মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: জনমত জরিপ- এই অপেক্ষা সারা পৃথিবীর by আলী রীয়াজ

তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মুখে টান টান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষমাণ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা। ৬ নভেম্বর মঙ্গলবার ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বারাক ওবামা কি পুনর্নির্বাচিত হবেন, নাকি বিজয়ী হবেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী মিট রমনি? এই অপেক্ষা শুধু মার্কিন নাগরিকদের নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের।


৫০টি অঙ্গরাজ্যে আগাম ভোট দেওয়া চলছে বেশ কয়েক দিন ধরেই। সর্বশেষ পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, ডাকযোগে এবং বিশেষ কেন্দ্রে গিয়ে এরই মধ্যে আগাম ভোট দেওয়ার সুযোগ নিয়েছেন কমপক্ষে ২৮ শতাংশ ভোটার। আগাম ভোটের হার মঙ্গলবার নাগাদ ৪০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এবারের নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র মোকাবিলা করছে দেশের ভয়াবহতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি। দেশটির কমপক্ষে ১১টি অঙ্গরাজ্য ৩০ অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির শিকার হয়েছে। কিন্তু তার পরও নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা এবং উৎসাহে ঘাটতি নেই। তবে এই ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য কারণে এবার ভোটারদের অংশগ্রহণ ২০০৮ সালের, এমনকি ২০০৪ সালের চেয়েও কম হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতীয় পর্যায়ের জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ওবামা ও রমনি দুজনের সমর্থন এখন সমান, ৪৮ শতাংশ করে। মাস দেড়েক আগেও বিশ্লেষকেরা অনুমান করতে পারেননি যে রিপাবলিকান প্রার্থী এতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করতে পারবেন। তবে ওবামার নির্বাচনী কর্মকর্তারা অনেক দিন ধরেই বলছিলেন, লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিশেষ পদ্ধতির কারণে সাধারণ ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনের চেয়ে প্রার্থীদের বেশি প্রয়োজন মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজের ২৭০টি নিশ্চিত করা। সেই বিবেচনায় দেশের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের হাতেই নির্ভর করছে নির্বাচনের ফলাফল। এ ধরনের রাজ্যের সংখ্যা এখন এসে দাঁড়িয়েছে আটটিতে—ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলাইনা, ভার্জিনিয়া, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ওহাইও, আইওয়া, কলোরাডো ও নেভাডা। এসব রাজ্যের সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, নর্থ ক্যারোলাইনা ও কলোরাডো ছাড়া সবগুলোতেই ওবামা সামান্য এগিয়ে আছেন। দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফ্লোরিডা, ভার্জিনিয়া ও ওহাইও। ওবামার জন্য এর যেকোনো একটিতে বিজয়ই পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কেননা, জনমত জরিপ অনুযায়ী, অন্য রাজ্যগুলো থেকে যথেষ্ট ইলেকটোরাল ভোট তিনি নিশ্চিত করতে পেরেছেন। এসব দোদুল্যমান রাজ্যের মধ্যে ফ্লোরিডায় ইলেকটোরাল ভোট সবচেয়ে বেশি হওয়ায় এবং অন্য রাজ্যগুলো থেকে সংগৃহীত নিশ্চিত ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি নয় বলে ফ্লোরিডায় না জিতে রমনি বিজয়ী হতে পারবেন না।
বিভিন্ন দোদুল্যমান রাজ্যের জনমত জরিপে ওবামা এগিয়ে থাকলেও অন্যান্য কিছু বিবেচনায় বিশ্লেষকদের অধিকাংশের অনুমান হলো, ওবামা সম্ভবত নর্থ ক্যারোলাইনা, কলোরাডো, ফ্লোরিডা এবং ভার্জিনিয়ায় বিজয়ী হবেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামা এগুলোতে বিজয়ী না হলেও তাঁর পাওয়া ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা হবে ২৮১। মিট রমনির পাওয়া ভোটের সংখ্যা দাঁড়াবে ২৫৭। বলাই বাহুল্য, এসবই হচ্ছে নির্বাচন-পূর্ব অনুমান। তার মানে, চূড়ান্ত ফলাফল কী হবে, তা নির্ভর করছে ভোটারদের ওপরই।
এবারের নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, ২০০৮ সালে বারাক ওবামার বিজয় যে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল, তা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ দেশের ইতিহাসে তাঁর নাম অবশ্যই আলাদাভাবে উচ্চারিত হবে। কিন্তু মঙ্গলবারের নির্বাচনের ফলাফল আরও কিছু কারণে এ দেশের ইতিহাসে আলাদাভাবে চিহ্নিত হতে পারে।
ধরা যাক, প্রেসিডেন্ট ওবামা পুনর্নির্বাচিত হলেন না, তা হলে তিনি হবেন এ দেশের ইতিহাসের নবম প্রেসিডেন্ট, যিনি পুনর্নির্বাচনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এই নয়জনের মধ্যে তিনজনই হলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের প্রেসিডেন্ট। এই তিনজন হলেন জেরাল্ড ফোর্ড (১৯৭৬), জিমি কার্টার (১৯৮০) ও জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (১৯৯২)। এঁদের মধ্যে দুজন রিপাবলিকান এবং একজন ডেমোক্র্যাট। যদিও ওবামার পরাজয় ঘটলে মোট সংখ্যায় পরাজিত ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্টের সংখ্যা রিপাবলিকানদের চেয়ে বেশি হবে না। কিন্তু তার অর্থ দাঁড়াবে, বিগত তিন ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্টের মধ্যে দুজনই পুনর্নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হলেন।
কিন্তু যদি প্রেসিডেন্ট ওবামা বিজয়ী হন, তবে তিনি হবেন ১৩তম প্রেসিডেন্ট, যিনি দ্বিতীয় মেয়াদে শাসনের সুযোগ পাবেন। পূর্ববর্তী ১২ জনের মধ্যে আছেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, যিনি চারবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। কেননা, সংবিধানে তখনো দুই বারের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাধা ছিল না।
এখন এটা প্রায় নিশ্চিত যে ওবামা জিতলেও তাঁর বিজয়ের আকার হবে ২০০৮ সালের জয়ের তুলনায় ছোট। অর্থাৎ, ২০০৮ সালে যতগুলো অঙ্গরাজ্যে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন, এবার ততগুলোতে বিজয়ী হবেন না তিনি, যার অর্থ হলো ২০০৮ সালে যে ৩৬৫টি ইলেকটোরাল ভোট তিনি পেয়েছিলেন, তা তিনি পাবেন না। সে ক্ষেত্রে তিনি হবেন দ্বিতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি তাঁর পুনর্নির্বাচনে প্রথমবারের চেয়ে কম ভোটে বিজয়ী হবেন। উড্রো উইলসন ১৯১৬ সালে তাঁর বিজয়ের সময় যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন, তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। কিন্তু উড্রো উইলসন দুজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, যাঁরা অতীতে দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মোট প্রাপ্ত ভোটের দিক দিয়েও উড্রো উইলসন ১৯১২ সালের চেয়ে কম ভোট পান ১৯১৬ সালে। ওবামার পাওয়া ভোটের পরিমাণ ২০০৮ সালে ছিল ৫৩ শতাংশ। এবার তাঁর এই ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ওবামা সাধারণ বা পপুলার ভোটে রমনির চেয়ে পিছিয়ে থাকতে পারেন এমন আশঙ্কাও রয়েছে। আগে থেকেই এমন আশঙ্কা ছিল। এখন ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির পর সে আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা, দেশের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভোটাররা যদি কম ভোট দেন, তাহলে ওবামার ইলেকটোরাল ভোট না কমলেও পপুলার ভোট যে কমবে, তা নিশ্চিত। আরও যেটা হতে পারে ঐতিহাসিক তা হলো, সাধারণ ভোটারদের মধ্যে সংখ্যালঘু ভোট পেয়েও ওবামা ইলেকটোরাল ভোটে নির্বাচিত হতে পারেন। এটা অবশ্য একেবারে ব্যতিক্রমী কিছু হবে না। কেননা, এর আগে চারবার এ রকম পরিস্থিতি হয়েছে। সর্বশেষ ২০০০ সালে জর্জ বুশ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আল গোরের চেয়ে কম ভোট পাওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ইলেকটোরাল ভোটে এগিয়ে থেকে এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণে। কিন্তু সে সময় ডেমোক্র্যাটরা এ নিয়ে বুশের প্রচুর সমালোচনা করেছিলেন।
রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনির বিজয়ও এক বিবেচনায় হবে ঐতিহাসিক। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মিট রমনি হবেন প্রথম মরমন ধর্মবিশ্বাসী প্রেসিডেন্ট। এ দেশের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের এক বিরাট অংশ মরমনদের খ্রিষ্টান মানতেই রাজি নন এবং তাঁদের ব্যাপারে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণা। যদিও নির্বাচনী প্রচারণার সময় এ বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে যাঁরা আগে আশঙ্কা করেছিলেন, তাঁদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তাতে এর গুরুত্ব কোনোভাবেই কমে যায় না। রমনির বিজয়ের আরেক তাৎপর্য হবে আদর্শিক। এ দেশের বিশ্লেষকদের মধ্যে ধারণা রয়েছে, কোনো ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট যদি দৈনন্দিন জীবনে রাষ্ট্রের সম্প্রসারিত ভূমিকাকে আইনি করে তুলতে পারেন, তবে মার্কিন ভোটাররা তা সমর্থন করেন। রমনি এবং তাঁর দল এই নির্বাচনে রাষ্ট্রের ভূমিকা কমানোর কথাই সবচেয়ে জোর দিয়ে বলেছেন। তাঁর বিজয় এটাও প্রমাণ করবে যে মার্কিনরা দৈনন্দিন জীবনে রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ বিষয়ে এখনো সন্দিহান।

No comments

Powered by Blogger.