ফতোয়া ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

আমাদের অনেকের জানা আছে কয়েক বছর আগে সিলেটে নূরজাহানকে পাথর ছুড়ে মারার মধ্য দিয়ে ফতোয়া বিষয়টি দারুণভাবে আলোচিত হয়। দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এরপর থেকে নূরজাহানের মতো বহু নারী ফতোয়ার শিকার হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। তাঁদের অনেককে নূরজাহানের মতো মৃত্যুও বরণ করতে হয়েছে।


কেউ কেউ নূরজাহানের মতো ফতোয়ার সরাসরি শিকার, আবার অনেকে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের মাধ্যমে নিজের জীবনাবসান ঘটিয়েছেন। অনেকের সংসার ভেঙে গেছে এবং এখনো যাওয়ার উপক্রম।
ফতোয়া বিষয়টি শুধু তালাক ইস্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং অবৈধ সম্পর্ক, অবৈধ যৌনসঙ্গম এবং এর মাধ্যমে সন্তান জন্মদান, পরকীয়া প্রেম প্রভৃতি বিষয়েও ফতোয়া দেওয়া হয়। ফতোয়া প্রদান ও এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মানুষটিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। একঘরে করে রাখা, এমনকি গ্রাম ও এলাকা-ছাড়াও করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর শিকার হচ্ছেন গরিব অসহায় মহিলারা, যাঁদের নেই সমাজে প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ও আর্থিক সামর্থ্য। তাঁদের অবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন এক ধরনের ধর্মান্ধ, স্বল্পশিক্ষিত মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁদের অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন আমাদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যাঁদের আমরা আমাদের রক্ষাকবচ ভাবি, যাঁদের কাজ হলো আমাদের রক্ষা করা; কিন্তু তাঁরা তা না করে উল্টো ফতোয়াবাজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অসহায় মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখছেন। উৎসাহী করছেন ধর্মান্ধ ও ধর্মান্ধতাকে।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বারুইগ্রামে গত রমজান মাসে এক স্বামী তাঁর স্ত্রীকে রাগের বশে মৌখিকভাবে তালাক দেন। একপর্যায়ে পাড়াপড়শির হস্তক্ষেপে তিনি রাগ করে বলে ফেলেছেন এবং এ নিয়ে অনুশোচনাও করেন; কিন্তু এই স্বামীর চাচাতো ভাই মাওলানা আবু আয়েছ তাঁদের তালাক হয়ে গেছে বলে জানান। সমাজপতিরা হিল্লা বিয়ে করে সংসারে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন স্ত্রীকে। স্বামীর ঘরে ফিরতে না পেরে ওই নারী দুই সন্তান নিয়ে এখন বাপের বাড়ি। এ তো গেল তালাক ও হিল্লা বিয়ে ইস্যু। পরকীয়ার অভিযোগ এনে এক গৃহবধূকে প্রথমে দোররা মারা হয় এবং পরে চার দিন আটকে রেখে সপরিবারে এলাকা-ছাড়া করা হয়। ঘটনাটি ঘটে বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলায়। আক্রান্ত গৃহবধূ এখন তাঁর বাপের বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছেন। এখানে ফতোয়ার নায়ক স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। ভুক্তভোগী গৃহবধূ জানান, বাগেরহাট সদরে প্রয়োজনীয় একটি কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় পথে দেখা হয় তাঁর এক আত্মীয়ের সঙ্গে। পথে দাঁড়িয়ে তিনি ওই আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন। পারিবারিক খোঁজখবরই ছিল ওই কথোপকথনের মূল বিষয়। সেই কথোপকথনকেই অতিরঞ্জিত করে চেয়ারম্যান মাওলানা মো. মঞ্জু ওই দিন সালিস বৈঠক ডেকে ৪০টি দোররা মারার হুকুম দেন এবং তা কার্যকর করেন। আমাদের সমাজের ধর্মান্ধ ও স্বল্পশিক্ষিত লোকদের দ্বারা নূরজাহান থেকে শুরু করে অতিসম্প্রতি বাগেরহাট কিংবা ময়মনসিংহের গৃহবধূ সবাই ফতোয়ার শিকার। দেশের প্রচলিত আইনকানুন সম্পর্কে ধারণা থাকা সত্ত্বেও ধর্মের দোহাই দিয়ে তথাকথিত সমাজপতি, জনপ্রতিনিধি ও ধর্মান্ধগোষ্ঠী এলাকার কিছু মানুষকে পুঁজি করে তাঁদের ফায়দা লুটে যাচ্ছেন। আর এর বলি হচ্ছেন অসহায় ও নিরীহ মহিলারা।
মানুষের সব ধরনের অপরাধের বিষয়গুলো আইনি কাঠামোর মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ মানুষের কোনো কোনো আচরণকে 'অপরাধ আচরণ'-এর আমলে এনে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আবার মানুষ কোন ধরনের আচরণ করতে পারবে তাও রয়েছে আইনগত বিধিবিধানে। বাংলাদেশ প্রতিবিধান ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অর্ডিন্যান্সে মুসলিম বিবাহ, তালাক, বহুবিবাহ, হিল্লা বিবাহের কথা বলা আছে। মুখে শুধু তালাক বললেই তালাক হয় না। তালাক নামক শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে এবং ইউনিয়নের বাসিন্দা হলে ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে কাজি অফিসের মাধ্যমে তালাকনামা পাঠাতে হয়। সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান সালিস পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে স্বামী ও স্ত্রী উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৯০ দিনের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেন। যদি ৯০ দিনের মধ্যে সমঝোতা না হয় তাহলে এরপর থেকে তালাক কার্যকর হয়। আর সমঝোতা হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই আবার সংসার করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে হিল্লা বিয়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যেখানে আইন ও বিধিবিধান সুস্পষ্ট সেখানে ফতোয়ার প্রয়োজন কেন? একজন আইনজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ যাঁরা লিখতে ও পড়তে পারেন তাঁদের সবার কাছে এ প্রক্রিয়া জানা। তার পরও আমরা ফতোয়া দিচ্ছি। যে মুফতি হিল্লা বিয়ের ফতোয়া দিচ্ছেন তিনি নিজেও বিষয়টি জানেন; কিন্তু আইনকে মেনে নিতে পারছেন না। ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রচলিত আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের মনগড়া ফতোয়া দিয়ে গ্রামের মহিলাদের অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আর ফতোয়ার বিষয়েও রয়েছে সরকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা।
২০১১ সালে ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আংশিকভাবে মঞ্জুর করে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়ে সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা হলেও আপিল বিভাগের রায়ে তা আংশিক বাতিল করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরাই ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দিতে পারবেন, যা কেবল স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এটা গ্রহণ করতে কোনোভাবেই প্রভাবিত করা যাবে না। এমন কোনোভাবে ফতোয়া দেওয়া যাবে না, যাতে দেশের প্রচলিত আইন মেনে কোনো ব্যক্তির অর্জিত সুনাম বা খ্যাতি ক্ষুণ্ন হয়। ফতোয়ার নামে কাউকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া যাবে না। এমন সুনির্দিষ্ট রায় থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে। যখন তালাক বিষয়ে আইনে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে, যখন অবৈধ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আইনে বিধান রয়েছে, তখন কেন উল্টো ফতোয়া। যেসব বিষয় আইনের সঙ্গে যুক্ত নেই সে ক্ষেত্রে একমাত্র ধর্মীয় প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ফতোয়া দিতে পারেন; কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে কেন ফতোয়া? আমাদের দেশ বাংলাদেশ 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'। এটি কোনো ইসলামিক রিপাবলিক নয়, যেখানে ইসলামিক আইন কার্যকর হবে। সুতরাং এ মুহূর্ত থেকে তালাক ইস্যুতে ফতোয়া দেওয়া বন্ধ করা এবং ফতোয়াবাজদের শাস্তির মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। না হলে আমরা আপিল বিভাগের রায়কে অমান্যই করব না বরং অপরাধও করব।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.