হোয়াইট হাউসের পুতুল হয়ে থাকবেন না তো?

ইতিহাসের পাতায় যুক্তরাষ্ট্রের আরো একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খতিয়ান শেষ হলো। হার-জিতের নতুন কিছু হিসাব ও সমীকরণও যুক্ত হলো এর সঙ্গে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও ক্ষমতার কাঠামোতে এর প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ কাটছে না। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও বারাক ওবামা বাস্তবে কতটা ক্ষমতা চর্চার সুযোগ পাবেন, সে ব্যাপারে সংশয় রয়ে গেছে।


প্রতি চার বছর পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অনেককেই দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। গণমাধ্যমের বিরতিহীন প্রচার-প্রচারণা, সর্বব্যাপী বিজ্ঞাপন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলোর ক্লান্তিহীন বাগাড়ম্বর ভোটারদের নাভিশ্বাস তুলে দেয়। নির্বাচনী প্রচারণার গরম হাওয়া থেকে কেউই রেহাই পায় না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে এবার যত টাকা, সময় ও শ্রম ব্যয় হয়েছে- বিশ্বের আর কোনো দেশেই এর নজির নেই। ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায় ছয় সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যেই পুরো নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হয়। ফ্রান্সে এ ধরনের প্রচারণায় কখনোই তিন সপ্তাহের বেশি সময় লাগেনি। কানাডার ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচনী প্রচারণায় ৭৪ দিন সময় লেগেছিল। সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী উন্মাদনা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। আর এবারের নির্বাচনে শুধু প্রচারণা বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার।
প্রেসিডেন্ট পদটি নিয়ে মার্কিন জনগণের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষাও রয়েছে প্রচুর। 'যেকোনো শিশু বড় হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে যেতে পারে'- এমন একটি ধারণা মার্কিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকে। পদটি ঘিরে তাদের মধ্যে অনেক স্বপ্ন, আশা, পরিকল্পনা, আশ্বাস সঞ্চারিত করে দেওয়া হয়। তবে ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আশান্বিত হওয়ার মতো কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। বারাক ওবামার আগে যে ৪৩ জন ব্যক্তি প্রেসিডেন্টের পদে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে আব্রাহাম লিঙ্কন ও ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টসহ মাত্র অল্প কয়েকজনই সফল হিসেবে বিবেচিত। প্রেসিডেন্টের ভাবমূর্তি ঘিরে সমালোচনা ও বিতর্কেরও শেষ নেই। ১৮৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পদে আসেন জেমস গারফিল্ড। কয়েক মাস পরই আক্ষেপ করে তিনি বলেন, 'হে ঈশ্বর, মানুষ এ রকম একটি পদেও আসার স্বপ্ন দেখে!'
একবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা এমন একটি শাসনব্যবস্থার শীর্ষে থাকেন, আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের নাগরিকদের জীবনের ওপর এর প্রভাব রয়েছে। তবে প্রেসিডেন্টের সরাসরি নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে ৫০ জন গভর্নর এবং সরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। শুধু ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ ছাড়া আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার ওপর প্রেসিডেন্টের প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব খাটে না। কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চকক্ষ সিনেটই মূলত এ-সংক্রান্ত পুরো ক্ষমতা ভোগ করে। পার্লামেন্টে দলীয় প্রাধান্য না থাকলে বস্তুত আইন পাসের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের করার কিছু থাকে না।
প্রেসিডেন্ট কেন্দ্রীয় আদালত ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মনোনীত করার অধিকার রাখেন। তবে এ মনোনয়ন সিনেট থেকে পাস করিয়ে আনতে হয়। প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীরও প্রধান। তবে যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।
ভোটারদের 'পরিবর্তনের' আশ্বাস দিয়ে ওবামা ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন। এবারও রিপাবপলিকান শিবিরের বিরুদ্ধে তিনি এ অস্ত্রটি কাজে লাগিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে খুব কম প্রেসিডেন্টেরই দেশের চেহারা বদলের দেওয়ার মতো ও দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন ঘটানোর দৃষ্টান্ত রয়েছে। আব্রাহাম লিঙ্কন, ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, রোনাল্ড রিগান সংক্ষিপ্ত এ তালিকায় রয়েছেন। বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি ও যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের কারণে প্রথম মেয়াদে ওবামা তাঁর ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল করেছেন ঠিকই। কিন্তু পর্যুদস্ত অর্থনীতি, বিতর্কিত স্বাস্থ্যনীতি, করনীতি, কর্মসংস্থান, মুদ্রানীতি, মৌলিক সুযোগ-সুবিধার ইস্যুতে জনগণের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের অঙ্গীকার পূরণের জন্য আরো চার বছর হোয়াইট হাউসে থাকার অনুমোদন তিনি পেয়েছেন। তবে মার্কিন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণেই হঠাৎ করে চমকপ্রদ কিছু করে ফেলার সুযোগ ওবামা পাবেন না। বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে খেলনা পুতুল হিসেবে বসে থাকতে হতে পারে তাঁকে। সূত্র : সিএনএন।

No comments

Powered by Blogger.