাঁধা রয়িছে একজনার।' কালো বলল, 'ওটাকে মেয়েমানুষ মনে হতিছে।'
সুরজিৎ বলল, 'আমাদের ঘাটের দিকেই আসছে নাকি? বুজতি পারতিছিনে।' কালো চিন্তিত স্বরে বলল, 'সেই রকমই মনে হতিছে যেন। বাপকে ডাকি।' সে পিছন ফিরে দৌড় দিল।
সুরজিৎ বলল, 'স্ট্রেঞ্জ! এরকম তো কখনো দেখিনি। চওড়ায় প্রায় এক মাইল হবে। অ্যান্ড দ্য লেক ইজ ভেরি ডিপ।'
ধানু ছুটে এলো। সঙ্গে ছোট ছেলে হৃষি। ধানু এক মিনিট চুপ করে দেখল। তার পরে বলল, 'মানুষ তো বটেই। মনে হতিছে ঘাটের দিকেই এগোতিছে। জলে টান ধরিছে, পুবে এখন আধ মাইলের মতন চরা। তা হলিও এই হাওর সাঁতরি কারা আসে? একটা তো মেয়েমানুষই।' কথাটা বলেও সে তেমন বিস্ময় প্রকাশ করল না। বরং অভিমত দিল, 'আমি দেখতিছি। আপনারা খেতি যান, বেলা আড়াইটা বেজে গেছে।'
'বেলা আড়াইটেই হোক আর চারটেই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না।' গুহ বলল, 'ইটজ মোর ইন্টারেস্টিং, কী বলেন মণ্ডল? ব্যাপারটা না দেখে খেতে যাওয়া যায় কেমন করে? তার ওপরে দুটোর একটা নাকি আবার ইয়ে মানে ফিমেল।'
চ্যাটার্জি ঘাটের সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল, 'আর বিয়ার নেই মণ্ডল?'
সুরজিৎ লজ্জায় পড়ে গেল। লাঞ্চের আগে তিরিশ বোতলের বেশি বিয়ার লাগবে না ভেবেছিল। সংকুচিত হেসে বলল, 'বিয়ার স্যার আর নেই। জিন আর ভোদকা আছে।'
'চমৎকার।' সেন বলল, 'ভোদকা হোক একটু। ব্যাপারটা জমিয়ে দেখা যাক।'
মিসেস নন্দী জিজ্ঞেস করল, 'অরেঞ্জ বা টোমাটো জুস আছে?'
'সব আছে। আমি এখনই অ্যারেঞ্জ করে নিয়ে আসছি।' যাবার আগে সে একবার সকলের মুখের দিকে দেখল। কেউ আপত্তি করল না। সে ধানুর দুই ছেলেকে ডেকে নিয়ে গেল।
ঝর্ণাও সুরজিতের পিছনে পিছনে এলো, 'কী ব্যাপার বলো তো? এই বিলে সাঁতার কেটে, সত্যি কেউ আমাদের এখানে আসছে নাকি?'
'সেরকমই তো মনে হচ্ছে।' সুরজিৎ চিন্তিত স্বরে বলল, 'তুমি ওখানে যাও। আমি সব ম্যানেজ করে নিয়ে আসছি।'
ঝর্ণা ফিরে গেল। জলের মূর্তি দুটো ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তারা ডাইনে-বাঁয়ে, কোথাও যাচ্ছে না। সোজা ঘাটের দিকেই আসছে। কেলকার ইংরেজিতে বলল, 'এদের ক্ষমতা আছে। ঠিক কুমিরের মতোই ভেসে আসছে। একটুও জল ছিটোচ্ছে না।'
'তার মধ্যে একজন আবার ফিমেল। ভাবা যায় না।' গুহ বলল, 'এই সুইমিং চ্যাম্পিয়নদের পুরস্কার দেওয়া উচিত।'
ঝর্ণা বলল, 'কিন্তু কেন আসছে?'
'সেসব পরে জানা যাবে।' মিসেস বিশ্বাস বলল, 'আমার দারুণ থ্রিলিং লাগছে!'
সেন বলল, 'সত্যি। অ্যান্ড ওয়ান ইজ ফিমেল। এঙ্াইটিং।'
ধানু সিঁড়ির নিচের ধাপে নেমে গেল। সুরজিৎ ইতিমধ্যে কালো আর হৃষির হাতে ট্রেতে করে দশটি গেলাসে ভোদকার সঙ্গে অরেঞ্জ স্কোয়াস মিশিয়ে নিয়ে এলো। ভোদকার বোতল আর অরেঞ্জ স্কোয়াস, জলের জাগ ছাতার নিচে টেবিলে রেখে এসেছে। কিন্তু মিসেস নন্দী ছাড়া, কোনো মহিলাই আর ভোদকা নিল না। মিস্টাররা সবাই গেলাস তুলে নিয়ে চুমুক দিল। প্রত্যেকের চোখেই একটা তীক্ষ্ন দৃষ্টি আর উত্তেজনা, যেন ছিপের বড়শিতে মাছ গেঁথেছে। এখন খেলিয়ে তুলতে পারলেই হয়।
সুরজিৎ নিচে, ধানুর কাছে নেমে গেল, 'কারা হতে পারে ধানুদা?' 'চিনতি পারতিছি না।' ধানু বলল, 'দুটোকেই জোয়ান মনে হতিছে।'
এই সময়েই, ঝিলের জলে একবার জল ছিটকে উঠল। যেন গলিত রুপোর মতো। আর মেয়ে গলায় খিলখিল হাসি। কয়েকজন অবাক স্বরে উচ্চারণ করল, 'হাই!'
'শী ইজ এ মারমেইড!' নন্দী মাতাল উচ্ছ্বাসে বলে উঠল।
চ্যাটার্জির স্বরে চাপা উত্তেজনা, 'মৎস্যকন্যা কি না জানি না। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, শী ইজ এ ইয়ং ল্যাগ।'
'একজাকটলি।' বিশ্বাস বিস্ময়রুদ্ধস্বরে বলল, 'লক্ষ্য করেছেন, এখনো প্রায় তিরিশ ফুট দূরে, কিন্তু জলের নিচে দুজনের শরীরই প্রায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার বুকে কোন ঢাকা নেই।'
মিসেস বিশ্বাসের বিয়ার পানজনিত লাল চোখ ঢুলুঢুলু। 'তুমি এতোটা দেখতে পাচ্ছ?'
'আমি পাচ্ছি।' মিসেস সেন বলল, 'মারমেইডের মতোই মেয়েটার ওপরের ফিগার। দুর্দান্ত!'
ঝর্ণার স্বরে কেমন একটা ভয়ের সুর 'মেয়েটার হাসি শুনে আমার গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠছিল। ব্যাপারটা মনে হচ্ছে যেন সামথিং সুপার হিউম্যান!'
'অলৌকিক, অ্যাঁ?' গুহ বলল, 'অনেকটা যেন সেই রকমই। একজন স্বর্গের দেবদূত আর একজন পরী। আকাশ থেকে জলে নেমে এসেছে।'
মিসেস কেলকার ভালো বাঙলা বলতে পারে। 'কিন্তু ওদের রঙ কালো।'
'স্যো হোয়াট?' চ্যাটার্জি শূন্যে হাত ছুড়ল, 'স্বর্গের দেবদূত আর পরীরা কি কালো হতে পারে না? তাদের দুধে আলতা রঙ হতে হবে নাকি?'
নন্দী বলে উঠল, 'দেখুন দেখুন, ওদের দুজনকে এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মেয়েটাকে যত কালো ভাবছেন, তা না। আমি যেন নীলচে আশ্চর্য মেয়ের শরীর জলের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। মেয়েটার আর পুরুষটার দুজনের কোমরেই কাপড় জড়ানো।'
'ওরা হাসছে।' মিসেস নন্দী বলল, 'আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, আর কী যেন বলছে। আশ্চর্য, ওদের মাথায় এক ফোঁটা জল নেই। একবারও মাথা জলে ডুবছে না।'
বিশ্বাসের স্বরে মুগ্ধ বিস্ময়, 'মেয়েটা_ওহ্, অসাধারণ। ওর বয়স আঠারোর বেশি হবে না।'
'ছেলেটাও অসাধারণ।' মিসেস নন্দী বলল, 'আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ট্রান্সপারেন্ট জলের মধ্যে, বুকটা কী চওড়া। হাত দুটো পেশল। মাথার চুলগুলো সিংহের কেশরের মতো।'
ঘাটের সিঁড়ির নিচের ধাপে সুরজিৎ আর ধানু। জলের মূর্তি দুটির দূরত্ব এখন প্রায় পনেরো ফুটের মধ্যে। সুরজিৎ ভালো-মন্দ কিছু ভেবে স্থির করতে পারছিল না। সে এখন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে, মেয়েটা ঘাড় আর কপালের সামনে থেকে চুল টেনে মাঝখানে চুড়ো করে বেঁধেছে। সুঠাম দুই হাতে জল কাটছে। জোড়া বেলের মতো ঘনবদ্ধ উদ্ধত বুকে কোনো ঢাকা নেই। বয়স বোধহয় আঠারো কুড়ির বেশি না। পুরুষটি যুবক, জোয়ান। দুজনেরই যেন পাথর কাটা মূর্তি। আবার জিজ্ঞেস করল, 'চিনতে পারছ ধানুদা?'
'অ্যাট্টা সন্দ হতিছে_ছুঁড়িটা সূরযার হীরা ডাকাতের মেয়ে।' ধানুর নিচু স্বর, তীক্ষ্ন চোখ, 'ছোঁড়াটা মনে হতিছে বাগ্দির পো দুলাল।'
বিলের জলে মেয়েটা মুখ থেকে পিচকারির মতো জল ছুড়ে দিল। আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। সেন ভোদকার গেলাস শেষ করে উঠে দাঁড়াল। উত্তেজনায় তার স্বর ফিস্ফিস্ শোনাচ্ছে, 'আমি মেয়েটার শরীর কেঁপে উঠতে দেখলাম।'
'ভোদকা, ভোদকা চাই। চ্যাটার্জি চিৎকার করে উঠল, 'আমার নেশা কেটে যাচ্ছে। আমি কী দেখছি, অ্যাঁ? দুটো আশ্চর্য সুন্দর মূর্তি।'
সুরজিৎ সিঁড়ির নিচে থেকে ওপরে উঠতে উঠতে বলল, 'দিচ্ছি স্যার।' সে ওপরে উঠে কালো আর হৃষিকে বোতল আর জল নিয়ে আসতে হুকুম দিল। মিস্টারদের সকলের গেলাসই শূন্য। হৃষি আর কালো ভোদকার বোতল, অরেঞ্জ স্কোয়াস্ আর জলের জাগ ট্রে-তে করে নিয়ে এলো। সুরজিৎ সকলের গেলাস ভোদকার সঙ্গে জল আর অরেঞ্জ স্কোয়াস্ মিশিয়ে ভরে দিল। সকলেই তখন রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ে জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
মূর্তি দুটো গলা অবধি ডুবিয়ে জলের নিচে সিঁড়িতে পা রেখে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটি কোমরে হাত দিয়ে, জড়ানো ডোরা কাটা শাড়ি খুলে, গায়ে জড়াল। আরশিয়া বিলের আয়নাস্বচ্ছ জলে সবাই স্পষ্ট দেখল, মেয়েটি গোটা শাড়িটা কোমরে জড়িয়ে কাছা এঁটে পরেছিল।
'ইস্, ঢেকে দিল?' বিশ্বাস হতাশা জড়ানো স্বরে বলল।
মিসেস নন্দী হেসে উঠল, 'নেভার মাইন্ড। ভেজা কাপড়েও ভালো দেখা যাবে।'
সুরজিৎ আবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাঁড়াল। মূর্তি দুটি তখন ওপরে উঠে আসছে। মুখে সংশয়ের হাসি। চোখের দৃষ্টিতে দ্বিধা। দুজনেই জল থেকে পুরোপুরি উঠে এলো। নন্দী অবাক স্বরে বলল, 'আমি দেখছি। ওরা মন্দিরের গা থেকে নেমে এলো। খাজুরাহোর মন্দিরের পাথরের সেই মূর্তি।'
'সত্যি, অবিকল যেন তাই।' গুহ বলল, 'ওদের শরীরও যেন সুপার ন্যাচারেল।'
ঝর্ণা বলে উঠল, 'আমার এখনো মনে হচ্ছে, ওরা মানুষ নয়।'
'আহ্, ক্যামেরা থাকলে ফটো নেওয়া যেত।' বিশ্বাস বলল, 'মিসেস নন্দী ঠিক বলেছেন। ভেজা শাড়ি দিয়ে ঐ শরীরের কিছু ঢাকা দেওয়া যায় না। যেন ফুটে বেরোচ্ছে।'
ধানু কিছু জিজ্ঞেস করল। চ্যাটার্জি চিৎকার করে উঠল, 'নো নো, ওখানে কোনো কথা নয়। মণ্ডল, ওদের ওপরে নিয়ে আসুন। আমরা সব শুনব।'
ধানু ওপরের দিকে দেখে, সুরজিতের দিকে তাকাল। সুরজিৎ মাথা ঝাঁকাল। ধানু মেয়ে আর যুবকটিকে কিছু বলল। ওরা ওপরের দিকে মুখ তুলে তাকাল। দুজনের মুখেই বিব্রত সংশয়ের হাসি। ধানু আর সুরজিতের পিছনে পিছনে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলো। গুহ বলল, 'মণ্ডল, ওদের নিয়ে ছাতার তলায় আসুন। আমরা সবাই ওখানে যাচ্ছি।'
'তাই যাচ্ছি স্যার।' সুরজিৎ বলল।
সবাই ছাতার নিচে, চেয়ারে গিয়ে বসল। সুরজিৎ আর ধানুর সঙ্গে, দুজন ওপরে উঠে এলো। রোদে আর বাতাসে, মেয়েটির কাপড় শুকোতে আরম্ভ করেছে। দুজনের পদক্ষেপেই দ্বিধা। কিন্তু লনের ওপর দিয়ে এগিয়ে এলো। আসতে আসতে মেয়েটি তার চুড়ো করা চুল খুলে দিল। শুকনো চুলের গোছা, দু' হাতে টেনে ঘাড়ে পিঠে ছড়িয়ে দিল। কুণ্ঠিত হাসি দুজনের মুখে। দুজনেরই সাদা ঝকঝকে দাঁত। মেয়েটির কালো টানা চোখ। নাক তেমন চোখা না। ঠোঁট দুটি পুষ্ট। আধ শুকনো আধ ভেজা শাড়ির আড়ালে পীনোদ্ধত বুক। ক্ষীণ কটি, পেশল কোমরেও যেন একটা ঔদ্ধত্য। দীর্ঘ ছিপছিপে তার শরীরের গঠন। মাথার চুল খুলে ছড়িয়ে দেবার পরে, সে যেন আরো মোহময়ী হয়ে উঠল। যুবকটিরও চওড়া বুকের পাটা, সিংহের মতোই ক্ষীণ কটি। হাঁটু পর্যন্ত ধুতি। পেশী শক্ত পায়ের গোছা। কেলকার বলে উঠল, 'যুবকটিকে দেখে মনে হচ্ছে, মাইকেল এঞ্জেলোর মূর্তি।'
'ওদের গায়ে কাপড় থাকা উচিত না।' মিসেস নন্দী ইংরেজিতে বলল, 'মানাচ্ছে না।'
নন্দী বলল, 'সময়মতো সব খোলা হবে।'
কেউ কেউ হেসে উঠল। ওরা দুজনেই রঙিন বিশাল ছাতা, চেয়ার-টেবিল, মদের বোতল দেখতে লাগল। দেখল দেবদারু ছায়ায় গদি শয্যা। সুরজিৎ ধানুকে বলল, 'জিজ্ঞেস কর ধানুদা।'
ধানুর মুখ গম্ভীর। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ন। সে জিজ্ঞেস করল, 'কন্ থেকে আসতিছ তোমরা?'
যুবক জবাব দিল, 'সুরষা_ঐ পুবের গেরাম'
'নাম তোমাদের?' ধানু জিজ্ঞেস করল।
যুবক মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, 'এর নাম_।'
'না না, ও নিজেই ওর নাম বলুক। কী নাম তোমার?' গুহ মেয়েটিকে চোখের গ্রাসে নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটির মুখে হাসি লেগেই আছে। লজ্জিত আর কুণ্ঠিত। কিন্তু এতগুলো মাতাল দেখেও, চোখে মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। বলল, 'কল্মি।'
'কল্মি?' নন্দীর শরীর টলে উঠল, 'কল্মি না কম্লি?'
কল্মি যুবকটির দিকে তাকিয়ে, ফিকফিক করে হাসল, 'কম্লি নয়। কল্মি শাক হয় না? সেই কল্মি।'
'বাপের নাম কী?' ধানু জিজ্ঞেস করল।
কল্মির চুল উড়ছে, মুখে এসে পড়ছে। হাত দিয়ে চুল সরিয়ে বলল, 'বাপ মরি হেজি গেচে। নাম ছিল হীরালাল।'
'হুঁ।' ধানু ঘাড় ঝাঁকাল। একবার সুরজিৎকে দেখল, 'সুরষার হীরালাল, দুলু শেখের বিবি খতেজারে নিকে করিছিল, অ্যাঁ?'
কল্মি ঝকঝকে দাঁতে হেসে ঘাড় ঝাঁকাল, 'হ্যাঁ। আমার মা ছিল মোচলমান, বাপ হেঁদু।'
'ওয়ান্ডারফুল।' সেন বলল, 'হোয়াট এ কমবিনেশন। বাবা হিন্দু, মা মুসলমান। তা হলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? তুমি তা হলে কী? হিন্দু না মুসলমান?
কল্মির ঘাড় বেঁকে গেল, চোখের তারায়, ঠোঁটে হাসির ঝলক, 'যা বলেন। আমি না হেঁদুর গরু, না মোচলমানের শোর।' বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল। হেসে উঠল তার সারা যৌবনোদ্ধত শরীর।
হাসি শুনে, মিস্টার-মিসেসরা যেন অলৌকিক বিস্ময়ে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। কারোর মুখে কথা নেই। কল্মির শরীরের দিকে তাকিয়ে তার হাসি শুনতে লাগল। ধানুর মুখ শক্ত হয়ে উঠছে। সুরজিৎ জিজ্ঞেস করল, 'তা হলে তোমার জাত কী?'
'আমার কোনো জাত নাই বাবু। লোকে মোরে বেজাত কয়।' আবার খিলখিল হেসে বাজল। বাতাসে উড়িয়ে নেওয়া আঁচল বুকে চেপে ধরল, 'পীর কেষ্ট কালী সব ঠাকুরের থানে যাই।'
নন্দীর হিক্কা উঠছে। হিক্কা তুলতে তুলতেই বলল, 'সেক্যুলারিজমের একটা নতুন একস্প্লানেশন পাওয়া গেল। অ্যান্ড আই থিংক, মিকস্ড ব্লাড, মেড হার সো বিউটিফুল সেকস্ ডল্। আয়াম ডাইং...।' ভারী চোখের পাতা খুলে সে মিসেসকে দেখবার চেষ্টা করল।
'এবার আর একজনের পরিচয়টা নেওয়া যাক।' মিসেস নন্দীর এমব্রয়ডারি করা সিল্কের আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, 'হি ম্যানের নাম কী? মাইকেলে এঞ্জেলোর আদমের?'
সুরজিৎ যুবকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'তোমার নাম কী?'
'আজ্ঞে মোর নাম যদু।' যুবক হেসে তাকাল কলমির দিকে। তার মাথার জটার মতো পাকানো বড় বড় চুল বাতাসে উড়ছে। মুখে কয়েক দিনের আকাটা গোঁফদাড়ি। পাথরের মতো চওড়া শরীরে এখনো ফোঁটা ফোঁটা জল।
মিসেস সেনের চোখে ঠোঁটে রমণীর আদিম অভিব্যক্তি। যদুর কোমরে জড়ানো ভেজা কাপড়ের দিকে দেখল। তার পরে মুখের দিকে, 'তুমি কী? হিন্দু না মুসলমান?'
'হেঁদু, মোরা বাগ্দি।' যদুর চোখে চিড়িয়াখানা দেখার অবাক কৌতূহল কিন্তু হাসি লেগেই আছে মুখে।
'ভোদকা_মণ্ডল, ভোদকা দিন।' চ্যাটার্জি চেয়ার ছেড়ে উঠে, কলমির কাছে এগিয়ে গেল। যদুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'ও তোমার কে?'
কলমি তাকাল যদুর দিকে। যদু কলমির দিকে। তার পরেই কলমি খিলখিল করে হেসে উঠল। যদুর কালো উজ্জ্বল চোখ আর শাদা দাঁত ঝলকাচ্ছে। বলল, 'বাবু, পীরির থানে কিরে কেটি অরে ঘরে নিয়ি এসিচি। ও মোর বউ।'
'জমদ্কার!' বিশ্বাসের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, 'পীরের থানে দিব্যি গেলে বিয়ে। নো মন্ত্র তন্ত্র, নো ম্যারেজ রেজিস্টরশন। শর্মিলা আই ওয়ান্ট টু টাচ্ হার।' স্ত্রীর নাম ধরে বলল।
কালো আর হৃষি মদ পরিবেশনটা বুঝে গিয়েছে। ওরা গেলাসে ভোদকা অরেঞ্জ স্কোয়াস আর জল মিশিয়ে সকলের হাতে হাতে তুলে দিল। ধানু এই অবকাশে স্বর চড়িয়ে বলল, 'বাবুরো, এ ছুঁড়ির বাপ হীরালাল ডাকাত ছিল।'
'সো হোয়াট?' চ্যাটার্জি গেলাস হাতে টলে উঠল। কলমির গায়ের কাছে ঝুঁকে পড়ল, 'তোমার বাপ ডাকাত ছিল তো আমার বাবার কী? তুমি আমাকে ডাকাত করে নিয়ে যাবে, অ্যাঁ? নেবে? আমি তোমার হাতে লুট হয়ে যেতে চাই।'
কলমির উদ্ধত বুকে হাসির সর্বনাশা ঢেউ। কালো টানা চোখে নিবিড় দৃষ্টি। কিন্তু, যেন লজ্জা পেয়ে গেল। কোনো জবাব দিল না। গুহ, নন্দী, বিশ্বাস, সেন, সব একসঙ্গে, এক আজব মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল, 'আমরাও চাই। কলমির হাতে লুট হতে চাই।'
'কিন্তু কলমির দামে একবার জড়িয়ে গেলে, জলে ডুবে মরতে হবে।' মিসেস নন্দী হেসে বলল, 'তার চেয়ে আমরা যদুর হাতে লুট হয়ে যাই।'
কল্মি খিলখিল করে হেসে উঠল। তাকাল যদুর দিকে। যদুর মুখে নির্বোধ হাসি, চোখে অবাক কৌতূহল। সরল বিশ্বাসে বলল, 'বিশ্বাস যান, আমি লুটতরাজ করি না।' মিসেস নন্দী হি হি করে হেসে উঠল। এবং বাকিরাও। সেনের চোখ কলমির দিকে, বলল, 'হোয়াট এ অনেস্টি।'
চ্যাটার্জি তখন কলমির সামনে গেলাসটা বাড়িয়ে ধরেছে, 'একটু খাবে? একটু তোমার ঠোঁট ছুঁইয়ে দাও না।'
'উম্হ!' কল্মির নাক কুঁচকে উঠল। জোরে মাথা নেড়ে, চুল এলিয়ে দিল, 'মদ খাই না।'
মিসেস কেলকার এগিয়ে এসে চ্যাটার্জির হাত থেকে গেলাস টেনে নিল। যদুর দিকে এগিয়ে দিল, 'তুমি খাও।'
'অই দব্য খাই না।' যদু মাথা নাড়ল।
মিসেস নন্দী যদুর কাছে এগিয়ে গেল, 'তবে কী খাও? গাঁজা ভাঙ্ খাও?'
'দেবে কেডা বলেন।' যদুর মুখের হাসি একটু ম্লান হলো, 'চাড্ডি ভাত জোটে না। জমি জিরেত নাই, জন খেটি খাই। তা এখন ফাগুন মাসে চাষ আবাদ কম। জন-মজুরি মেলে না। পেটে ভাত নাই, নেশার দব্য কে দেবে? নেশায় পেট ভরে না।'
'ভাত না জুটেও এরকম চেহারা?' মিসেস সেন অবাক স্বরে বলল, 'কী করে হয়? আমরা এত খেয়েও চেহারা রাখতে পারিনে।'
চ্যাটার্জি মিসেস কেলকারের হাত থেকে গেলাস টেনে নিয়ে চুমুক দিল, 'ওসব আপনি বুঝবেন না মিসেস সেন। আমরা বেশি খেয়েই মরেছি। ওরা যেটুকু খায়, সবই লেগে যায়। উম্? কী বল কলমি?'
কলমির প্রায় গায়ের কাছে চ্যাটার্জি। কিন্তু কলমির ভয় নেই, এক পা নড়ল না। ফিক ফিক হাসতে লাগল। মিসেস বিশ্বাস বলল, 'মাথার চুল না ভিজিয়ে এতোটা সাঁতরে এলো কী করে? অমানুষিক ব্যাপার?'
'এ হচ্ছে সুপারহিউম্যান পাওয়ার।' গুহ বলল, 'মিস রায় যা বলছিলেন। কিন্তু আমি_।' সে মিসেস কেলকারের দিকে তাকাল। ঠোঁট টিপে হাসল, 'আমার রক্তে আগুন জ্বলছে। মন্দিরের পাথরের মেয়ে মূর্তির ঠাণ্ডা গায়ে হাত বুলিয়েছি। সে এখন জীবন্ত হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা স্বপ্ন না সত্যি, আমি বুঝতে চাই।' সে উঠে দাঁড়াল।
সুরজিৎ ঘড়ি দেখল। বেলা চারটে। সূর্য ঢলে গিয়েছে বিরাট বাড়ি আর গাছের আড়ালে। লনে এখন ছায়া। সে কলমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'তা, তোমরা এখানে এসেছ কেন?'
কলমি তাকাল যদুর দিকে। যদু কলমির দিকে, 'বল্, তুই বল্ বাবুরে।'
'বিলের পাঁকে মাছ ধরতিছিলাম।' কলমি হেসে বলল, 'জলে টান ধরিছে, অল্প জলে জাওলা মাছ থাকে। ত, পাঁক ঘাটতি ঘাটতি, এদিকে নজর পড়েল। এই ছাতাডারে সামেনার মতন চকি প'ল। ভাবেলাম কি, বড় মানুষের বাড়িতি যাগ যগ্যি হতিছে। এরে বললাম, চল, যাই। যগ্যি বাড়িতি কাজ কাম মিলতি পারে। পেট ভরি খাওয়া জুটবে। তাই সাঁতরি চলি অ্যালেম।'
সেন বলে উঠল, 'থিংক, দ্য কজ্ ইজ আনএমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড হাঙ্গার।'
'ফুড, ব্রিঙ্ ফুড মণ্ডল।' গুহ চিৎকার করে উঠল, 'আমাদের খাবার নিয়ে আসুন।'
সুরজিৎ বলল, 'খাবার স্যার ডাইনিং রুমে দেওয়া হয়েছে।'
'নো ডাইনিং রুম।' বিশ্বাস টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল, 'আমরা সব এখানে খাব। কলমি যদুও খাবে। এগ্রি?' সে মাথাটা এদিকে ওদিকে ঘোরাল।
সবাই আওয়াজ দিল, 'এগ্রি।'
ভোদকা। গুহ শূন্য গেলাস তুলে ধরল। চ্যাটার্জির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কলমির দিকে তাকাল। লাল দু চোখ ভরা উদগ্র ক্ষুধা। অনায়াসেই হাত বাড়িয়ে, কলমির চুলের গোছা ধরল।
কলমির পুষ্ট ঠোঁটে, কালো টানা চোখে হাসি। তাকাল যদুর দিকে। যদুর মুখেও হাসি। গুহ ফিস ফিস করে বলল, 'আর ইউ রিয়্যালি হিউম্যান? তুমি সত্যি একটা মেয়ে?'
'তবে কী?' কল্মি হেসে উঠল। তার উদ্ধত বুক যেন উত্তাল হয়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে দিল, 'দ্যাখেন।' অন্য হাতে উড়ে যাওয়া বুকের আঁচল চেপে ধরা।
গুহ কলমির চুল ছেড়ে দিয়ে, তার হাতে আঙুল ছোঁয়াল। তারপর হাত টেনে তুলে ধরল। কলমির জামাহীন কুক্ষিতলে কেশ প্রকাশিত। তৎক্ষণাৎ চ্যাটার্জি কোমর দিয়ে গুহকে ধাক্কা দিল। গুহ টলতে টলতে অনেকটা সরে গেল। হেসে বলল, 'য়ু জেলাস ডগ।'
চ্যাটার্জি কলমির হাত ধরল। মাথা নিচু করে হাতটা চোখের সামনে তুলে ধরল। মুখটা আরো নামিয়ে নিয়ে আসতেই, কলমি পিছনে সরে গেল। চ্যাটার্জির হাত খসে গেল, টলে পড়ে গেল মাটিতে। সবাই মাতাল স্বরে হেসে উঠল।
ইতিমধ্যে নতুন করে ভোদকা ঢালা হয়েছে। টেবিলে খাবার পরিবেশিত। মিসেস নন্দী যদুর হাত ধরে টেবিলের কাছে নিয়ে এলো, 'বসো, এখানে বসে আমাদের সঙ্গে খাও।'
'ক্ষ্যামা দেন, এখানে বসতি পারব না।' যদু আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
চ্যাটার্জি উঠে কলমির হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো। কিন্তু সকলেই টলছে। সকলের মাথাগুলো যেন বাতাসে দুলছে। কলমি যদুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দুজনেরই দৃষ্টি টেবিলে রাখা খাবারের দিকে। পোলাও, মাছ ভাজা, মাছের কালিয়া, মাছের মুড়ো দিয়ে মাখো মাখো মুগের ডাল। চিংড়ি মাছের মালাই কারি। টেবিলে জায়গা কম। প্লেটগুলো গায়ে গায়ে সাজানো।
রসুইকর কাছে দাঁড়িয়ে। তার চোখও কলমির দিকে। সেন বলল, 'আগে ওদের দুজনকে দাও। ওরা আমাদের গেস্ট।'
মিসেস নন্দী প্লেট হাতে তুলে নিল, 'আমি ওদের দিচ্ছি।'
'এই যে মাঠান ওদের জন্যি কলাপাতা নিয়ে এসিচি। ধানু তাড়াতাড়ি দুটো কলাপাতা হাতে এগিয়ে এলো।
বিশ্বাস বলল, 'নো নো, দিস ইজ নট ফেয়ার। ওরাও আমাদের সঙ্গে প্লেটে খাবে। আমরা সাম্যে বিশ্বাস করি।'
'খেতি পারব না, ঐ বাসনে আমরা খেতি পারব না।' কলমি বলল, 'আপনারা আগে খান, আমরা পরে খাব।'
মিসেস নন্দী বলল, 'পরে না, এক সঙ্গেই হবে। তোমাদের আমি কলাপাতাতেই দিচ্ছি।'
ধানু টেবিলে কলাপাতা দুটো রাখল। তার মুখ শক্ত আর গম্ভীর। মিসেস নন্দীর হাতে চামচ কাঁপছে। ফ্রায়েড রাইস তুলতে গিয়ে, টেবিলের বাইরে ছড়িয়ে পড়ল। ঝর্ণা এগিয়ে এলো, 'দিন, আমি দিচ্ছি।'
মিসেস নন্দী চামচ দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে গুহ হঠাৎ দু-হাতে কলমিকে জড়িয়ে ধরল, 'হাই! মাই ড্রিম।'
কলমির সারা গায়ে যেন সুড়সুড়ি লাগল। খিলখিল হেসে, শরীর ঘুরিয়ে একটা ঝাপটা দিল। গুহ পড়ল মাটিতে। আবার একটা হাসির হুল্লোড়। ঝর্ণা দুটো কলাপাতায় প্রচুর খাবার সাজিয়ে দিল। ডেকে বলল, 'নিয়ে যাও।'
কলমি তাকাল যদুর দিকে। যদু বলল, 'নে। নিয়ি আয়।' বলে সে আগে এগিয়ে গেল।
কলমিও গেল। দুজনে দু হাত দিয়ে সাবধানে কলাপাতা তুলে, অনেকটা দূরে গিয়ে বসল। ধানু এসে দাঁড়াল সামনে, 'খাওয়া হয়ি গেলি, হাঁড়ি কড়া হাতা খুন্তি মাজি ধুয়ি দিয়ি যাবা!'
'তা দেব। যত বাসন আছে সব মাজি ধুয়ি দেব।' যদু বলল, 'বাবুরা কি কলকেতা থেকে এসিচেন?'
ধানু কোনো জবাব না দিয়ে চলে গেল। কলমি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। নিচু করে বলল, 'গোলামের দেমাক বেশি হয়।'
'আ। খাবারের কী বাগ।' যদু থাবা ভরে ভাজা ভাত মুখে তুলল।
টেবিলে তখন খাবার ছড়াছড়ির র‌্যালা হচ্ছে। কোনো রকমে সামান্য খাবার মুখে পুরছে। মুখ থেকে, প্লেট থেকে খাবার গড়িয়ে পড়ছে। জামাকাপড়ে মাছের কালিয়ার, মালাইকারির রস গড়িয়ে পড়ছে। সুরজিৎ আর ঝর্ণাই একমাত্র সুস্থ আছে। মিসেসদের অবস্থাও কাহিল। ছুরি, কাঁটা চামচ কারোর হাতে নেই। এঁটো হাতেই, যা পারছে তুলে নিচ্ছে। সবাই কলমি আর যদুকে দেখছে। মিসেস কেলকার উঠে গেল ওদের কাছে। দেখল, মাছ ওরা ছোঁয়নি। এক পাশে জড়ো করে রেখেছে। কিন্তু ভাত একটুও নেই। মিসেস কেলকার জিজ্ঞেস করল, 'তোমাদের ভাত চাই না আর?'
কলমি আর যদু মুখোমুখি তাকিয়ে হাসল। যদু বলল, 'তা, এ হলো গে দেবতার ভোগ। ভাত আর চাড্ডি পেলি হতো।'
'দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি।' মিসেস কেলকার ফিরতে উদ্যত হলো। কলমি উঠে দাঁড়াল, 'বলেন, আমি নিয়ে আসি।' সে মিসেস কেলকারের পিছনে পিছনে গেল।
কলমিকে সামনে দেখেই সেনের হাত থেকে প্লেট পড়ে গেল। মিস্টাররা সব ডেকে উঠল, 'কলমি এসো, কলমি এসো।'
কেউ কেউ এগিয়ে আসতে গিয়ে টলে পড়ে গেল। কলমি হাসতে হাসতে মিসেস কেলকারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ঝর্ণা বলল, 'ভাত চাই বোধহয়? কিসে করে নেবে?'
'এতে করি নেব।' বলে বুক যথাসম্ভব ঢেকে, আঁচল পেতে দিল।
মাতাল মিস্টারদের খাবার পড়ে থাকছে। অথচ সকলের চোখেই ক্ষুধা। এ ক্ষুধাও আদিম। ক্ষুধার্ত চোখে তারা কলমির সর্বাঙ্গ লেহন করতে লাগল। ঝর্ণা চামচে করে ফ্রায়েড রাইস তুলে দিতে লাগল কলমির আঁচলে।
'এক চিমটি ফ্যাট নেই মেয়েটার শরীরে।' মিসেস সেনের গালে খাবারের দাগ, কথা ঈষৎ জড়ানো, 'বুক আর কোমর দুটো যেন এক মাপের।'
মিসেস বিশ্বাস বলল, 'যদু সিংহের মতো। সত্যিকারের হি ম্যান। ওকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া যায় না?'
'তাহলে দুজনকেই নিয়ে যেতে হয়।' নন্দী বলল, 'তার চেয়ে যার যা সাধ এখানেই মিটিয়ে নেওয়া ভালো।'
চ্যাটার্জি গোঙানো স্বরে বলল, 'আমি আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের এ রকম ফিগার দেখিনি, সোয়ার অন গড। আই ওয়ান্ট হার।'
'উই অল ওয়ান্ট হার। ওয়ান্ট টু ইট হার অল ফ্লেশ অ্যান্ড বোনস।' গুহও অনেকটা চ্যাটার্জির মতো বলল।
ঝর্ণা অনেকটা ফ্রায়েড রাইস কলমির আঁচল ভরে দিল। কিন্তু কলমি না বলল না। ঝর্ণাকেই থামতে হলো। কলমির মুখে হাসি। সবাইকে দেখে যদুর কাছে চলে গেল।
'লুক, হোয়াট এ রিদম্ অফ হার মুভিং।' নন্দী বলল।
'প্রাউড।' মিসেস বিশ্বাস বলল।
বিশ্বাস বলল, 'না না, প্রাউড নয়। ওটাই ওর ন্যাচারেল চলার ভঙ্গি।'
মিসেস বিশ্বাস প্লেট থেকে খাবার ছুড়ে মারল বিশ্বাসের মুখে। 'অন্য মেয়েকে সব পুরুষই ও রকম দ্যাখে।'
'আর সব মেয়েরাই যদুর মতো পুরুষকে চায়।' বিশ্বাস গাল কপাল নাক থেকে খাবার মুছল।
মিসেস বিশ্বাস ঝেঁজে উঠল, 'চাইবেই তো। তোমাদের কী ক্ষমতা আছে? তুমি কি একটা পুরুষ? মেয়েটার সঙ্গে পারবে তুমি?'
বিশ্বাসের মাথাটা বুকের কাছে লটকে পড়ল। কোনো জবাব দিল না। গুহ আর চ্যাটার্জি প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, 'আমি পারব।'
বিশ্বাস দম্পতি ছাড়া সবাই হেসে উঠল। কালো আর হৃষি সবাইকে হাতে জল দিল। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছল। কেউ বসতে পারছে না। কিন্তু নড়তেও চাইছে না। কলমি আর যদুর খাওয়া দেখছে। অথচ ওদের দেখাচ্ছিল, দুটো হতভাগ্য ক্ষুধার্ত রমণী পুরুষের মতো। নিতান্ত ক্ষীণজীবী রোগা না। বরং প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিকারবঞ্চিত দুই নরনারীর মতো।
'এবার স্যার আপনারা সবাই একটু বিশ্রাম করে নিলে পারতেন।'
সুরজিৎ বলল, 'পাঁচটা বেজে গেছে, সন্ধে হয়ে এলো।'
নন্দী বলল, 'আমরা তো বিশ্রামই করছি। ভোদকা বা জিন আর নেই?'
'আছে।'
'দিন। ওরা, ঐ কলমি কি এখন চলে যাবে?' চ্যাটার্জি জিজ্ঞেস করল।
সুরজিৎ বলল, 'না। ওরা এখন কাজ করবে।'
'ওদের ধরে রাখা যায় না, আজ রাত্তিরটা?' গুহ জিজ্ঞেস করল।
সুরজিৎ হাসল, 'ধানুকে বলে দেখব।'
'বলে দেখুন। তবে একলা কলমিকে না, যদুকেও।' মিসেস কেলকার সুরজিতের দিকে তাকিয়ে হেসে চোখ টিপল।
একমাত্র মি. কেলকার প্রচুর মদ পান করে, টেবিলে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। কলমির বিষয়ে একটা কথাও বলেনি। গুহ বলল মিসেস কেলকারকে, 'ইয়েস, য়ু ক্যান স্লিপ উইথ হিম। আই হ্যাভ নো অবজেকশন।'
'কে আপনার অবজেকশনের তোয়াক্কা করে?' মিসেস কেলকার ঝেঁজে উঠল। তার ফর্সা মুখ আর চোখ এমনিতেই মদের ছটায় লাল হয়ে ছিল। আরো লাল হয়ে উঠল, 'আমার যার সঙ্গে খুশি শোব, তাতে কারোর কিছু বলার নেই। একসেপ্ট মাই হাজব্যান্ড।'
গুহ মিসেস কেলকারের সঙ্গলাভের জন্যই স্ত্রীকে এড়িয়ে এসেছে। কিন্তু কলমি সেই আশায় ছাই দিয়ে, আরশিয়া বিল থেকে উঠে এসেছে। গুহ খিক্ খিক্ করে হাসল, 'ইয়েস, একসেপ্ট য়োর হাজব্যান্ড।'
'অল ডগস। ভাদ্র মাসের কুত্তা।' মিসেস বিশ্বাসের স্বরে জ্বালা।
মিসেস সেন হেসে কুটোপাটি। আসলে মাতাল, 'অ্যান্ড উই দ্য উওমেন-অল বিচেস।' বিশ্বাস হাততালি দিয়ে উঠল, 'দারুণ বলেছেন ম্যাডাম। উই অল ডগস অ্যান্ড বিচেস। আর ঐ যা বললেন, কী মাসের যেন? কুত্তা।' লটকে পড়া ঘাড়ে হাসতে লাগল।
'আমরা সব ডগস অ্যান্ড বিচেস। ওনলি হিউম্যান হলো কলমি আর যদু।' মিসেস নন্দী বলল।
ঝর্ণা ধানুর বউকে টেবিল সাফ করতে সাহায্য করছিল। বলল, 'শুধু হিউম্যান নয়, সুপারহিউম্যান।'
হৃষি স্কোয়াস আর জল মিশিয়ে সকলের হাতে ভোদকার গেলাস তুলে দিল। সকলেই তাকিয়েছিল কলমি আর যদুর দিকে। ওদের খাওয়া শেষ। কলাপাতা গুটিয়ে নিয়ে দুজনেই উঠল। চলে গেল ঘাটের দিকে। চ্যাটার্জি উঠে দাঁড়াল। সতর্ক উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, 'ওরা চলে যাচ্ছে।'
'না, ওরা যাচ্ছে না। সুরজিৎ বলল, 'ওরা ঘাটে যাচ্ছে মুখ ধুতে। এখুনি ফিরে আসবে।'
গুহ উঠে দাঁড়াল। বিশ্বাস নন্দীও উঠে দাঁড়াল। চ্যাটার্জি গেলাস হাতে ঘাটের দিকে গেল। কলমি আর যদু ঘাট থেকে উঠে এলো। গুহ বিশ্বাস নন্দী আর সেন লনের মাঝখানে। সকলের হাতেই গেলাস। কলমি হাসছে। যদুও হাসছে। কলমি যদুর মাথায় মাথায়। দুজনের মুখে পেট ভরা সুখাদ্যের তৃপ্তি। কলমির চুল উড়ছে। শাড়ির আঁচল টেনে গাছকোমর করে বেঁধেছে। ফলে, কোমর আর বুক যেন আরো উদ্ধত হয়ে উঠেছে। চ্যাটার্জি কলমির কাঁধে হাত দেবার চেষ্টা করল। তার আগেই কলমি এগিয়ে গিয়েছে। চ্যাটার্জি টাল সামলাল। গুহ নন্দী বিশ্বাস সেন লনের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। কলমি আর যদু চোখাচোখি করে হাসল। গুহদের দলটা এগিয়ে এলো। গুহই প্রথম কলমির একটা হাত টেনে ধরল, 'ভালো করে খেয়েছ?'
'হ্যাঁ, জীবনে এত ভাল খেতি পাইনি।' কলমি হাসতে হাসতে বলল।
বিশ্বাস শিকড় ছিন্ন গাছের মতো টলছে, 'আরো খাওয়াব। যত্ন করে, হ্যাঁ।' কিন্তু কলমির কাছে এগোতে পারছে না।
সেন আর নন্দী কলমির গা ঘেঁষে এলো। গুহর হাত কলমির কাঁধে উঠল। যদুর মুখে নির্বোধ হাসি, কিন্তু চোখের দৃষ্টি সজাগ সন্ধিগ্ধ। গুহ কলমির মুখের দিকে তাকাল, 'কী মুখ। একেই কালো হরিণ চোখ বলে। কী দিয়ে তুমি তৈরি, অ্যা? তোমার এই শরীর?' সে কলমির বুকের দিকে তাকাল।
'হার বডি ইজ আনওয়ার্ল্ডলি।' সেন বলল, 'মন্দিরের গা থেকে নেমে এসেছে।'
গুহ কলমির মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ল। কলমি হাসতে হাসতে মাথা কাত করে শরীর ঘুরিয়ে পিছনে সরে গেল। গুহ হাত বাড়িয়ে ধরতে পারল না।
ধানু এগিয়ে এলো, 'এদিকি_এই যে_এদিকি এসো।'
কলমি আর যদু ধানুর দিকে এগিয়ে গেল। ধানু ইশারা করে, বাড়ির ভিতরে ডাকল। কালো রসুইকর আর তার সাহায্যকারী, কয়েকটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি কড়া খুন্তি হাতা ডাইনিং রুমে রেখেছিল। কলমি আর যদু সেগুলো দেখল। ধানু শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, 'সত্যি করে বলো দিকিনি, তোমাদের মতলবডা কী? এই হাওর সাঁতরি, দুটিতি কী মতলবে এসিছ?'
কলমি হেসে উঠল। রসুইকর আর তার সাহায্যকারীর চোখ খাবলার মতো কলমির দিকে তাকিয়েছিল। কলমি বলল, 'বিশ্বাস যান, মিছা কথা বলি নাই। কদিন যাবত কাজকাম নাই। দুদিন খেতি জোটেনি। দূর থেকে যগ্যি বাড়ি মনে হয়েল, ত ভাবলেম কাজকাম পেলি খাওয়া জুটতি পারে।'
যদু হেসে মাথা ঝাঁকাল। তুলে নিল হাঁড়ি কড়া। কালো কলমির দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। ধানুর চোখ পড়ল তার দিকে। কলমি কালোর দিকে তাকিয়ে হাসল। কালো ঢোক গিলল। ধানু কালোর গায়ে জোরে একটা ধাক্কা মারল, 'হারামজাদা, কী দেখতিছিস তুই, আঁ? ও হীরা ডাকাতের বেটি, খতেজার পেটি জন্মিছে, জানিস? বাবুগের মতন ভ্যাড়া হতি চাও তুমি। ছুঁড়ি গুম জানে। মরতি চাস্?'
কালো অনেকটা দূরে, টেবিল ধরে সামলে নিয়েছে। কলমি খিলখিল করে হেসে উঠল। রান্নার বাকি বাসন নিয়ে বেরিয়ে গেল। ধানু দাঁতে দাঁত পিষে বলল, 'খানকি।'
বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পুবে, বিলের ওপারে দূর আকাশে দ্বাদশীর চাঁদের মুখ উঁকি দিয়েছে। মিস্টাররা দেবদারু বীথি তলে, গদি শয্যায় এলোমেলো এলিয়ে বসে আছে। কলমি আর যদুকে দেখছে। মিসেসরা লনের চারদিকে ছড়িয়ে বসেছে। সকলেই প্রায় আধশোয়া। কলমি আর যদুকে দেখছে। সুরজিৎ আর ঝর্ণা একটু আলাদা বসেছে। সুরজিৎ বলছিল, 'খাবার দাবার সব নষ্ট। যে পরিমাণে সবাই মদ খাচ্ছে, রাত্রে আর কেউ খেতে পারবে না।'
'তোমার মনে হয় না, সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন ভুতুড়ে?' ঝর্ণা বলল, 'বলতে গেলে সমুদ্র সাঁতরে ওরা এসেছে। কোনো মেয়ে ও-রকম আসতে পারে?'
সুরজিৎ সিগারেটে টান দিয়ে বলল, 'তা পারে। ওদের অভ্যেস আছে। কিন্তু রাত্রে কী করব, কিছু বুঝতে পারছিনে। সবাই মেয়েটাকে চায়।'
'তাতে তোমার কাজ হাসিল হবে?' ঝর্ণা জিজ্ঞেস করল।
সুরজিৎ বলল, 'তা হবে। কিন্তু মেয়েটাকে আটকাব কী করে?'
'কেন, ওরা যাবে কোথায়?' ঝর্ণার স্বরে বিস্ময়, 'রাত তো হয়েই এলো।'
সুরজিৎ চিন্তিত স্বরে আওয়াজ করল, 'হুম্।'
পুব আকাশের কোণ থেকে দ্বাদশীর চাঁদ ওপরে উঠে আসছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ছড়িয়ে পড়বার আগেই, ফিকে জ্যোৎস্নার আলো ফুটছে। আরশিয়া বিল থেকে বাতাস উঠে আসছে। বাগানের গাছে কোকিল ডাকছে।
কলমি আর যদু ঘাটের ওপর উঠে এলো। ওদের পিছনে চাঁদ। দুজনের হাতে মাথায় হাঁড়ি কড়া চাঁদের আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে। বিলের জলে বাতাস ঝাঁপানো ঢেউ। জ্যোৎস্নায় তরল সোনা দুলছে। ওরা বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
দেবদারুতলার গদি শয্যা থেকে মিস্টাররা সবাই টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এলো লনের দিকে। মিসেস নন্দী আর মিসেস কেলকার উঠে বাড়ির দিকে গেল। বাড়ির ভিতরে আলো জ্বলছে। কলমি আর যদু ডাইনিং রুমে ঢুকে মাজা হাঁড়ি কড়া খুন্তি হাতা সব রাখল। মিসেস নন্দী আর মিসেস কেলকার ঘরে ঢুকল। ধানু আর রসুইকর সামনে দাঁড়িয়েছিল। ধানু বাসনপত্র গুনে দেখছিল। মিসেস নন্দী কলমি আর যদুকে ডাকল, 'এসো, ও ঘরে বসবে এসো।' হলঘরের দিকে দেখাল।
কলমি তখন কপাল আর ঘাড় থেকে চুল টেনে, মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধছিল। ওর কোমরে একটা পাটের শক্ত সরু দড়ি ছিল। চুল মাথার মাঝখানে তুলে, সেই দড়ি দিয়ে কষে বাঁধছিল। মিসেসদের কথা শুনে, দুজনে দুজনের দিকে তাকাল। দুজনের মুখেই হাসি। মিসেস নন্দী এগিয়ে এসে যদুর চওড়া শক্ত হাত ধরল। টেনে নিয়ে গেল হলঘরের দিকে। মিসেস কেলকার পাশে, যদুর গায়ে গা ঠেকিয়ে চলেছে। কলমি পিছনে পিছনে গেল।
মিস্টাররা এসে হলঘরে ঢুকল। মিসেস নন্দী যদুর হাতটা টেনে নিজের বুকে চেপে ধরল। কলমি অবাক চোখে হলঘরের সাজ দেখছিল। গুহ তার কাছে এগিয়ে গেল। কলমি কালো টানা চোখে তাকাল। ঠোঁটে চোখে নির্ভয়ের হাসি। হঠাৎ হলঘরের আলো নিভে গেল। গুহ কলমিকে দু হাত জাপটে ধরল। কিন্তু কলমি যেন সাপের মতো পিছলে বেরিয়ে গেল। ওর খিলখিল হাসি শোনা গেল। যদুর হাসি আর কথা শোনা গেল, 'কী করতিছেন? ছাড়ি দেন মোরে।'
কলমি আবার কারোর আলিঙ্গনে ধরা পড়ল। ওর গালে গরম ঠোঁট চেপে ধরল। গোঙানো স্বর শোনা গেল, 'তোমাকে_তুমি যা চাও দেব। এই নাও।' কলমি হাতে একটা নরম চৌকো জিনিস অনুভব করল। কিন্তু তখন ওর বুকে হাত উঠে এসেছে। শিথিল অশক্ত হাত। কলমি একটু সরে যেতেই ধপাস করে পায়ের কাছে লোকটা পড়ে গেল। ও হাতের নরম চৌকো জিনিসটা ফেলে দিল। হলের বড় বড় দরজা-জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে।
কলমি যদুকে দেখবার চেষ্টা করল। দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আবার দুজন এসে ওকে দুদিক থেকে জাপটে ধরল। অথচ ধরার মধ্যে কোনো শক্তি নেই। অশক্ত মাতালের হাত। কলমির সারা গায়ে হাত্ড়ে ফিরছে। কলমি হাসছে, 'কী চান বাবুরা, খাড়া থাকতি পারতিচেন না। কী করবেন?'
হলের একদিক থেকে যদুরও হাসি চলকানো স্বর শোনা গেল, 'শরীলটা আমার ইটপাথরের না, খামচাতিছেন কেন? ছাড়েন, যেতি দেন।'
চ্যাটার্জির গোঙানির স্বর শোনা গেল, 'এ বোধহয় পাথরেরই, আমি কিছু করতে পারছি না।'
কলমি খিলখিল হেসে উঠল। হলঘরে তার প্রতিধ্বনি বাজল। গুহ কলমির পায়ের কাছে পড়ে গেল। কলমি তার পা মাড়িয়ে দরজার দিকে গেল। কোনো মিস্টারের গলা শোনা গেল, 'আমার ভয় করছে। ওকে হাসতে বারণ কর।'
কলমি আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। আবার একজন ওর গায়ের ওপর এসে পড়ল। সারা গায়ে হাতড়াতে লাগল। কলমি দরজার দিকে যেতে যেতে হাসতে লাগল, 'ঘুমাতি যান বাবুরা। আপনাদের কষ্ট হতিচে।'
মিস্টার পড়ে গেল মেঝের ওপর। ছড়িয়ে পড়ল অনেকগুলো কাগজ। আসলে টাকার নোট। কলমি দরজার দিকে যেতে যেতে ডাক দিল, 'আমি ঘাটে গেলাম।'
হলের ভিতরে অদ্ভুত হাঁসফাঁস, গোঙানো শব্দ। যদু দরজার কাছে এসে পড়ল। তার কোমরের কাপড়টা অর্ধেক খুলে লুটোচ্ছে। সেটা টেনে সে কোমরে গুঁজল, 'এদের দানোয় ধরিচে।'
কলমি লনের মাঝখানে। সে তার বুকের কাপড় খুলে, কোমরে জড়াচ্ছে। জ্যোৎস্নায় তার চুল, মুখের সামান্য অংশ আর পূর্ণ বুক দৃশ্যমান। যেন চাঁদের অবাক মুগ্ধ চোখ তার সারা গায়ে। যদুকে দেখে বলে উঠল, 'এসিছ। এস।'
দুজনে ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল। পিছনে পিছনে ছুটে এলো মিস্টারের দল। গুহ যেন আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠল, 'কোথায় যাচ্ছ তোমরা? কোথায় যাচ্ছ?' সুরজিৎ আর ঝর্ণা দেবদারু গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিল। ঝর্ণা শঙ্কিত ফিসফিস স্বরে বলল, 'ওরা আবার বিলে নেমে যাচ্ছে? ওরা কখনো মানুষ হতে পারে না।'
মিস্টাররা সবাই টলতে টলতে ঘাটের ওপরে দাঁড়াল। কলমি তখন ঘাটের নিচের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে, শাড়ি তুলে, পুরুষের মতো কাছা দিয়ে গুঁজছে। চ্যাটার্জি ডাকল, 'কলমি।'
কলমির খিলখিল হাসি ভেসে এলো। ছড়িয়ে পড়ল জ্যোৎস্নার আলো-আঁধারি বাগানে। বিলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে। কলমি আর যদু জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তরল সোনা ছিটকে উঠল।
'ইম্পসিবল।' সেন জড়ানো স্বরে বলল, 'এরা কখনোই হিউম্যান হতে পারে না।'
গুহ বলল, 'ওরা আবার মন্দিরের গায়ে ফিরে যাচ্ছে।'
সকলেই মোহাচ্ছন্ন চোখে, এক অলৌকিক দৃশ্য দেখতে লাগল। বিলের জলে জ্যোৎস্নায় মৃদু ঢেউ তুলে দুটি মূর্তি দূরে ভেসে যাচ্ছে।

কলমি আর যদু মন্থরগতিতে, জল কেটে ভেসে চলেছে। যদু জিজ্ঞেস করল, 'কলমি, তোরে বাবুরা কষ্ট দিয়েচে?'
কলমির এক হাত যদুর পিঠে স্পর্শ করল। হেসে বলল, 'কষ্ট কী দেবে? বাবুগুলান দেখতি পুরুষ, গতরে তাগদ নেই। বাচ্ছা ছাওয়ালের মতন খালি আমার গতর হাতরি মরিছে।'
যদু হাসল, 'আর বিবি দুডা মোরে খামচি কেটি মারিছে। কাপড় খুলি নিতি চেয়েছিল। সব বুড়ি। খোলা বুকগুলান চেতল মাছের পেটির মতন। ওনাদের গায়ের গন্ধ আমার ভালো লাগে না। কিসির গন্ধ ওডা?'
'বিলিতি আতর।' কলমি খিলখিল হেসে উঠল, 'কেন, ও গন্ধ তোমার ভালো লাগেনি?' যদু মুখ থেকে জল ছিটকে দিল, 'না। ও গন্ধে আমার গা গুলায়। কিন্তুন বড় ভালো খেয়েছিরে কলমি। জীবনে এমন স্বাদের খাবার খাইনি।'
কলমি বললো, 'হ্যাঁ। সেই পরশু ভোরে চাড্ডি পান্তা জুটেছিল। অ্যালাম, তাই জুটলু।'
'কিন্তুন পরশুকার পান্তা আমি একলা খেয়িছি, তুই খাসনি।' যদু অনায়াসে ভাসতে ভাসতে কলমির পিঠে হাত দিল।
কলমি বলল, 'এখন আর দুদিন না খেলিও কষ্ট হবিনে।'
জ্যোৎস্নালোকিত দিগ্বিসারি আরশিয়া বিল। বাতাসে ঢেউ খেলছে। দুজনে নিঃশব্দে, জলের জ্যোৎস্নাকে ছড়িয়ে দিয়ে ভেসে চলেছে।
'বিবিরা মোরে টাকা দিতি চেয়েছিল।' যদু হাসল।
কলমি বলল, 'মোরেও দিয়িছিল। ছুঁইনি। বাবুরা মোরে কসবী ভেবেল।'
'ত, বিবিরা মোরে কী ভেবেল রে কলমি?' যদুর স্বরে বিস্ময়।
কলমি খিলখিল হেসে উঠল। জ্যোৎস্নালোকিত স্তব্ধ বিল শিউরে উঠল। বলল, 'খোদার ষাঁড়।'
যদু হেসে উঠল, 'ভগবান যে কত কী ছিষ্টি করিছে। ভালো ভালো ভাত ব্যঞ্জন, টাকা কত কি ওনাদের আছে। অথচ দেখলি মনে হয় মানুষগুলান দানোয় পাওয়া ব্যামোয় ভুগতিছে।'
'কী সোন্দর ভাত রেঁধিছিল, এখনো আমার নাকে বাস লেগি আছে।' কলমি বলল, 'পেলি আরো খেতাম?'
যদু বলল, 'আমিও খেতাম।'
দুজনেই কথা বন্ধ করে, নিঃশব্দে জল কেটে ভেসে চলল। জ্যোৎস্না ক্রমে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। আরশিয়ার আয়না বিলের জলের তলায়, দুজনের শরীর দেখা যায়। দেখবার কেউ নেই, একমাত্র অবাক মুগ্ধ চাঁদ ছাড়া।
'নোয়াজান মিয়ার জমিতি পরশু থেকে মুসুর কাটার কথা। কাজটা দেবে ত?' যদু যেন নিজেকেই এই অনিশ্চিত প্রশ্ন করল।
কলমি কোনো জবাব দিল না। তার দৃষ্টি পুবের দূরে, নলখাগড়ার বনের দিকে। গত শ্রীপঞ্চমীর আগের দিন, অনেক নলখাগড়া কেটে নিয়ে বাজারে বিক্রি করেছিল। খাগের কলম বানিয়ে, দুধে ডুবিয়ে বাবুদের ছেলেমেয়েরা সরস্বতীর নাম লেখে বেলপাতায়।
অনেকক্ষণ পরে কলমি গুনগুনিয়ে উঠল :
'বাপ গিয়েল মাঠে
মা গিয়েল বাজারে।
বিষ্টি ঝরঝর
ঘর পড় পড়
কে নেবে মোরে।
এসি কে নেবে মোরে।'
যদুও তার মোটা স্বরে গুনগুন করল, 'কে নেবে মোরে/এসি কে নেবে মোরে।...'
জ্যোৎস্না উত্তাল আরশিয়া বিলের দূরান্তে সেই সুরেলা জিজ্ঞাসা ভাসতে ভাসতে চলে যায়, 'কে নেবে মোরে। কে নেবে...।'

No comments

Powered by Blogger.