বৃহতের সাধনা by সুভাষ সাহা

রাশিয়া বা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলোতে (বর্তমানে স্বাধীন রাষ্ট্র) সমাজতন্ত্রের পাট চুকেবুকে গেছে দুই দশকের বেশি সময় হলো। সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়ার মতো সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সফল নেতা লেনিনের ইমেজও এখন ফিকে হয়ে গেছে।


সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং কিন্তু নিজ দেশে বিরাট পরিবর্তনের কালেও ব্রাত্য হয়ে যাননি। তার সঙ্গে কনফুসিয়াসও এখন চীনাদের স্মরণীয় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। শুধু তাই নয়, এক সময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরে ঢোকা পুঁজিপতিদের জন্য নিষিদ্ধ থাকলেও সংস্কারের আওতায় তাদের জন্যও সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদর দরজা এখন খোলা। এটা জানা যে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রাগমেটিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মিরাকল সাধন করে। তাদের অর্থনীতি এখন বিশ্বের দুই নম্বর অবস্থান সংহত করে যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর আসনখানি ছিনিয়ে নিতে উদ্যত। কিন্তু এভাবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি যে চীনে বিরাট সামাজিক পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে সে বিষয়টি কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তিয়েন আনমেন স্কয়ারের বিক্ষোভ ও তাকে বলপ্রয়োগ করে রক্তাক্ত পথে দমন করা এবং পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়া থেকে তারা যথেষ্ট শিক্ষা নিয়েছেন। অথচ সোভিয়েত নেতারা সামাজিক পরিবর্তনের গতিবেগ যে কতটা তীব্র হতে পারে সেটা আঁচই করতে পারেননি। এখানেই আসে সামাজিক পরিবর্তনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা এবং সেই পরিবর্তনকে আত্মস্থ করে নিজেকে তার অগ্রগামী শক্তির স্তরে উত্তরণ করানোর দুরূহ সাধনা সম্পন্ন করার প্রশ্নটি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব পরিবর্তনকে ধরা তথা বৃহতের সাধনাটি ভালোভাবেই করে চলেছেন। যে কারণে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিপদ ঘণ্টি বাজিয়ে চললেও তেমন বিপদ ঘটেনি। চীনা সমাজের কিছু কিছু পরিবর্তন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং চীনা সমাজের মধ্যকার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করতে ইতিমধ্যেই সক্ষম হয়েছে। অতীতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হবু নেতা, এমনকি প্রতিষ্ঠিত নেতারাও দলের অনুমোদনের বাইরে নিজের কোনো প্রকাশনা জনসমক্ষে আনতে পারতেন না। এখন হবু নেতারাও বই প্রকাশ বা নিবন্ধ ছেপে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার সাহস দেখাতে পারছেন। এ জন্য তাদের ওপর কমিউনিস্ট পার্টির খড়্গ নেমে আসছে না। যে কারণে সামাজিক এলিটরাও কমিউনিস্ট পার্টির এবং বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব লাভ করতে পারছে। আসলে চীনা সমাজের প্রবহমান সামাজিক বিপ্লবকে ধারণ করে বিশ্বের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টিও নিজেকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করে নিচ্ছে। এভাবে চলতে চলতে হয়তো একদিন সেখানে পার্টি ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব নির্ধারণে আরও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া হবে। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা অবশ্য টানতে টানতে কমিউনিস্ট পার্টির রশি এক সময় ছিঁড়ে যায় কিনা সেটা দেখার স্বপ্ন নিয়ে দিন গুজরান করছেন। একজন সমালোচক চীনা নেতৃত্বকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেও এখন নিস্তার পেতে পারেন। একজনকে তো যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে দিয়েছে তারা। এতেই বোঝা যায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ভিন্ন মতপ্রকাশের সুযোগ অনেক বেড়েছে। মিডিয়া বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ার এই বিপ্লবের যুগে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি জোর করে যে কারও মতামতকে রুদ্ধ করতে পারে না, সেটা তাদের উপলব্ধিতে এসেছে। এটা শুভ লক্ষণ নিঃসন্দেহে। এ জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য চীনা জনগণ ও সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টির। আসন্ন কংগ্রেসে নির্ধারিত হবে চীনের নতুন নেতৃত্ব, সেদিকে দৃষ্টি থাকবে সবার। তাদের কাছ থেকে কি আমাদের কিছুই শেখার নেই!
 

No comments

Powered by Blogger.