চারদিক- ফিরে যাই শৈশবে by ফারুখ আহমেদ

ছেলেবেলায় চড়ুইভাতি খেলার অভিজ্ঞতা আমাদের সবার আছে। কয়েকজন বন্ধুবান্ধবী একত্র হয়ে যার যার নিজের ঘর থেকে চাল-ডাল, ডিম, তরকারি, মাছ এনে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খুব মজা করে খেতাম, সেভাবে খাওয়াকে বলে চড়ুইভাতি। সেদিন থালাবাসন, পাতিল-খুন্তি—সবই নিজের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হতো।


নিজেদের তৈরি চুলা, ফুঁকনি দিয়ে ফুঁ। তারপর ঘাম ঝরিয়ে মজা করে খাওয়া, সেই একটা সময়। চড়ুইভাতির সেসব দিনের কথা ভুলতে বসেছিলাম। মনে পড়ল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত খ্রিষ্টান কবরস্থানে গিয়ে। আশপাশের এলাকার কজন শিশু-কিশোর সেদিন চড়ুইভাতি খেলছিল। এই নগরে এ এক মধুর অভিজ্ঞতা!
সেদিন টিকাটুলির কাছের রোজ গার্ডেন থেকে বলধা গার্ডেন হয়ে কলতাবাজার ফিরছিলাম। শেরেবাংলা উচ্চবিদ্যালয়ের গলি দিয়ে বের হয়ে ওয়ারী প্রবেশ করতে গিয়ে নানা রকম খানাখন্দ আর যানজটে ভরা রাস্তা পেরোতে গিয়ে অনেকটা সময় ব্যয় হয়। সে পথটুকু পার হওয়া কতটা বিরক্তিকর ছিল, তা বলে বোঝাতে পারব না। বিরক্তিকর সেই সময়গুলো শেষ হতেই কাছে পড়ে খ্রিষ্টান কবরস্থান। মোটরসাইকেল দাঁড় করাই। তারপর ঢুকে পড়ি ভেতরে। বৃষ্টি হচ্ছে থেমে থেমে। বৃষ্টিতে সবুজ প্রকৃতি মন ভরানো। এখানে পুরো এলাকা গাছগাছালিতে ভরা। গাছগাছালির সবুজ আমাকে ঘিরে ধরে। এ যেন সবুজ দুনিয়া। সবুজ বড় স্বস্তিদায়ক। আমি সবুজ গন্ধ শুঁকি, সবুজ ছুঁয়ে দেখি। প্রাণভরে সবুজ নিঃশ্বাস নিয়ে ক্যামেরা বের করি। একেবারে পেছনে চলে যাই। যেখানে সুইপার কলোনির বিল্ডিংগুলো দাঁড়িয়ে। পুরো এলাকা চক্কর মারার আগেই দেখা হয়ে যায় একদল শিশু-কিশোরের সঙ্গে। আমি দূর থেকে ওদের ছবি তুলি আর সামনে এগোই। পাঁচ-ছয়জন হবে, তারা খাবার খাচ্ছে, তা-ও আবার কবরের ওপর বসে! এর আগে এখানে দেখেছিলাম একজন কিশোরের ঘুম। আমাকে আর হাতে ক্যামেরা দেখে দারুণ উচ্ছ্বসিত মনে হলো তাদের। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই নানা অঙ্গভঙ্গিতে ওরা পোজ দেওয়া শুরু করল। আমিও সমানে ক্লিক করে চললাম!
জনি টিপু আল-হাসান আসমা করিম আর মুনসুর। এরা সবাই কাছের এ কে হামিদ প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রছাত্রী। বয়স গড়ে বারো-তেরোর বেশি হবে না। জনি, টিপু আর আসমার বাড়ি বরিশাল। ওদের বাবা এ কে হামিদ স্কুলে দপ্তরির কাজ করেন, স্কুলই তাদের বাড়ি। বাকিরা সবাই সুইপার কলোনির বাসিন্দা। ইতিমধ্যে সবার খাওয়া শেষ হয়েছে। এবার গোছগাছে ব্যস্ত হয় তারা। সেই ফাঁকে কথা হয় আসমা-টিপুর সঙ্গে। সবাই চড়ুইভাতি খেলতে এসেছে এখানে, প্রায়ই তারা আসে। বাসা থেকে বা টাকা দিয়ে চাল-ডাল কিনে রান্না করে খায়।
ভেবে দেখুন, বারো-তেরো বছরের একদল শিশু-কিশোর কবরের পাশে বসে রান্না করেছে, খেয়ে-দেয়ে কবরের ওপর শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই এখানে থাকবে। ভয়-ডর কিছুই তাদের নেই। ভয়কে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়েছে যখন তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, ‘তোমাদের কবরস্থানে ভয় করে না?’ জনি বলে, ‘ডর কিয়ের, খুব ভাল্লাগে, স্কুল ছুটি অইলেই আয়া পড়ি। বিষ্টি পড়নে জায়গাটা অহন বেশি সুন্দর। বিষ্টির মদ্যেও আমরা আহি। প্লাস্টিক দিয়া ছাত বানাই, তার নিচে বইয়া জোলাবাতি খেলি। আমরা ভালা রান্দন পাড়ি, আপনে খায়া দেখবার পারেন।’
আমি ওদের থালাবাসনের দিকে তাকাই, আবার তাকাই ওদের দিকে। সবার হাতে বুনো ফুল, আসমা আবার সে সব ফুল তার কানে আর চুলে আটকেছে। এর মধ্যে ওরা এক চক্কর পুরো কবরস্থান ঘুরে আসে। আমি আনমনা হেঁটে চলি, মনে পড়ে আমাদের বাড়ির পাশে ছাত্তি চোরার বাড়ির কথা, দরজা-জানালা ছাড়া এক ভাঙা বাড়ি। দিনের বেলায় সেই বাড়িতে যেতে কেউ সাহস পেত না। আসমাদের মতো এতটা সাহসী হয়তো আমরা ছিলাম না। তবে আমরা ভয়কে ওদের মতোই উড়িয়ে দিয়ে সেখানে প্রায়ই চড়ুইভাতি খেলতাম। একটু বড় হয়ে যাত্রাবাড়ীর বাঁধে চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। দুরন্ত আমরা বাঁধের পানিতে লাফিয়ে পড়তাম, নৌকায় ঘুরে বেড়াতাম। আজ সেসব কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল আমার ছেলেবেলার বন্ধুদের। রন্টু, সাত্তার, সাঈদ, আসলাম, সোহেল, ইউনুসদের। অপলক আসমা, জনি-টিপুদের দেখি আর দেখি দুচোখ-ভরা ভেজা চোখে আমার শৈশব। সে সময় মন কেমন ছটফট করত। স্কুল বা যেখানে থাকতাম না কেন, স্কুলশিক্ষক বা মা-বাবার বাঁধন ছেড়ে আমরা লুকিয়ে খেলতাম, ছুটতাম টিপু আর জনিদের মতো। আমি সামনে এগোই। আমার ওপর ভর করে শৈশব।
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.