প্রমিত বাংলা বানান-মাতৃভাষার দুর্গতি দূর করতে হলে by নাসির আহমেদ

সরকারি সব দফতরে বাংলা বানানের শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানানরীতি অনুসরণের জন্য গত ৩১ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। পরিপত্রটি খুব ছোট্ট খবর হিসেবে প্রায় সব দৈনিকেই ভেতরের পাতায় সিঙ্গেল কলামে ছাপা হয়েছে।


কিন্তু ছোট্ট পরিসরে মুদ্রিত হলেও খবরটি ছোট নয়। কারণ মাতৃভাষা যে কোনো জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সে ভাষা যদি জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বিশুদ্ধতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে তাকে কোনোভাবেই ছোট ঘটনা বিবেচনার অবকাশ নেই। অন্যান্য দেশ ও জাতির মাতৃভাষার চেয়ে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার একটা বিশিষ্টতা আছে। এ ভাষা গৌরবে অতুলনীয়। তবে দুঃখের বিষয়, আমাদের মহান ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিময়ে যে মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জিত, সেই বাংলা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকদের ২৩ বছরের শাসনামলে তো উপেক্ষিত ছিলই, এমনকি স্বাধীনতার চার দশক পরও উপেক্ষিত। যেখানে আমাদের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত, অফিস-আদালতসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক, সেখানে আইন লঙ্ঘন করেই বাংলার পরিবর্তে অধিকাংশ আমলা বহু বছর ধরে ইংরেজি ব্যবহার করতেই উৎসাহী। এমনকি দেশের আদালতগুলোর দু'চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ রায় লেখা হচ্ছে ইংরেজিতে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি যে কী চরম উদাসীনতা, তা-ই প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। আমাদের জাতীয় জীবনের অগ্রগতির পথে যে অন্তরায়, তারও স্বরূপ মিলতে পারে এই উদাসীনতার মধ্যেই।
এ রকম বাস্তবতায় যখন সরকার শুদ্ধভাবে, প্রমিত বানান রীতিতে সরকারি অফিসে বাংলা লেখা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়, তখন সঙ্গত কারণেই আমরা আশাবাদী হই। বাংলা একাডেমী প্রণীত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান নিঃসন্দেহে প্রমিত বানান রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য শব্দভাণ্ডার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে দেশের আদালতসহ অনেক সরকারি দফতরেই বাংলা ভাষা উপেক্ষিত, উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন অঙ্গনে পরিভাষা তৈরির পরও মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয়নি, সেখানে সরকারি অফিস-আদালতে বাংলা একাডেমীর অভিধান অনুসরণে প্রমিত বানান নিশ্চিত করা কতখানি সম্ভব? আগে তো চাই বাংলা ভাষা ব্যবহারটা নিশ্চিত করা। যারা সরকারি আইন এবং সাংবিধানিক বাধ্য-বাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করে দাফতরিক কাজে ইংরেজি ব্যবহার করছেন, তাদের বিরুদ্ধে সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কি নিশ্চিত করতে পারবে? যদি পারে, তাহলে যারা আমাদের অস্তিত্বের অনিবার্য ঠিকানা মাতৃভাষাকে স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পরও উপেক্ষা করে চলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না? এ সত্য তো কারও অজানা নেই যে, যদি ১৯৪৮ সালে ভাষার ওপর আঘাত না আসত, তাহলে হয়তো বাঙালি জাতীয়তাবাদ দ্রুত এত বিকশিত হতো না। ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পথ ধরেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ সারাদেশে দানা বেঁধেছিল। আর সেই সংগ্রামের পথ ধরেই ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির বিজয় সূচিত হয়।
পরবর্তী ইতিহাস তথা ষাটের দশকের নানা আন্দোলনের পথ ধরে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয়, একাত্তরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকথা কমবেশি সবারই জানা। এর সবকিছুর মূলে কাজ করেছে মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম ও জাগরণ। স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার যে ভাষা আন্দোলন, সেই ভাষা কেমন করে উপেক্ষার শিকার হয়_ এ এক বিস্ময়কর প্রশ্নই বটে। ভাষাসংগ্রামী আইনজীবী গাজীউল হক আজীবন উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় লেখানোর জন্য আন্দোলন করে গেছেন। তারপরও দু'একজন ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবাই ইংরেজিতে রায় লিখে যাচ্ছেন। এর চেয়েও বড় কথা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যেখানে তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হয়েও জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়ে এ ভাষাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মহিমান্বিত করলেন, যে ভাষা আন্দোলনের অমর দিন একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, সেই ভাষা নিজ দেশেই উপেক্ষিত হবে কেন! বিস্ময়কর হলেও এখন পর্যন্ত এ প্রশ্নের উত্তর নেই। উত্তর পাওয়া যেতে পারে সরকারপ্রধান যদি এ ক্ষেত্রে অনমনীয় হন। যদি তিনি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় দাফতরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহারে আমলাতন্ত্রকে বাধ্য করেন।
যা-ই হোক, মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক দিন ধরে যে অনাচার চলছে, সেই অনাচার বন্ধ করতে সরকারি অফিসে শুদ্ধ বানান প্রতিষ্ঠার যে সরকারি উদ্যোগ, সেই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কারণ, বাংলা ভাষা নিয়ে অনাচার চলছে। যার যেমন খুশি বানানে বাংলা লিখে শিশু-কিশোরসহ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ভুল বানান, ভুল শব্দ, ভুল বাক্য ছড়ানোর যে অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলা একাডেমীর অভিধান অনুযায়ী বানান চালুর এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার মতো। বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষও এ জন্য ধন্যবাদ পেতে পারেন। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত বানানরীতি প্রতিষ্ঠার পর প্রায় অর্ধশতাব্দী কেটে গেছে আমাদের একটি ভালো অভিধান পেতে। ১৯৮৪ সালে একাডেমী একটি সত্যিকারের পূর্ণাঙ্গ অভিধান রচনা ও প্রকাশ সম্পন্ন করে। বাংলা বানানের ক্ষেত্রে দেশের পণ্ডিত, ভাষাবিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি প্রমিত বানানরীতিরও প্রচলন আশির দশকেই করে একাডেমী। কিন্তু তারপরও এই অভিধান সর্বত্র ব্যবহার বাধ্যতামূলক ছিল না। ফলে কেউ সংসদ অভিধান, কেউ বাংলা একাডেমী অভিধান, কেউ অন্যান্য অভিধান অনুসরণ করে এমন জগাখিচুড়ি বানান চালু করেছে_ যা শুধু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে গেছে। এমনকি কোনো কোনো পত্রিকা নিজেদের মতো করে বানানরীতি চালু করেছে, যা তরুণ প্রজন্মকে বানানে বিভ্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট।
ভাষার এই দুর্গতি আর দুর্যোগ দেখে শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা 'বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা'র শেষ চারটি পঙ্ক্তি মনে পড়ে_ '...এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি/এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তিখেউড়ের পৌষ মাস!/তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,/বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা'। বাংলা ভাষার প্রমিত বানান বা সর্বত্র একই রীতির বানান চালু করা যে কত জরুরি, সেটা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধান এবং আমাদের পাঠ্যপুস্তক, সংবাদপত্র, মুদ্রিত কাগজপত্রের দিকে সচেতনভাবে তাকালে মর্মে মর্মে টের পাওয়া যায়। প্রতিদিন বিভ্রান্তিকর বাক্য আর শব্দে আকীর্ণ হয়ে বেরুচ্ছে নানা রকম ছাপা কাগজ-প্রকাশনা। এমনকি স্কুল-কলেজে যারা বাংলা পড়ান, তারা নিজেরাও যে ভুল বানান, ভুল শব্দ, এমনকি ভুল বাক্য লিখছেন_ অনেকে নিজেও জানেন না। শর্ষের মধ্যে যদি ভূত থাকে তাহলে আর ভূত তাড়াবেন কী দিয়ে? এই যে 'কী' আর 'কি' এই ভিন্ন অর্থের দুটি শব্দ কখন কোন অর্থে কোথায় ব্যবহার হওয়া উচিত_ তাও তো আমরা অনেকে জানি না। এ রকম অজ্ঞতার, মূর্খতার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে চলছে এখন মাতৃভাষা শিক্ষা। মাতৃভাষা বলে এ যেন শেখার প্রয়োজন নেই! ভাবটা অনেকের মধ্যে এ রকমই। 'আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন'_ রবীন্দ্রনাথের এই বেদবাক্যতুল্য অমোঘ সত্য সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত। রাশিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, চীন, জাপানসহ অনেক উন্নত দেশ মাতৃভাষার প্রশ্নে আপসহীন। তাদের শিক্ষাসহ সবকিছু চলে মাতৃভাষায়। আমাদের নীতিনির্ধারকরা শুধু তা উপলব্ধি করলেন না।
প্রমিত বানান সরকারি অফিসে অনুসরণের সরকারি আদেশ অবশ্যই ধন্যবাদযোগ্য। কিন্তু আরও জরুরি ভিত্তিতে যা প্রয়োজন, তা হলো_ প্রতিটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার জন্য প্রমিত বানান অনুযায়ী বই রচনা, লেখাপড়া, সংবাদপত্রগুলোতে বাংলা বানানের সমতা বিধানের বাধ্যবাধকতা এবং টেক্সটবুক বোর্ডসহ সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বইয়ে একই বানানরীতি চালু আজ সময়ের দাবি। ভুল বানান, ভুল শব্দ, ভুল বাক্য প্রতিরোধের জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক। শিক্ষকদেরই আগে শুদ্ধ বাক্য, শুদ্ধ শব্দ ও বানান শেখানোর একটা প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার। বহু স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ শিক্ষকই না জেনে ভুল বাক্য লিখছেন। বহু নামিদামি পত্রিকায়, খ্যাতনামা সাহিত্যিকের বইয়ে ভুল শব্দ, ভুল বাক্য, ভুল বানান অহরহ চোখে পড়ছে। একাডেমীর প্রমিত বানান অভিধান হয়তো বানানের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অনেকখানি সহায়ক হবে। কিন্তু ভুল শব্দ, ভুল বাক্য রোধ করতে তো চাই শুদ্ধ ব্যাকরণ জ্ঞান আর শব্দের পরিচয় জানা। কোনটা তৎসম, কোনটা অর্ধতৎসম, কোনটা দেশি আর বিদেশি শব্দ, তা না জানলে অথবা না চিনলে ভুল বানানের সন্দেহই তো হবে না। তখন অভিধান কাছে থাকলেই কী, না থাকলেই কী?
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ল। দৈনিক বাংলার প্রবীণ সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব ১৯৮০ সালে একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিককে বললেন, তুমি এত ভুল বানান লেখ কেন? এত ঠিক করে দিই, তাও ভুল-শুদ্ধ বুঝতে পারো না! সেই লেখক জবাবে যা বললেন, তাতে হাবীব ভাই স্তম্ভিত। তার সন্দেহই হয় না_ কোনটা ভুল! তাহলে শুধরাবেন কেমন করে? 'বাধ্যগত শব্দটাই তো অভিধানে নেই। আছে 'বাধ্য' আর 'অনুগত'। অথচ হরদম লিখেই যাচ্ছি আমরা। পরিপ্রেক্ষিত বোঝাতে লিখে যাচ্ছি 'প্রেক্ষিত'। অথচ প্রেক্ষিত আর পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি শব্দ। ভিন্ন অর্থ। 'প্রচারণা' হচ্ছে মিথ্যে প্রচার বা অপপ্রচার, অথচ 'প্রচার' অর্থে লিখছি প্রতিদিন। 'প্রস্তাব' অর্থে লিখছি প্রস্তাবনা। অথচ প্রস্তাবনা হচ্ছে সূচনা বা ভূমিকা। আর প্রস্তাব হচ্ছে বেশকিছু উত্থাপন। হরদম দ্রুত অর্থে লিখে যাচ্ছি 'সহসা', অথচ 'সহসা' অর্থ হঠাৎ। 'সাযুজ্য', আর 'সাদৃশ্য' যে এক নয়_ ক'জন জানি তা। 'মধুমাস' মানে চৈত্রমাস। অথচ লিখছি ফলের মাস অর্থে। এমন কত যে অজ্ঞতায় দুর্গত আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা, তা বলে শেষ করার নয়। সুতরাং, জাতীয় পর্যায়ে বাংলা ভাষা নিয়ে সার্বিক শুদ্ধতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সেল খোলা দরকার। তা না হলে এই দুর্গতি দূর হবে না।

নাসির আহমেদ :কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.