খালেদা জিয়ার ভারত সফরে প্রাপ্তি by তারেক শামসুর রেহমান

সাত দিনের বহুল আলোচিত ভারত সফরের পর খালেদা জিয়া গতকাল শনিবার ঢাকায় ফিরেছেন। এই সফর খোদ ভারতে যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও প্রচুর আলোচনা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ সফরকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব? প্রথমত,


এ সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা খালেদা জিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনায় ভারতীয় নেতারা 'বেশ কিছু বিষয়ে' তাঁর অবস্থান জানতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ভারত তার প্রথাগত অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসেছে। এত দিন ভারত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগকেই 'বন্ধু' মনে করত। এখন ভারত এ বৃত্ত ভাঙছে। আজ ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করতেও ভারতীয় নেতাদের এখন কোনো দ্বিমত নেই। এমনকি তাঁরা এরশাদকেও লাল গালিচা সম্মান দিয়েছিল নয়াদিল্লিতে। ভারত এ সফরকে অভিহিত করেছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও বহুদলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের চলমান যোগাযোগের অংশ হিসেবে। আর কলকাতার আন্দবাজারের ভাষায়, 'নিঃশব্দ রণকৌশল পরিবর্তন'। ভারতের এই রণকৌশল পরিবর্তনে আমি অবাক হইনি। কেননা এর সঙ্গে ভারতের জাতীয় স্বার্থ জড়িত। ভারত তার জাতীয় স্বার্থ দেখবে। এ জাতীয় স্বার্থের আলোকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। তাদের কাছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো ব্যাপার নয়। বিএনপি যদি তাদের জাতীয় স্বার্থের পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়, তাহলে তারা বিএনপিকে 'বন্ধু' ভাববে- এটাই স্বাভাবিক, এটাই রাজনীতি। ভারতীয় নেতারা এটা উপলব্ধি করেছেন যে বাংলাদেশে জনমত এখন আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অনুকূলে নয়। তাই তাদের জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনেই তারা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করবে- এটাই স্বাভাবিক। তৃতীয়ত, বিএনপি তার রাজনীতির কারণেই ভারতবিরোধী একটা অবস্থান নিয়েছিল- এ রকম একটা অভিযোগ রয়েছে। এখন বিএনপি যদি একটা 'বাস্তবমুখী' অবস্থান গ্রহণ করে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভারত এ শতাব্দীতেই অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। এ বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। আমি মনে করি, এটা বিএনপির 'রিয়্যাল পলিটিক্স'-এর একটি অংশ। বিএনপি একই সঙ্গে চীনকেও আস্থায় নিয়েছে। রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু বা মিত্র বলে কিছু নেই। জাতীয় স্বার্থই সনাতন। একসময় চীন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। এখন সেই চীনকে 'ঘিরে ফেলা'র নীতি নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপি তার পুরনো ধ্যান-ধারণা ধরে রাখবে- সেটা আমরা মেনে নিই কিভাবে? বাহ্যত, বিএনপি কখনো ভারতবিরোধী নয়। বিএনপির আমলেই অর্থনীতিতে ভারতকে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমান। বিএনপি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে অবস্থান নিয়েছিল, তা জাতীয় স্বার্থেই নিয়েছিল। এটাকে ভারতবিরোধিতা বলা যাবে না। অবশ্য এটা বিএনপির ব্যর্থতা যে তারা 'ভারতবিরোধী' ইমেজ ভাঙতে পারেনি। মিডিয়া না থাকায় তাদের বক্তব্য সঠিকভাবে প্রচারিত হয়নি বলেও আমার ধারণা। চতুর্থত, নয়াদিল্লিতে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনায় খালেদা জিয়া ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতবিরোধী তৎপরতায় ব্যবহৃত হতে দেবেন না বলে যে আশ্বাস দিয়েছেন, এটাকে আমি 'পজিটিভলি' দেখছি। এটাও বিএনপির রিয়্যাল পলিটিক্সের অংশ। বাংলাদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতা গোষ্ঠীর অবস্থান শুধু বিএনপির আমলেই ছিল না, এ সমস্যা মূলত ভারতের। এ সমস্যা বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার আগেই তৈরি হয়েছিল। 'সাত বোন রাজ্যের' বিচ্ছিন্নতাবাদিতার সমাধান ভারতকেই করতে হবে! আজ আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে বিএনপিকে দোষারোপ করলেও, মূল সমস্যার দিকে তাঁরা দৃষ্টি দেননি। ভারত সরকার সামরিক বাহিনী দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে। এ সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। ওই 'ভুল' সিদ্ধান্তের জন্য ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এ জন্য বিএনপিকে দায়ী করা যাবে না। পঞ্চমত, ভারত সফরে খালেদা জিয়া অতীত ভুলে সামনের দিকে তাকানোর কথা বলেছেন। এ সিদ্ধান্তও সঠিক। অতীতকে ধরে রেখে কোনো জাতি কখনো উন্নতির শিখরে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশ যেমন পারেনি, পারবে না ভারতও। একুশ শতকে এসে সারা বিশ্বই পরস্পর নির্ভরশীল একটা সম্পর্ক গড়ে তুলছে। 'সামনের দিকে তাকানোর' অর্থই হলো পরস্পর নির্ভরশীল একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা। 'ক্ষুদ্র দেশ' হিসেবে বাংলাদেশেরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। খালেদা জিয়া সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। ভারতের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজাল থেকে ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, পোর্ট ব্যবহারসহ বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিকতার আলোকে সম্পর্ক গড়তে হবে। এটাই একুশ শতকের চাহিদা। দ্বিপাক্ষিকতা একটি ভ্রান্ত নীতি। ট্রানজিটের একটা সম্ভাবনা রয়েছে। এটা হতে হবে কানেকটিভিটির আলোকেই, যাতে সুদূর চীনকেও আমরা এই কানেকটিভিটির আওতায় আনতে পারি। মনে রাখতে হবে, চীনও একটি বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তি। এই চীন আমাদের নিকট-প্রতিবেশী। এই চীনকে আমরা অস্বীকার করতে পারব না। খালেদা জিয়া এ কথাটাই ভারতীয় নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ষষ্ঠত, মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে খালেদা জিয়ার আলাপচারিতায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবদানের কথা স্মরণ করেছেন। এই 'অ্যাপ্রোচ' থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা শিখতে পারেন। জাতীয় নেতাদের প্রতি সম্মান না জানালে কোনো জাতিই উন্নতির শিখরে উঠতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর শহীদ জিয়া আমাদের ইতিহাসের অংশ। কারো সঙ্গে কারো তুলনা করা যাবে না। দুজনই মহান ব্যক্তি। তাঁরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমাজ নির্মাণ করে গেছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে যখন শহীদ জিয়ার প্রশংসা শুনি, তখন দুঃখ লাগে আমরা বাংলাদেশে এ ধরনের মানসিকতা গড়ে তুলতে পারলাম না। সপ্তমত, খালেদা জিয়ার ভারত সফর নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা তথা মন্ত্রীরা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা ইতিবাচক নয়। 'ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে রাজনীতি' সেই 'রাজনীতি' থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারলাম না। খালেদা জিয়ার সফরে আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতিক্রিয়ায় এ কথাটাই আবারও প্রমাণিত হলো। এই বৃত্ত আমাদের ভাঙতে হবে। অষ্টমত, খালেদা জিয়ার সফরের মধ্যে এটা আবারও প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি 'ফ্যাক্টর'। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবেই হোক ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'প্রভাব' ফেলছে। এরশাদ ও খালেদা জিয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর ফিরতি ভারত সফর এখন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠল। এটা আমাদের রাজনীতির একটা দৈন্য যে আমরা ক্ষমতার 'উৎস' খুঁজছি অন্য জায়গায়!
খালেদা জিয়া তাঁর ভারত সফর শেষ করেছেন। কিন্তু এর একটা প্রভাব রাজনীতিতে থেকে যাবেই। তাঁর এই সফর ভারতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেলেও, একটা আশঙ্কা থেকেই গেল। আর তা হচ্ছে, ভারত কি বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশে একটি 'সেকেন্ড ফ্রন্ট' খুলছে? বিএনপিকে ব্যবহার করে ভারত কি তার 'স্বার্থ' চিরস্থায়ীভাবে আদায় করে নিতে চায়? বিএনপি কি বাংলাদেশে এ কারণে কোনো 'ইমেজ সংকটের' মুখে পড়বে? এর জবাব এই মুহূর্তে আমার জানা নেই। আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে ভারতীয় নেতাদের উদ্দেশ্য আসলে কী। খালেদা জিয়া ভারত সফর করে তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এটা তাঁর নিজের ও দলের জন্য প্রয়োজন ছিল। ভারতকে বন্ধু মনে করার অর্থ এই নয়, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ছাড় দেওয়া। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু ইস্যু রয়েছে, যে ইস্যুগুলোর ব্যাপারে সাধারণ মানুষ চায় বিএনপি স্পষ্ট বক্তব্য রাখুক ও জনগণের পাশে থাকুক। এখন ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে বিএনপি জাতীয় স্বার্থে তার পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসেছে কি না। বাংলাদেশ যেমন ভারতের একটি বড় 'বাজার', আবার একটি 'অস্থিতিশীল বাংলাদেশ' ভারতের জন্য হুমকিও। তাই খালেদা জিয়ার সফরের পর ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে তার অবস্থান পরিবর্তন করছে কি না, সেটাও লক্ষ করার বিষয়। খালেদা জিয়া সাংবিধানিকভাবেই বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় নেতা। তিনি ভারতে লাল গালিচা সম্মান পাবেন, তাঁকে ভারতীয় নেতারা গুরুত্ব দেবেন- এটাই স্বাভাবিক।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.