সাইবার ক্রাইম এবং নারীর অসহায়ত্ব

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) সাইবার অপারাধীদের অভ্যন্তরীণ লোক (Insiders), অনুপ্রবেশকারী (Hackers), ভাইরাস লেখক (Virus Writers) ও অপরাধী চক্র (Criminal Groups)—এই চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। সাইবার ক্রাইম শব্দটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশের অতি পরিচিত ও ভীতিকর একটি শব্দ। এ বিষয়ে জানা থাক বা না থাক, এর শিকার হচ্ছে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ। তবে সাইবার অপরাধ বিশ্বে নতুন ধরনের কোনো অপরাধ নয়, শুধু মাধ্যমটি ভিন্ন।ই-মেইলে হুমকি প্রদান, পাসওয়ার্ড চুরি, হ্যাকিং, অশ্লীল ছবি/ভিডিও হোস্ট করা,তথ্য চুরি, তথ্য বিকৃতি,ছবি চুরি ও বিকৃতি, প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল, অর্থ চুরি ইত্যাদি তথ্যপ্রযুক্তির মাধমে করা হলে সেগুলোকে সাধারণ ভাষায় সাইবার অপরাধ বলা হয়। অন্য ভাষায় সাইবার ক্রাইম মূলত কম্পিউটারে ব্যবহৃত কর্মকাণ্ড, যার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী ক্রাইম পরিচালিত করে থাকে অপরাধীরা।
ছবি সংগ্রহে ধূমকেতু
সাইবার ক্রাইমের করুণ শিকার আমাদের দেশের মেয়েরা। বিগত কয়েক মাসে উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেছে, দেশের প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীসহ বিদ্যালয়ের মেয়েরা পর্যন্ত সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে পর্নোগ্রাফিতে জড়িয়ে পড়ছে নিজের অজান্তে। ক্যামেরায় বা মোবাইল ফোনে ধর্ষণ কিংবা সেক্সের দৃশ্য ভিডিও করে তা ইন্টারনেটে পোস্ট করে দেয়ার মতো বেশ কয়েকটি জঘন্য অপরাধও সংঘটিত হয়েছে আমাদের দেশে। ইদানীং এ কাজগুলো অনেক বেশি হচ্ছে।সাইবার ক্রাইমে নারী নির্যাতনের অন্যান্য ধরনের মধ্যে রয়েছে ফেসবুকে অশ্লীল ছবি প্রদর্শন, ছবিসহ ভুয়া ঠিকানা খোলা, ই-মেইলে হুমকি প্রদান ইত্যাদি। এসব আমাদের উদ্বেগের মাত্রাকে দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

১.গত জুলাই মাসে ফরিদপুরের প্রত্যন্ত একটি গ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণীর এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে তার ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে মোবাইল ফোনে, ভিডিও সিডি আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে।

২.বরিশাল বিএম কলেজে এক ছাত্রলীগ নেত্রী তার রুমমেটের নগ্ন দৃশ্য মোবাইলে ধারন করে ৩০ হাজার টাকা দাবি করে। সেই ছাত্রী তিন হাজার টাকা দিলেও রক্ষা হয়নি। আরো টাকার দাবি করে বেশ কিছু নগ্ন ছবি ছাত্রদের মোবাইলে দেয়া হয়।

৩. ফরিদপুরে অস্ত্রের মুখে ১৪ বছরের এক স্কুল ছাত্রীকে ধষর্ণ করে তা ভিডিওতে ধারণ করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। ঐদিকে চরভদ্রাসনের আলমনগর এলাকায় পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে পুকুর ঘাটে দুইজনে ধর্ষন করে ধষর্ক মোবাইলে ভিডিও করে বাজারে ছেড়েছে।

৪. টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলায় মধ্যযুগীয় কায়দায় এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সহ কর্মী বাহিনী।তারা ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে উল্লাস প্রকাশ করেছে। ধর্ষিতা কিশোরী বাদী হয়ে মামলা করলেও পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেনি। শনিবার সকালে ধর্ষিতের পরিবার বাড়ি ছেড়ে আত্মরক্ষার্থে অন্যত্র পালিয়ে গেছে।

৫.আইরিন আক্তার (ছদ্মনাম) ভালোবেসে বিয়ে করেছিল তার এক ক্লাসমেটকে। কিন্তু একসময় তাদের সম্পর্কের মধ্যে শুরু হয় তিক্ততা। এই তিক্ততার প্রতিশোধ হিসেবে আইরিনের স্বামী তার মুখের সঙ্গে অন্যের খোলামেলা শরীর জোড়া দিয়ে সেটা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। আইরিন এ ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি পরিবার থেকে কোন প্রকার সহযোগিতা না পেয়ে এখন একাকী জীবনযাপন করছেন।

বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে—
১. যদি কোনো ব্যক্তি জনসাধারণের বা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা ক্ষতি হবে মর্মে জানা সত্ত্বেও এমন কোনো কাজ করেন, যার ফলে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সেও কোনো তথ্যবিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা তার মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাস পায় বা অন্য কোনোভাবে একে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
২. এমন কোনো কম্পিউটার সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করার মাধ্যমে এর ক্ষতিসাধন করেন যাতে তিনি মালিক বা দখলদার নন, তাহলে তার এই কাজ হবে একটি হ্যাকিং অপরাধ। কোনো ব্যক্তি হ্যাকিং অপরাধ করলে তিনি অনূর্ধ্ব ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন বা উভয় দণ্ড দেয়া যেতে পারে।
— তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে বা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নম্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
— তথ্য০প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৬৮ ধারায় আরও বলা হয়েছে, সরকার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের দ্রুত ও কার্যকর বিচারের উদ্দেশে এক বা একাধিক সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে।
তবে ২০০১ সালে টেলিকম্যুনিকেশন আইন পাস করা হলেও সাইবার ক্রাইম সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ২০০৬ সালে সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিলের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলেও আজও তা সংসদে উত্থাপিত হয়নি।

কম্পিউটার বা ইন্টারনেট একদিকে মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, অন্যদিকে নারীর জীবনে বয়ে এনেছে নানা উপায়ে নির্যাতন। এর ব্যবহারের মাধ্যমে নারীদের অশ্লীলভাবে প্রকাশ করছে। ফলে একজন নারী যেমন মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, অপরদিকে নারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে।সমস্যা হলো বেশিরভাগ নারীই সমাজে সম্মানহানির ভয়ে অভিযোগ করে পরে আর রিপোর্ট করতে চাননা।শুধু আইরিনই নন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাইবার ক্রাইমের কারণে মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন আরও অনেক নারী। দিন দিন বেড়েই চলেছে এ ধরনের সাইবার বিড়ম্বনা। সমাজে নারীর প্রতি অন্যান্য নির্যাতন যেমন:যৌতুক, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী পাচারের পাশাপাশি নির্যাতনের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে সাইবার ক্রাইম। পারস্পরিক সম্পর্ক, ঈর্ষা, হতাশা, বিবাহ বিচ্ছেদ, ধৈর্যচ্যুতি, মানসিক বিপর্যস্ততা, সামাজিক অবক্ষয় প্রভৃতি কারণ এ ধরনের অপরাধের পেছনে দায়ী।এছাড়া এ ধরনের অপরাধ ঘটাতে অপরাধীকে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। কেননা তারা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে বসে খুব সহজেই এই ধরনের অপরাধ করতে পারে। তবে অনেকক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে নারীরা সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বেশি।যারা এ ধরনের অপরাধ করে তারা নারীদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে মনে করে। সাইবার ক্রাইমের নির্যাতিত নারীরা অনেকক্ষেত্রে পরিবার, কর্মস্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের কাছ থেকেও হেয়প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। প্রযুক্তি দিয়ে কখনো সাইবার ক্রাইম বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষত ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেয়েদের অনেক সচেতন হতে হবে। ফেসবুক ব্যবহারকারীকে অক্ষরসহ সংখ্যা দিয়ে বেশ শক্তিশালী একটা পাসওয়ার্ড দিতে হবে। পাশাপাশি ফেসবুকে প্রলুব্ধ করা নানা ধরনের লিংক আসলে সেই লিংকগুলো কখনো ক্লিক করা যাবে না। পাশাপাশি ফেসবুকে চ্যাট করার সময়ও সচেতন থাকতে হবে কার সঙ্গে কী চ্যাট করছি। কেননা অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় আত্মীয় কিংবা পরিচিত কোন ব্যক্তির পরিচয়ে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা হয়ে থাকে।

সর্বশেষ সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্নোগ্রাফি অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডের বিধান রেখে ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ বিল, ২০১২’ সংসদে পাস হয়েছে। যার মাধ্যমে নারী নির্যাতন অনেকটাই কমে আসবে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ এ আইন অনুযায়ী_
* কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি উৎপাদনের উদ্দেশে কোন নারী, পুরুষ বা শিশুকে প্রলোভন দিয়ে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্থির, ভিডিও বা চলচ্চিত্র ধারণ করলে বিচার প্রক্রিযার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদ- ও ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ- আরোপ করা যাবে।
* যদি কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে কারও সম্মানহানি করে বা কাউকে ব্ল্যাকমেইল করে বা করার চেষ্টা চালায় তবে বিচারক ২ থেকে ৫ বছর মেয়াদি কারাদ- আরোপ করতে পারবেন এবং তদুপরি, ১ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ- আরোপ করতে পারবেন।
* শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন ও বিতরণকারীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদ- এবং অধিকন্তু ৫ লাখ টাকা জরিমানা আরোপের বিধান রাখা হয়েছে।

তবে সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে নারী নির্যাতন বন্ধে শুধু আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয় বরং জরুরি  হলো এর যথাযথ বাস্তবায়ন।কেননা আমাদের দেশে নারীদের জন্য অনেক আইন রয়েছে, অথচ এর কার্যকারিতা নেই বললেই চলে।কিন্তু ভেবে দেখুন,এই আইনের বাস্তবায়নটা খুব কঠিন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কেননা মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন রেজিস্ট্রেশন করার নিয়ম মানা হয় না। যেখানে সেখানে সিম বিক্রি হয়ে থাকে। তাই এসব বিষয়গুলোও যদি কঠোরভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয় তাহলেই কেবল আইনটি কার্যকর করা সম্ভব হবে।এ ধরনের অপরাধের শিকার একজন নারী মামলা করলেও দেখা যায় মামলাগুলো আসে দীর্ঘদিন পরে। আর যদিও মামলা হয় সেক্ষেত্রে বিচারটা শেষ পর্যন্ত চলে না। আপস, হুমকি ইত্যাদি নানা কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এসব বিষয়গুলোর প্রতি সরকারের বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন।সর্বোপরি এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের নৈতিকতার বিকাশ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি।আসুন প্রযুক্তিকে আমরা আশীর্বাদ হিসেবে ব্যবহার করি;এর ব্যহার যেন আর মানুষের জীবনে অভিশাপ হয়ে উঠতে না পারে।আমরা ঐক্যবদ্ধ হই এবং প্রতিরোধ করি এর অপব্যবহারকে।একইসাথে আমরা সম্মান করতে শিখি সম্পর্কের গাঁথুনিকে,যার বেড়াজালই আজও টিকিয়ে রেখেছে এই সমাজকে।নারীকে ভোগ্যপণ্য  এবং জৈবিক সম্পর্ককে পণ্য হিসেবে নয়;বরং উভয়কেই সম্মান করতে শিখি।একটি সম্পর্ক যে শুধুই শারীরিক আনন্দ দেয়,এর চেয়েও বড় সত্যকে সম্মান করি যে- এভাবেই একটি নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয়।তাই এই সম্পর্কগুলো যেন আর অসম্মানিত না হতে পারে,আসুন আজ আমরা সেই প্রতিজ্ঞাই করি।

বদলে যাও বদলে দাও'এ ফিচার2তে Published by Eshita Binte Shirin Nazrul

No comments

Powered by Blogger.