এটি একটি ব্যতিক্রমী উৎসব by আবুল খায়ের

অজয় চক্রবর্তীর কথার রেশ ধরে উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব প্রসঙ্গে ‘আনন্দ’-এর পক্ষ থেকে কথা বলা হয় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের সঙ্গে। এখানে সেই কথোপকথনের বিস্তারিত... পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী আপনাদের উৎসব নিয়ে খুবই রোমাঞ্চিত। কী থাকছে এই উৎসবে? পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী অসাধারণ একজন পণ্ডিত ব্যক্তি।


তিনি গান গাওয়া, সুরারোপ, কম্পোজিশনসহ সব বিষয়ে পরিশীলিত ও পারদর্শী মানুষ। তাঁর গানের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা থেকেই তিনি আমাদের এই উৎসবের ব্যাপারে উৎসাহী। সমাজের প্রতিটি স্তরে সংগীতের, বিশেষ করে উচ্চাঙ্গসংগীতের যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেন এবং যে স্তরে এই সংগীতকে নিয়ে যেতে চান, সেই স্তরে উন্নীত হওয়ার ক্রমবিকাশে এই উৎসবের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আর তিনি আমাদের উৎসবের পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত আছেন। তাই এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে তিনি রোমাঞ্চিত। অজয় চক্রবর্তী এই উৎসব সম্পর্কে আরও বেশি রোমাঞ্চিত। কারণ, এ উৎসব হচ্ছে বাংলাদেশে আর তিনি এ দেশেরই সন্তান। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে।
আমাদের বাংলা গানের ধারায় উচ্চাঙ্গসংগীত একটি মূল স্তম্ভ হলেও একসময় এটি হারিয়ে যেতে বসেছিল কালের বিবর্তনে। সেই হারানো স্থানে উচ্চাঙ্গসংগীতকে অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই আমাদের এই প্রচেষ্টা। উচ্চাঙ্গসংগীত শুধু বৈঠকি সংগীত হিসেবে নয়, সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এই উৎসবের আয়োজন করেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন।
উৎসবটি ব্যতিক্রমী মনে করছেন কেন?
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ২২ বছর ধরে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় কাজ করে চলেছে। এ দেশের শিল্প, সংগীত, কারুশিল্প, থিয়েটার, ম্যাগাজিন, বই প্রকাশনা প্রভৃতি সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠান জড়িত। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন মনে করে, সংস্কৃতির যত ধারা এ দেশে বহমান সেগুলোকে একত্রকরণ ছাড়া সঠিক সংস্কৃতিচর্চা সম্ভব নয়। আর সংস্কৃতিচর্চা ছাড়া মানুষের মধ্যে মনন তৈরি হয় না। ছাত্র থেকে শিক্ষকনির্বিশেষে সবার মধ্যে এই মনন থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া একটি জাতি, দেশ, রাষ্ট্র নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না, কোনো সুন্দর কিছু সৃষ্টি হয় না, হয় না ভালো কোনো সিদ্ধান্ত।
উচ্চাঙ্গসংগীত হচ্ছে সংগীতের শিকড়। কালের বিবর্তনে এটি তার স্থানচ্যুত অনেকটাই। তাই এই সংগীতের ধারাকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে নিয়ে আসার একটি প্রয়াস আমাদের এই চার দিনে উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব।
এ উৎসবে ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় ১০০-এর মতো শিল্পী অংশগ্রহণ করবেন। যদিও উৎসব প্রস্তুতির শুরুতে আমাদের ধারণা ছিল ৫০ জন শিল্পী হয়তো আমরা পাব। কিন্তু এখন এ সংখ্যা ১০০ তে উন্নীত হয়েছে। আর্মি স্টেডিয়ামজুড়ে প্রায় ১০ হাজার দর্শকের জন্য চার দিনব্যাপী আয়োজিত এই উৎসবস্থলে থাকবে ফুড কোর্টসহ অন্যান্য সুবিধা।
আমার জানামতে, পৃথিবীর আর কোথাও উচ্চাঙ্গসংগীতের এত বড় আসর বসেনি। তাই এই উৎসবকে ব্যতিক্রমী বলা যায় নিঃসন্দেহে। শুধু ব্যতিক্রম বললে ভুল হবে, বলা যায় অসাধারণ এক উৎসবের আয়োজন চলছে।
আরও বড় বিষয় হলো এই উৎসবের সমাপ্তি এখানেই নয়, এরপর প্রতিবছর এ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া বেঙ্গল ফাউন্ডেশন দুই মাস অন্তর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে উচ্চাঙ্গসংগীতের আয়োজন করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এ ধারাবাহিক কার্যক্রম অবশ্যই উচ্চাঙ্গসংগীতের লুপ্তপ্রায় ধারা সজীব করতে সহায়ক হবে বলে আমি আশাবাদী।
কোন ধরনের দর্শক-শ্রোতা আশা করছেন?
সব ধরনের শ্রোতা এই উৎসবে আসবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এখানে গান শুনতে আসা দর্শকের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব বয়সী নারী-পুরুষ আগ্রহী এ উৎসব ঘিরে। বোদ্ধা থেকে ছাত্র সবার গভীর আগ্রহ থেকে এটি সহজেই প্রতীয়মান। আমাদের মূল উদ্দেশ্য, উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রসার, যা এই উৎসবের সাফল্যের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল আর এটি যে একটি সফল আয়োজন হবে, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।
ব্যান্ড সংগীতের অনুষ্ঠানে দর্শক হয়। কেন মনে করছেন উচ্চাঙ্গসংগীতের মতো উৎসবের দরকার আছে?
নবীন প্রজন্ম থেকে আগের প্রজন্ম—অনেকেই গান গাইছেন। বিভিন্ন ধারার যেমন উচ্চাঙ্গসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, ব্যান্ড সংগীত প্রভৃতির চর্চা চলছে। এর মধ্যে নবীন প্রজন্ম বিশেষ করে ব্যান্ড সংগীতের প্রতি বিশেষ আগ্রহী। তবে তারা যে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনতে আগ্রহী নয়, তা কিন্তু নয়। যেকোনো সংগীতের শিকড় উচ্চাঙ্গসংগীত। তাই এ সংগীত ছাড়া যে চর্চাই করা হোক না কেন, তা চিরস্থায়ী হবে না। সুর পাবে না তার স্বকীয়তা, ছন্দ যাবে হারিয়ে। তাই সংগীতকে শিকড়-অভিমুখী করতে এ উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল, আছে এবং থাকবে।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এ উৎসবের পর একটি সংগীত বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এবং ভারতের আইটিসি সংগীত রিসার্চ একাডেমির যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানটি করা হবে। এ ঘোষণার পর অনেক ব্যান্ডশিল্পী তাঁদের উচ্চাঙ্গসংগীত শেখার আগ্রহের কথা আমাদের কাছে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে আমি দুজনের নাম বলতে পারি, যেমন অর্ণব আর গৌরব। এ পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট, ব্যান্ড সংগীত নয়, সংগীতের স্থায়িত্বে বিশ্বাসীমাত্র উচ্চাঙ্গসংগীতকে মূল্যায়ন করতে চান অন্তর থেকে।
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে কি কিছু বলবেন?
আমাদের তরুণ সমাজ অনেক ভালো গান গাইছে, তাদের গলা সুন্দর, তবে যে বস্তুটির অভাব প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়, তা হলো যথাযথ সংগীতশিক্ষা। এসব শিল্পীর অনেকের সংগীতসম্পর্কিত ভিত্তি সম্পর্কে ধারণা নেই, যা তাদের গানকে কখনো দীর্ঘস্থায়ী করে না। এই প্রজন্মের জন্যই আমাদের সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত। আশা করছি, আগামী বছর ১৫ মার্চ এই বিদ্যালয়ের দ্বারোদ্ঘাটন সম্ভব হবে। এ বিদ্যালয়ে ১০ জন ওস্তাদ তালিম দেবেন। শুধু তা-ই নয়, এখানে কণ্ঠসংগীতের পাশাপাশি যন্ত্রসংগীতের তালিম দেওয়া হবে। নবীনেরাই নয়, সবার জন্যই এই বিদ্যায়তনের দরজা উন্মুক্ত। এর প্রধান শিক্ষক হিসেবে থাকবেন ওস্তাদ মাশকুর আলী, তাঁর সঙ্গে থাকবেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী আর পণ্ডিত উলহাস কাসেলকার, বিদূষী শুভ্রা গুহের মতো পণ্ডিতেরা।
তাই তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমার বক্তব্য হলো, শিকড় থেকে সংগীতের তালিম নেওয়া উচিত। কারণ যে সংগীতকে শিকড় থেকে আত্মস্থ করে তার পক্ষে সব সংগীতই চর্চা করা সহজ।

No comments

Powered by Blogger.