আস্থায় প্রত্যাশায় ওবামা by সফেদ ফরাজী

দুটি মঞ্চ প্রস্তুত। একটি শিকাগোতে, অন্যটি বোস্টনে। দুই মঞ্চের সামনেই লাখো মানুষের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। কারো বা চোখ টেলিভিশনের বড় পর্দায়। কারো বা কান মোবাইল ফোনে। দুই মঞ্চের দুই মূল চরিত্র তখনো পর্দার আড়ালে। তাঁরাও উৎকণ্ঠিত, স্নায়ুচাপে। কী হয়, কী হয়! দুই পক্ষেই খাতা-কলম নিয়ে চলছে হিসাব।


সঙ্গে গান-বাজনাও। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের সময় সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসতে থাকে ভোটের ফল। এক পক্ষ জয়ের বার্তায় আনন্দে লাফিয়ে ওঠে তো অন্য পক্ষ হয় তটস্থ। এভাবেই চলতে থাকে বেশ কিছু সময়। একপর্যায়ে 'ভাগ্যনির্ণায়ক ২৭০'-এর সীমা ছুঁয়েই এক পক্ষে শুরু হয় বাঁধভাঙা জয়ের উল্লাস, অন্য পক্ষে অশ্রু ও নীরবতা।
জয়ের এই নায়কের নাম বারাক ওবামা। মঙ্গলবারের টানটান উত্তেজনাকর নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন এই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী। জনতার রায় ও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের হিসাবে তিনি হারিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী মিট রমনিকে। মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফলে ওবামা পেয়েছেন ৩০৩টি আর রমনি ২০৬টি। এই হিসাবে ফ্লোরিডাসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের ফল তখনো হাতে না পৌঁছালেও প্রাপ্ত ভোটে ওবামার জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে প্রয়োজন হয় ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট। ৫০টি অঙ্গরাজ্যসহ ওয়াশিংটন ডিসিতে জনতা ভোট দেয় মঙ্গলবার। গতকাল বুধবার রাত ৮টা পর্যন্ত প্রাপ্ত পপুলার বা জনতার ভোটের ফলাফলে ওবামা পেয়েছেন ছয় কোটি ৫৯ হাজার ৩১৩ ভোট, যা গড় হিসাবে ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে রমনি পেয়েছেন পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ ৭৭ হাজার ৭৫৯ ভোট, যা গড় হিসাবে ৪৮ শতাংশ।
জয় নিশ্চিত হওয়ার পরপরই ওবামা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে লেখেন, 'আরো চার বছর। কেবল ভাগ্যের জোরে এ বিজয় নয়, নয় কোনো দুর্ঘটনাও। আপনারাই হলেন এ জয়ের নায়ক।'
এর কিছুক্ষণ পরই ওবামা শিকাগোতে তাঁর নির্বাচনী সদর দপ্তরের সেই মঞ্চে হাজির হন উল্লাসে উন্মত্ত সমর্থকদের সামনে। এ সময় মুহুর্মুহু করতালি ও জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয় গোটা এলাকা। ওবামার সঙ্গে মঞ্চে আসেন তাঁর স্ত্রী মিশেল ওবামা, দুই মেয়ে শাসা ও মালিয়া। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমর্থকদের উল্লাসে সাড়া দিয়ে উজ্জীবিত কণ্ঠে তিনি বলেন, 'থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। আমরা একটি আমেরিকান পরিবার। এই পরিবার একসঙ্গে উঠে দাঁড়াতে পারে। যেকোনো বিপর্যয়েও একসঙ্গে থাকে।'
ওবামা আরো বলেন, 'আমাদের এ ঐক্যকে আরো সুসংহত করার কাজ আরো সামনে এগিয়ে গেল আজ রাতে।' নির্বাচনে অক্লান্ত পরিশ্রম করার জন্য সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। দেশের জন্য সেরাটা দেওয়া এখনো বাকি বলেও জানান ওবামা।
ওদিকে পরাজয় মেনে নিয়ে গতকালই ওবামাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মিট রমনি। ওবামার বিজয় নিশ্চিত হয়েই তিনি প্রথমে তাঁকে ফোনে শুভেচ্ছা জানান। পরে বোস্টনের সেই মঞ্চে নিজের সমর্থকদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময়ও ওবামা ও তাঁর স্ত্রী মিশেল ওবামাকে অভিনন্দন জানান রমনি। ওবামা দেশের জন্য আরো বেশি কাজ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এ সময় তাঁর সঙ্গে স্ত্রী অ্যান রমনি ও পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
জয়ী হওয়ার খবরে ওবামাকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারাও। এর মধ্যে রয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, চীনের প্রেসিডেন্ট হু চিনথাও, মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা প্রমুখ। এদিকে ওবামার জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।
ভোটের ফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান রাজ্যগুলো। দোদুল্যমান হিসেবে পরিচিত ৯টি রাজ্যের সাতটিতেই জয় পেয়েছেন ওবামা। ওহাইয়ো, উইসকনসিন, ভার্জিনিয়া, আইওয়া, নিউ হ্যাম্পশায়ার কলোরাডো ও নেভাডায় জয়ী হয়েছেন ওবামা। অন্যদিকে রমনি জয় পেয়েছেন কেবল নর্থ ক্যারোলাইনায়। গতকাল পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়নি ফ্লোরিডার ফল। ফ্লোরিডায় ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে ২৯টি। ওহাইয়োতে সামান্য কিছু ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে জয় পান ওবামা। এ রাজ্যের দিকে দুই প্রার্থীরই একটু বেশি নজর ছিল। কারণ এ রাজ্যে জয় না পেলে রিপাবলিকানরা প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। এ রাজ্যের জয়কে 'সৌভাগ্যের প্রতীক' হিসেবেই দেখা হয়।
ভোটের আগের বিভিন্ন জনমত জরিপে দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলেছিল। কিন্তু বাস্তবে ইলেকটোরাল ভোটে রমনিকে অনেক পেছনে ফেলে জয়ী হয়েছেন ওবামা। নির্বাচনে পেনসিলভানিয়া থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত কয়েকটি রাজ্যে ভোটার পরিচয়পত্র, ব্যালট পেপারসহ ভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে প্রেসিডেন্টের ভোটের সঙ্গে হওয়া সিনেটের নির্বাচনে গতবারের মতোই অবস্থা বহাল রয়েছে। গতবার সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের আসন ছিল ৫১টি, রিপাবলিকানদের ৪৭টি, স্বতন্ত্র দুটি। সর্বশেষ খবরে এবার ডেমোক্র্যাট ৫৩ ও রিপাবলিকান ৪৫টি আসন পেয়েছে। এ ছাড়া হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদে গতবার রিপাবলিকানদের আসন ছিল ২৪০ ও ডেমোক্র্যাটদের ১৯০। এবার রিপাবলিকানদের ২৩২ ও ডেমোক্র্যাটদের ১৯২ আসন পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার জয় ও রমনির পরাজয়ের পেছনে নানা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের অনেকেই বলছেন, অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বমুখী থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বিশ্বাস করেছে, ওবামাই তাদের অর্থনীতি ও দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ওবামার বক্তৃতা ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভোটারদের, বিশেষ করে তরুণ, নারী, সংখ্যালঘু ও অভিবাসীদের আকৃষ্ট করেছে। একই সঙ্গে প্রলয়ংকরী ঝড় 'স্যান্ডি'র বিপর্যয় মোকাবিলায় দক্ষতাও মানুষের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। অন্যদিকে রমনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ভোটারদের মুগ্ধ করতে পারেননি। বিশেষ করে ধনীদের কর কমানো, গর্ভপাত ও অভিবাসীদের বৈধকরণের বিরোধিতা এবং 'যুদ্ধবাজ' মনোভাব রমনির পরাজয়ের পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ওবামার জয়কে সুস্থ রাজনীতির বিকাশের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞই। মার্কিন অর্থনীতিবিদ জর্জ সরোস বলছেন, 'ওবামার জয়ে আমি খুশি। মার্কিন ভোটাররা উগ্রপন্থী অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করে রাজনীতির সহনশীলতার পথ উন্মুক্ত করেছেন।' রিপাবলিকানরা আগামী দিনগুলোতে ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তবে এবার ওবামাকে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- দুর্বল অর্থনীতির চাকাকে সবল করা, ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব কমানো ও বিনিয়োগবান্ধব মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা। করনীতির প্রশ্নে এমনিতেই ধনিক শ্রেণী ওবামার ওপর অসন্তুষ্ট। গতকাল ওবামার জয়ের খবরে শেয়ারবাজারে পতন দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের বোঝা কমানো, কর, স্বাস্থ্যসেবা, জাতীয় ঐক্য, মার্কিন জনগণের নিরাপত্তা, মৌলিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ের সুরাহা করতে হবে ওবামাকে। এর বাইরে আফগানিস্তানের যুদ্ধ, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের গণ-অসন্তোষের মতো বিষয় তো রয়েছেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০৮ সালে হোয়াইট হাউসে ঢুকেছিলেন ওবামা। এবার আরো চার বছরের জন্য ওবামার হাতেই সেই বাড়ির চাবি তুলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। এখন দেখার বিষয়, তিনি সেই চাবিতে তাঁর দেশ ও বিশ্বের মানুষের ভাগ্যের তালা কতটা খুলতে পারেন। সূত্র : বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউ ইয়র্ক টাইমস।

No comments

Powered by Blogger.