মনের কোণে হীরে-মুক্তো-দুর্বৃত্তায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব দুর্নীতিবাজের মহামিলন by ড. সা'দত হুসাইন

দৈনিক পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমি এই লেখাটি শুরু করছি। প্রথম উদ্ধৃতাংশ নিম্নরূপ : 'এরপর সারা রাত জলসাঘরে চলত মদ ও নারীর জমকালো আসর। মাইজভাণ্ডারী গানের সঙ্গে সমান তালে চলত নাচ-গান আর ফুর্তি।


আসর শেষে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথির হাতে উপঢৌকন হিসেবে তুলে দেওয়া হতো ব্রিফকেস ভর্তি টাকার বান্ডিল। এক কর্মকর্তা জানান, স্যার মদ খেয়ে মাঝেমধ্যেই হাসতে হাসতে বলতেন, শেয়ারবাজারের টাকা নিয়ে এত হাউকাউ কেন? ওই টাকা তো আমার কাছে। ওই টাকা দিয়ে আমি জমি কিনেছি।' দ্বিতীয় উদ্ধৃতাংশটি নিচে দেওয়া হলো :
'এলাকায় ছাগল চুরি করে ধরা পড়ার পর তিনি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাসদ করতেন। এ সময় এলাকার একটি হত্যা মামলার আসামি হয়ে তিনি কুয়েত পালিয়ে যান। ছয় মাস পর দেশে ফিরে তথ্য গোপন করে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক পদে যোগ দেন। সেখানে তিনি অষ্টম শ্রেণী পাসের সার্টিফিকেট জমা দেন। দুই বছরের মাথায় তিনি চাকরিচ্যুত হন। এরপর ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একটি মেস ভাড়া করে নেন। সেখান থেকে তিনি জায়গা-জমির মামলা-মোকদ্দমা ও দালালি শুরু করেন।'
দেশের দুই প্রতিষ্ঠিত ধনকুবেরের জীবনের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে এই উদ্ধৃতাংশে। পত্রিকার এ রিপোর্টগুলো পড়ার সময় মনে হচ্ছিল এ যেন খুলনার এরশাদ শিকদারের জীবনের অপর পিঠ। বৃহত্তর বরিশাল জেলার এক বিত্তহীন পরিবার থেকে উঠে এসে চুরিদারি, ছিনতাই, জালিয়াতি, হত্যা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে খুলনা শহরের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হয় এরশাদ শিকদার। সেও লুটের টাকায় গড়া 'স্বর্ণকমলে' গানের জলসা বসাত, নেচে-গেয়ে রাত কাটাত। মানুষের ওপর অত্যাচার চালাত। সুযোগ বুঝে তাদের জোত-জমি, বাড়িঘর দখল করত। এমনকি টাকা-পয়সার জোরে মানুষের সংসার ভাঙত। ছলে-বলে-কৌশলে সম্ভ্রান্ত লোকের স্ত্রীকে ধরে নিয়ে এসে বিয়েথা করত। তারপর একদিন সব শেষ। খুলনা মহানগরীর সাবেক পুলিশ কমিশনার আনোয়ার ইকবালের বলিষ্ঠ পদক্ষেপে শিকদারের সব অপরাধ একে একে প্রকাশিত হলো। সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে আদালতে হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রমাণিত হলো। সব আইনি প্রক্রিয়ার শেষে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর হলো। এক জঘন্যতম অপরাধীর পরিণতি মানুষ প্রত্যক্ষ করল।
মামলার তদন্তকালে দেখা গিয়েছিল যে খুলনার অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এরশাদ শিকদারের সুসম্পর্ক ছিল। তাদের কেউ কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এরশাদ শিকদারকে সহযোগিতা করেছে। বিনিময়ে তারাও কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ গুমরে কেঁদেছে। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ দিয়েছে। তখন কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। অবশেষে স্বনামধন্য পুলিশ কর্মকর্তা আনোয়রুল ইকবালকে মাধ্যম করে আল্লাহ তার বিচার জনসমক্ষে প্রতিভাত করেছেন। বাড়াবাড়ি, বিশেষ করে জুলুমকারীর বাড়াবাড়ি আল্লাহ্ পছন্দ করেন না। সীমালঙ্ঘনকারীকে শাস্তি পেতেই হবে। এই অমোঘ বিধান থেকে নিস্তার নেই।
এরশাদ শিকদারের ফাঁসি হওয়ার পর অনেকেই আশ্বস্ত হয়েছিল যে বাংলাদেশে খুনি, ডাকাত, সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যু, জালিয়াত এবং ঘৃণ্য অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি পাবে। এদের সংখ্যা এবং প্রভাব কমে আসবে। দেশের নিরীহ মানুষ এবং মা-বোনদের এদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতে হবে না। দুঃখজনকভাবে তারা বুঝতে পারল, তেমনটি সহজে হবার নয়। আজ এত বছর পরেও দেখা গেল, অপরাধীরা একই পদ্ধতিতে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। সরকারি-আধাসরকারি এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এরা প্রাথমিকভাবে কিছু অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। সে অর্থ ব্যবহার করে তারা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছে। তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থেকে তারা সন্ত্রাস, অত্যাচার, অনাচারসহ অপরাধমূলক যাবতীয় কাজ চালিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। ক্ষতিগ্রস্তরা ভয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না। দু-একজন কিছুটা সাহস করে এগিয়ে এসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ-অনুযোগ করলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। হতাশ, হতোদ্যম হয়ে তারা নীরব হয়ে যাচ্ছে। লুটেরা অপরাধীর কাছে তাদের জীবন ও সম্পদ বন্ধক হয়ে পড়ছে।
অঢেল সম্পদ কতিপয় সন্ত্রাসীকেও এত বেশি ক্ষমতাশালী করে তোলে যে সংশ্লিষ্ট অনেক সরকারি, আধা সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে তার কব্জায় এসে পড়ে। এসব প্রতিষ্ঠানকে তারা যথেচ্ছ ব্যবহার করে। এ ছাড়াও অন্যায়ভাবে আহরিত সম্পদ ব্যবহার করে তারা নিজেরাও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যার আড়ালে তারা নতুন নতুন অন্যায়-অপকর্ম করার সুযোগ পায়। অপকর্মে পারদর্শী দুর্নীতিবাজকে নিজের প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করে সম্পদ লুণ্ঠন এবং অপরাধের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করে তোলে। পরিহাসের মতো শোনালেও এটি এক বাস্তব সত্য যে সরকার কর্তৃক অঙ্গীভূত অস্ত্রধারী আনসার তাদের ব্যক্তিগত পাহারায় নিয়োজিত থাকে, তাদের গাড়ির সামনে-পিছে চলে, রাস্তা-ঘাটে, অফিসে-আদালতে এবং পাড়ায়-মহল্লায় তাদের উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। অস্ত্রধারী আনসারদের তারা অনেক সময় সন্ত্রাসী ও দখলবাজির কাজে ব্যবহার করে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের শক্তির মহড়ায় এবং প্রয়োজন হলে সরাসরি শক্তি প্রয়োগ ও জালিয়াতির কাজে ব্যবহার করে। এসব পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
যতই দিন যাচ্ছে, ততই যেন এ ধরনের লোকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তাদের বেপরোয়া আচরণে সুস্থ সজ্জন ব্যক্তিরা-নাগরিকরা আতঙ্কিত। সমাজে সুশীল নাগরিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সন্ত্রাসী দুষ্কৃতকারীরা বুক ফুলিয়ে রাস্তা দখল করে চলছে। তাদের জলসায় ক্ষমতাবান কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, পীর-মুরিদ, শাস্তি প্রদানের জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিদের সমাগম ঘটছে। এরশাদ শিকদার ও তারই উত্তরসূরি এসব অশিক্ষিত, ভিন্ন রুচির অপরাধীর সঙ্গে উচ্চ শিক্ষিত, পদস্থ কর্মকর্তা এবং উঁচু স্তরের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গভীর সখ্যকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক ব্যবহার হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। একে শুধু রুচির অধঃপতন হিসেবেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আসলে এখানে লোভ বা 'গ্রিড' মূল উপধায়ক হিসেবে কাজ করেছে। অর্থপ্রাপ্তির লোভ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এক জায়গায় টেনে এনেছে। শিক্ষা, পদমর্যাদা বা সামাজিক স্তরের পার্থক্য সখ্য নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের 'শক, হুন, দল, পাঠান-মোগলের' মতো শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উঁচু-নীচু, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ- সবাই এক সূত্রে লীন হয়ে গেছে। আমার এক বন্ধু কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করেন। এই সুবাদে শত শত কর্মকর্তাকে খুব কাছে থেকে দেখার তার সুযোগ হয়েছে। তার মতে, এসব কর্মকর্তার সিংহভাগই লোভী, স্বার্থান্ধ এবং মতলববাজ। টাকা-পয়সার গন্ধ পেলে এরা অতীব অনৈতিক কাজ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। চাকরির অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই এরা সিনিয়র কর্মকর্তাদের সমান বৈষয়িক সুবিধা পেতে চায়। সিনিয়র কর্মকর্তারা ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের মতো প্রাচুর্য ও ধনৈশ্বর্যের মালিক হতে চান। বেতনভুক কর্মচারীর আয়-ব্যয়ের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা তারা মানতে নারাজ।
অন্যায়, বে-আইনি এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার জন্য একটি সিন্ডিকেট কাঠামো বিশেষ উপযোগী। এরশাদ শিকদার এবং তার উত্তরসূরি ছাগল চোর, তেল চোর কিংবা মুদি দোকানদার থেকে রাতারাতি ধনী-প্রভাবশালী হওয়া দুষ্কৃতকারীরা সিন্ডিকেট গড়ার কাজটি দক্ষভাবে করে থাকে। তারা মন্ত্রী, উপদেষ্টা, রাজনীতিবিদ, বেতনভুক পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সু-প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবীদের বিভিন্ন কৌশলে, বিশেষ করে অর্থ-সম্পদের লোভ দেখিয়ে দলভুক্ত করে। এরূপ সিন্ডিকেট গড়ার পর শুরু হয় সাধারণ মানুষের ওপর মারাত্মক অত্যাচার। তাদের জায়গা-জমি দখল করা হয়, সহায়-সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়, বাড়ির বৌ-ঝির দিকে হাত বাড়ানো হয়, সন্ত্রাসী আক্রমণে তাদের পর্যুদস্ত করা হয়, সন্ত্রাসী হুমকিতে তাদের জীবন বিষময় করা হয়। প্রয়োজনবোধে তাদের হত্যা করা হয়।
আল্লাহর ইচ্ছায় অথবা ভাগ্যচক্রে কালেভদ্রে এসব ধুরন্ধর সন্ত্রাসী বিপদে পড়ে যায়। সম্মিলিত সামাজিক শক্তির কাছে এরা পরাভূত হয়। গণমাধ্যমের সাহসী কর্মী-সাংবাদিক, নাগরিক গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় সচেতন ব্যক্তিরা এবং সৎ প্রকৃতির বিরল কর্মকর্তাদের ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগী প্রচেষ্টার ফলে এরূপ সর্বনেশে অপরাধী এবং সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় কাঠগড়ায় তোলা সম্ভব হয়। কখনো কখনো উপযুক্ত শাস্তিও হয়। সমাজকে বাঁচাতে হলে, নিরীহ মানুষকে এসব মারাত্মক অপরাধীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হলে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত শক্তিকে অটুট রাখতে হবে।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

No comments

Powered by Blogger.