বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৫৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ নাসির উদ্দিন, বীর উত্তম অসম সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার অন্তর্গত নকশী বিওপি।


১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা। ৩ আগস্ট শেষ রাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ৪ আগস্ট) মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করেন। তখন সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দলে ছিলেন নাসির উদ্দিন। তিনি যুদ্ধে শহীদ হন।
সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মদ চৌধুরী (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত)। এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে তাঁর বয়ানে। তিনি বলেন, ‘অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি (ব্রাভো [বি] ও ডেল্টা [ডি]) মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করি নকশী বিওপি। এর আগে তিন দিন ওই এলাকা রেকি করি।
‘বিওপি থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকের শালবনে এফইউপি (ফর্মিংআপ প্লেস) নির্ধারণ করা হয়। কাটআপ পার্টির জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয় ঝিনাইগাতী থেকে আসা রাস্তা ও সীমান্ত রাস্তার মিলনস্থল রাংটিয়ায়। ফায়ারবেস নির্ধারণ করা হয় পূর্ব দিকে শালবনের উঁচু টিলায়। সেখানে ছিল নালা।
‘সুষ্ঠুভাবেই মুক্তিযোদ্ধারা অ্যাসেম্বলি এরিয়া থেকে এফইউপিতে পৌঁছান। মাঝপথে নালা অতিক্রম করার সময় কোনো শব্দ হয়নি। পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি রাত তিনটা ৪৫ মিনিটে আর্টিলারি ফায়ার শুরু করার সংকেত দিই। সঙ্গে সঙ্গে আর্টিলারি গর্জে ওঠে। একই সময় পাকিস্তানি আর্টিলারির কামান ও মর্টার থেকেও গোলাবর্ষণ শুরু হয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একবার মাটিতে শুয়ে পড়া, আবার উঠে দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়া ছিল দুঃসাহসিক কাজ।
‘মুক্তিযোদ্ধারা (নাসির উদ্দিনসহ) এক্সটেনডেড ফরমেশন করে সামনে এগিয়ে যান। ওদিকে প্রি এইচ আওয়ার গোলাবর্ষণ শুরু হওয়া মাত্র আমাদের ডানে থাকা মেশিনগান ও আরআরও (রিকোয়েললেস রাইফেল) গর্জে ওঠে। আক্রমণের সব কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সাবলীল গতিতে চলতে থাকে। শত্রুরা (পাকিস্তান সেনাবাহিনী) প্রচণ্ডভাবে ঘাবড়ে যায়।
‘আমার বাঁয়ে হাবিলদার নাসির (নাসির উদ্দিন) অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে ক্ষিপ্রগতিতে এগোতে থাকেন। আমি নিজে নায়েক সিরাজকে (সিরাজুল হক, বীর প্রতীক, এই যুদ্ধে শহীদ) নিয়ে ডানে পাকিস্তানি বাংকার লক্ষ্য করে এগোতে থাকি। আমাদের মনোবল দেখে শত্রুরা তখন পলায়নরত। আমি সঙ্গে সঙ্গে চার্জ বলে হুংকার দিই।
‘মুক্তিযোদ্ধারা (নাসির উদ্দিনসহ) সঙিন (অস্ত্র) উঁচু করে রীতিমতো দৌড়াতে থাকেন। নায়েব সুবেদার মুসলিম এ সময় উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য ঘন ঘন “জয় বাংলা-নারায়ে তাকবির” ধ্বনি করলে মুক্তিযোদ্ধারা “জয় বাংলা-ইয়া আলি” স্লোগান দিয়ে যুদ্ধের ময়দানকে প্রকম্পিত করে তোলেন।
‘নাসিরসহ মুক্তিযোদ্ধারা যখন শত্রুশিবিরের মাত্র ১০০ গজের মধ্যে, ঠিক তখনই শত্রুদের নিক্ষিপ্ত একটি আর্টিলারির শেলভো ফায়ার (এয়ার ব্রাস্ট) এসে পড়ে তাঁদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন মাটিতে ঢলে পড়েন। এর মধ্যে হাবিলদার নাসিরও ছিলেন। আমার ডান পায়েও স্প্লিন্টার লাগে। এ সময় আমাদের কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। অন্যরা এগিয়ে যান। দেখতে পেলাম, আমাদের গুটিকতক মুক্তিযোদ্ধা পলায়নরত শত্রুদের মারছেন। কেউ কেউ মাইনফিল্ডে ফেঁসে গিয়ে উড়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধক্ষেত্রটা যেন তখন মহাশ্মশান।’
নাসির উদ্দিন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে। কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান)। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। ১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ছুটিতে বাড়িতে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধকালে আশুগঞ্জের যুদ্ধে অংশ নেন। পরে ভারতে যাওয়ার পর তাঁকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত নকশী যুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ নাসির উদ্দিনকে মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৬।
শহীদ নাসির উদ্দিনের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার রামরাইল ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর (সাবেক গাইঙ্গাহাতা) গ্রামে। তাঁর বাবার নাম লাল মিয়া, মা আম্বিয়া খাতুন। স্ত্রী সুফিয়া খাতুন। তাঁর এক মেয়ে ও তিন ছেলে।
শহীদ নাসির উদ্দিনের স্ত্রী ও ছেলেরা বর্তমানে হতদরিদ্র অবস্থায় দিনযাপন করছেন। সুফিয়া খাতুন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। কিন্তু সামান্য টাকায় তাঁর দিন চলে না। তিনি বলেন, ‘যৌবনকালে আমার স্বামী দেশের জন্য জান দিলেন। দেশও স্বাধীন হলো। কিন্তু আমার মাথা গোঁজার ভালো ঠাঁই নাই। কত লোকের কাছে গেলাম, আকুতি জানালাম, কিছুই হয়নি।’
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শহীদ নাসির উদ্দিনের পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রামরাইল ইউনিয়নের একটি রাস্তার (বিয়াল্লিশ্বর থেকে সেন্দা পর্যন্ত) নামকরণ তাঁর নামে করা হয়েছে। ছেলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাবার নামে যাতে রাস্তার নাম না হয়, সে জন্য স্থানীয় অনেকে বাধা দেন। অনেক বাধাবিপত্তির পর শেষ পর্যন্ত হয়েছে। এতে আমরা শান্তি পেয়েছি।’
সূত্র: প্রথম আলোর সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি মো. বদর উদ্দিন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.