বিশ্বাস খুনি by নাসরীন জাহান

চারপাশে শীতালু ঘুটঘুটে আঁধার। দূরে কোথাও গলা ছেড়ে কাঁদছে কুকুর। আর কান্নার শব্দে এমনই যন্ত্রণাকর ঠাণ্ডা, হাড়মাংস এক হয়ে যায়, ইন্দ্রিয়ের মধ্যে কী জানি কী হতে থাকে, মনে হয় মহাকাশ থেকে ভেসে আসছে শিঙ্গার শব্দ, এক্ষুনি কেয়ামত হবে। ওসমান বালিশ খামচে ধরে।


এত পাতলা ওয়ার, নখ গেঁথে যায় গাদা গাদা তুলোর মধ্যে। ওসমান উঠে বসে। দলের সবাই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ঘুমাচ্ছে। ক'রাত ধরে কারো চোখে ঘুম নেই। তোফায়েল সারা বিকেল চক্কর খেয়ে জানাল আপাতত এই এলাকাটা নিরাপদ। কাল নতুন অপারেশনের কথা চিন্তা করা যাবে।
কিন্তু কুকুর কাঁদছে কেন?
তোফায়েল নিঃসাড় হয়ে ওসমানের পায়ের ওপরে। সেই হাত সন্তর্পণে সরিয়ে ওসমান বাইরে আসে।
ঠা ঠা শীতের ঝাপটায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। শিশিরে ভিজে যাচ্ছে মাথা। স্তব্ধ গ্রামের দিকে তাকিয়ে ওসমান তোফায়েলের কথা ভাবে। মিলিটারিগুলো ধুপধাপ ওদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে। ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করতে করতে মুখে ফেনা তুলে জলের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।
এখানে যারা আছে তাদের সবারই অভিজ্ঞতার মধ্যে কমবেশি বিষ মেশানো। কিন্তু তোফায়েলই আলাদা। ওর অদ্ভুত গভীর চোখ, পাগলাটে চুল, শিশুর মতো হাসি, এমনই মুখ ওর, যেন মাথায় বোমা পড়লেও সেখানে বিষণ্নতা গ্রাস করবে না।
সে এই দলের একমাত্র নির্মল আনন্দ।
মাঝে মাঝে সেই আনন্দ ভয়ানক বিরক্তিতে রূপান্তরিত হয়। একদিন গানবোট নিয়ে মিলিটারিরা গ্রামে এসে নামে। এ খবর পেয়ে ওসমানের লিডার আলতাফ ভাই যখন গভীর আলোচনায় ব্যস্ত, তখন কোত্থেকে একটি প্রজাপতি ধরে এনে তোফায়েল সবার মাথার ওপর উড়িয়ে দিল। আলতাফ ভাই সটান দাঁড়িয়ে ওর গালে কষে একটা চড় বসালে আলোচনার হাওয়াই যায় পড়ে।
ধীর পায়ে হেঁটে তোফায়েল নিঃশব্দে দূরের মাটির টিলার ওপর গিয়ে বসেছিল। আলতাফ ভাই তীব্র রোষে ওসমানকে বলে, কোত্থেকে তুমি একে ধরে এনেছ? ঠিকমতো ট্রেনিং পর্যন্ত নিতে পারেনি, খামখেয়ালিপনার জন্য। এভাবে হবে না, ওকে বিদায় করে দাও।
একটি ছেলে দেশকে ভালোবাসে, মিনমিন করে ওসমানের কণ্ঠ, দেশের জন্য যুদ্ধ করতে চায়, তাকে নিরাশ করি কী করে? ওর তো ভয়ডর কিছু নেই। তথ্য দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য তো করছে।
এভাবে একদিন ও মরবে।
আলতাফ ভাইয়ের কথা শুনে ওসমান হাসে, আমরা কি বাঁচার কথা চিন্তা করে যুদ্ধ করছি?
কুকুরের ডাকে অমঙ্গল অনন্ত সেই রাতে এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়। কিছু দূরেই পাহাড়। সকালের ঝকঝকে আলোয় প্রাণবন্ত পাহাড়টি ওসমানের অবসাদগ্রস্ত চোখকে টান করে তোলে। কুয়াশা গিলে রোদ হয়ে উঠেছে আশ্চর্য রূপসী।
সেই প্রখর আলোয় উল্টেপাল্টে ওসমান নিজের স্মৃতিকে একের পর এক ঝলসে নিয়ে থাকে। রক্তের মধ্যে কী জানি কী হয়, চোয়ালের হাড় খাড়া হয়ে ওঠে। ওদের উঠোনের সামনে সার বেঁধে দাঁড় করানো হয়েছিল সবাইকে। রেহেলে কোরআন ভাঁজ করে রেখে বৃদ্ধা মা এসে দাঁড়িয়েছিল সেই সারির সমান্তরালে। খাকি কুত্তামুখো লোকগুলোর হাসির তোড়ে ওদের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। ওসমান কঠিন হাতে মাকে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখেছিল মায়ের মুখ। কী প্রগাঢ় চাউনি সম্মুখ দিকে, যেন আগ্নেয়াস্ত্র নয়, সম্মুখে ক্যামেরা ফিট করা, ওদের ছবি তোলা হবে।
ঝটকায় একজন পাকিস্তানি আর্মি ওসমানকে টেনে আনল নিজের দিকে, ওসমান একটু বেশিই লম্বা, সুশৃঙ্খল সারির মধ্যে একে বেখাপ্পা ঠেকছে। এই ছিল ওদের বক্তব্য। এইবার সারিটাকে উল্টোদিক থেকে দেখা। একদম ঢেউয়ের মতো, দূরবর্তী পাহাড়ের মতো, লম্বা হয়ে শিশুদের দিকে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। এদের হাসি দেখে শিশুরাও হাসছিল, কী রকম চাপা বিস্ময়ে, কিছু বুঝে উঠতে না পেরে, যেখানে হাসি শিশুরা সেখানে বিপদের কিছু কী করে দেখবে? এরপরেই গর্জে উঠল অস্ত্র।
খাকি লোকগুলোর সপক্ষে দাঁড়িয়ে একটি সমান্তরাল লাইনের ভূপাতিত হওয়ার দৃশ্য দেখার পর থেকেই মূলত ওসমানের যুদ্ধের শুরু। পশুর পক্ষে হত্যাকে এত শিল্পমণ্ডিত আর জমকালো করে তোলা সম্ভব নয়। তাকে যখন পাকিস্তানিরা বাঘের খাঁচায় ফেলে দিয়ে আহত অবস্থায় আবার তারা তুলে আনল, তার তৃষ্ণার্ত জিভে ঢুকিয়ে দিল শিশ্ন, খা পানি খা, কী বিষাক্ত গন্ধময় জল, সেসব ভাবতে ভাবতে অর্ধমৃত মানুষদের মাঝখানে শুয়ে মহান পশুদের কুর্নিশ করেছে। সৃষ্টিকর্তা এদেরকে বোধবুদ্ধি দেয়নি বলে এই সরল প্রজাতিকে মানুষ কতই না ঘৃণা করে রেখেছে। ওসমান বিশ্বাস করত, হত্যাকারী, মাতাল, পরধন লুটকারী সশস্ত্র মানুষের মধ্যে একটা পর্যায় পর্যন্ত তার কিছু মূল্যবোধ থাকে, যা মানবিক, যা সুন্দর, মানুষ তার মানবিকতার শেষ অংশ খুইয়ে নিঃস্ব হতে যেতে চায় না। নাৎসি সৈনিকরা ঠিক কতটা বর্বর ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হতবাক ওসমানের চোখে ম্লান হয়ে আসছে নাৎসির চেহারা। অবশ্যই ওরা সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন বর্বর ছিল না, খাকিমুখো লোকগুলোর পারদর্শিতার কাছে ওদের আরো অনেক কিছু শেখার ছিল।
এরপর ওসমান সেই লাশের স্তূপ থেকে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পালিয়েছে। জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায়, ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে একসময় হাসপাতালে।
সুস্থ হওয়ার পর তার পৃথিবীটাই যায় পাল্টে। সেই পৃথিবীর মধ্যে হিলহিলে ঘৃণা, বিষ, আউলা বিক্ষিপ্ত যন্ত্রণাকর অতীত আর কিছু নেই। সে স্থানীয় ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে মেজর ইশতিয়াকের অধীনে একটি অপারেশনে সফল হয়। এরপর ঢেউ খেতে খেতে এখানে। আলতাফ ভাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার। কিন্তু ওসমানের সঙ্গে তিনি সাধারণ শ্রমিকের মতোই মেশেন। প্রাণখোলা, নির্ভীক, যখন কাজ, তখন এত সিরিয়াস, তার মুখের দিকে তাকানো যায় না। অন্য সময় প্রাণখোলা, সবার দিকে সমান সতর্ক দৃষ্টি।
তালপাতার বাঁশি...
যেন পাহাড় থেকে রোদ্দুর ভেঙে কচলে এক করে দিয়ে ভেসে আসছে, ফরফর ওড়ে ওসমানের কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া, বিড়ির সেই ধোঁয়া ফুঁড়ে উঠে যা, নিষ্পলক ঠাণ্ডা চোখ, বেড়ার এপাশে দাঁড়িয়ে হাটফেরত মানুষের দিকে চেয়ে একা একাই কথা বলত, এইটুকুন তেল দিয়া কয়জনের রান্দা অইবো? তাও দেহো না লইয়া যাইতাছে, বউ পোলাপান হয়তো পথ চাইয়া বইয়া রইচে, হেয় যাইবো, রান্না অইবো, মায়ের ভাবনা ছিল চিরকালই শব্দময়। একটি ছোট পিঁপড়ের জন্য তার কত আশা। বাবার মৃত্যুর পর রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার আত্মার সঙ্গে একা একাই কথা বলত।
কে বাজাচ্ছে বাঁশি? ওসমান ঘাড় তোলে, কোমর ভাঙা কাঁঠালগাছটার ওপর বসে তোফায়েল যেন তার বাঁশির মধ্যে সব কান্না ঢেলে দিচ্ছে।
ওসমানের ঝাঁজালো চোখ ছায়া হয়ে আসে। তার মধ্য থেকে ঘাই দিয়ে ওঠে এক নারী_কত দীর্ঘ বছরের প্রতীক্ষায় তাকে শুধু এক সন্ধ্যায় নিজের করে পেয়েছিল সে। সেই পাওয়ার মধ্যে ছিল, 'এই রাত তোমার আমার, ওই চাঁদ তোমার আমার'_এর মতো অপরিসীম বেদনা, মানুষের শ্রান্তির মধ্যে যে এত বেদনা থাকতে পারে তা সেই অভূতপূর্ব গান এবং সন্ধ্যার মিলনের মধ্যে অনুভব করেছিল সে। তারপর যুদ্ধ।
কে কোথায় ছিটকে গেল। সেই নারী তার মৃত আত্মায় লুকিয়ে যেতে থাকা রক্তকণা এখন।
ওসমান!
ডাক শুনে পেছনে ফেরে।
বিচলিত দেখায় আলতাফ ভাইকে। ওসমানকে ভেতরে নিয়ে সবার উদ্দেশে বলে, শুনেছি ওরা গ্রাম ছেড়ে যায়নি, তোফায়েল ভুলোমনা ছেলে, ওর ওপর ভরসা করা আমাদের ঠিক হচ্ছে না। ও ঠিক খবর জোগাড় করতে পারেনি। ওরা পাহাড়ের ওপাশটার কোনো এক স্থানে ক্যাম্প গেড়েছে।
ওসমান অস্থির বোধ করে, কী বলছেন এসব? তাহলে কাল রাতে আমাদের মহাসর্বনাশ হতে পারত। কে আপনাকে দিয়েছে এই তথ্য?
আলতাফ ভাই স্থিরকণ্ঠে বলে, দেখ, এটুকু সচেতন আমাকে থাকতে হয়। দুপুর নাগাদ আমি নিশ্চিত সংবাদ পেয়ে যাচ্ছি, তা যদি সত্যি হয়, তবে আজ রাতেই ওদের ওপর আক্রমণ চালাতে হবে। ওরা এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। শুনেছি আরেকটা ট্রাক সন্ধ্যা নাগাদ এসে থামবে, ওদের প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না, আপাতত ভুল তথ্য দেয়ার জন্য তোফায়েলকে শাস্তি দেয়া যাক। ওসমানের মুখ বিবর্ণ হয়ে ওঠে। আলতাফ ভাইয়ের ক্রোধ সে চেনে। এই শিশুর মতো ছেলেটাকে নিয়ে ওসমান কী করবে? এখনো দিব্যি পাতার বাঁশি বাজিয়ে চলেছে।
ওসমান ম্লানকণ্ঠে বলে, ও সচেতনভাবে কিছু করেনি, কেউ হয়তো ওকে ভুল তথ্য দিয়েছে।
ওসমান! গর্জে ওঠে আলতাফ ভাই, এটা আবেগ বা ভাবের জায়গা না। ওর অসচেতনতার কারণে কত বড় ক্ষতি হতে পারত আন্দাজ করতে পারছ? ওর ম্যাড়ম্যাড়ানি ভাবটা যাতে কাটে সেজন্যই ওকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার।
এরপর সেই কুঁজো কাঁঠালগাছটার মধ্যেই পায়ে রশি বেঁধে অস্ত দুপুর তোফায়েলকে ঝুলিয়ে রাখা হলো।
যখন ওকে নামানো হয় ওর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। ফরসা সুন্দর মুখটায় জড়ো হয়েছে রাজ্যির ছাই, ঢোক গিলে কান্না সামলে সে শুধু এইটুকু উচ্চারণ করল, আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রমাণ করব এই কাজে আমার অনীহা ছিল না। পাহাড়ের কাছে বাস করা যে কৃষকের ওপর আমি নির্ভর করেছিলাম, সে আমাকে বিভ্রান্ত করেছে।
এরপর বিকেল থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
রেডিওর নব ঘুরিয়ে ভারত ধরলে নানা রকম যন্ত্রণায় ভেতরটা গুঁড়িয়ে যায়। কোথায় কিভাবে পাকবাহিনী জেট বিমান হামলা চালাচ্ছে, বিল্ডিং, মসজিদ, হাসপাতাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে_নানাবিধ সংবাদে মন হয়ে ওঠে বিক্ষিপ্ত। এর মধ্যে যখন রাত্তিরের মিশনের জন্য মস্ত প্রস্তুতি পাকা, তখন তোফায়েলের অন্তর্ধান ওসমানকে বিষণ্ন করে তোলে।
ও একটা আস্ত হাবা, আলতাফ ভাই বিরক্তি চাপতে পারে না, একজন সাবালক পাকবাহিনী যার ওপর এত অত্যাচার করেছে, কোথায় তার ভেতর প্রতিশোধের আগুন জ্বলবে, তা না, তালপাতার বাঁশি বাজায়, তুমি কি ভাবছ, ও মনের দুঃখে আত্মহত্যা করতে গেছে? মোটেও না, ওর কাছে এসব শাস্তি-ফাস্তি কিছু না, বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই দেখলাম কী একটা বিষয় মনে পড়ায় ফিকফিক করে হাসছে। যদি জেগে থাকে ভালোই হয়েছে। এটা ঘরবাড়ি না ওসমান, এখানে এসব মায়ামমতা করেছ তো নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল দিয়েছ। তুমি বুঝতে পারছ না, যেকোনো কারণেই হোক ও সুস্থ নয়। হয়তো অত্যাচারের কারণেই মাথায় কোথাও গোলমাল হয়েছে।
কেমন শিশুর মতো আচরণ করে। ওসমান, তৈরি হও, ওকে নিয়ে সময় নষ্ট করার মতো অবস্থা এখন আমাদের নেই।
তবুও ওসমানের ভেতর থেকে বেদনা যায় না। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা যখন এক হয়ে শত্রু শিবিরে আক্রমণের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে একীভূত, যখন ওসমানের বিচলিত কান বারবার সতর্ক হয়ে ওঠে, এই বুঝি তোফায়েল এলো। ওর মুখের মধ্যে কী জানি কী আছে_ওসমান তার মা-বাবা, সেই সন্ধ্যায় যারা সশস্ত্র বুভুক্ষু নিয়ে এই মুখের ওপর ভর করেছিল। সে অনুভব করে, তার ভেতর থেকে কিছু সরেনি, কিছু লুকায়নি, কেবল ঘাস উঠেছিল বলে তলার ভেজা আঁটিটা দেখা যাচ্ছিল না।
ক্রম ঘনায়মান রাত্তির।
এই বিরান প্রান্তরে কোত্থেকে যে কুকুর ডাকে।
এর আগের অপারেশনে ওসমানদের সঙ্গে মিত্রবাহিনী ছিল। এবারের পুরো প্রোগ্রামটিই আলতাফ ভাইয়ের দ্রুত সিদ্ধান্তের ওপর তৈরি। ফলে দলের সবার মধ্যে একটি বাড়তি চাপ তৈরি হয়, যা কেউ আবার কাউকে বুঝতে দিতে চায় না।
সন্ধ্যার পর পরই ওরা বেরিয়ে পড়ে। ঠা ঠা শীত। কাঁটা, ঝোপ, মাঠ, জঙ্গল পেরিয়ে ওরা যখন শত্রু অবস্থানের একদম কাছাকাছি, তখন আলতাফ ভাইয়ের নির্দেশের অপেক্ষায়, তখন অকস্মাৎ ওসমানের মনে এই প্রশ্ন জাগে ওরা আগেই এই পাহাড়ের কাছে আছে তো? অন্ধকার পেত্নীর মতো কালো দাঁত কিড়কিড় করছে। মানুষ বাস করবে অথচ সন্ধ্যার পর একফোঁটা বাতি কোথাও জ্বলবে না? আঁধারের মধ্যে তাঁবুর মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু স্পষ্ট হচ্ছে না।
তারা যেরকম দক্ষতার সঙ্গে এ পর্যন্ত এসেছে, শত্রুর যদি চারপাশে দশ চোখ দশ কান থাকে তবুও কোনোভাবে বোঝার কথা না, এই সন্দেহের কথাটাই সে বলতে চায় আলতাফ ভাইকে। কিন্তু সে বেশ কিছুটা দূরে, আচমকা ওসমানের কী হয়, তার ভেতর আর সেই ক্যামেরার দিকে চেয়ে থাকা চোখ দুটো মিটমিট করে ওঠে সেই দৃশ্যের শব্দ তীব্র এক আকুতি নিয়ে তার করোটির মধ্যে ঝনঝন শব্দ তোলে।
উত্তেজনায়, ঘৃণায় ভেতর থেকে তীব্র শীত অন্তর্হিত হয়ে যায়। ওসমানের ভেতর কেউ যেন একটি অগি্নপিণ্ড ঢুকিয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে সেই অদৃশ্য তাঁবুর মধ্যে বসে এসব জীব মরা হাড্ডি চিবোচ্ছে, চারপাশের ঘুটঘুটে গাছপালা মুহূর্তে টলে ওঠে। যেন কারো নির্দেশ ছাড়াই এই মুহূর্তে ওসমানের অবচেতন হাত ট্রিগারে চাপ দেবে।
এই যখন অবস্থা।
সবাইকে বিমূঢ় হতবাক করে মুহূর্তে পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। সেই অন্ধকার অবস্থান থেকে সারি সারি অস্ত্র গর্জে উঠেছে, ও মাই গড। এটুকু বলে আলতাফ ভাই মুহূর্তে উবু হয়ে ওই অবস্থান পাল্টে নেয়।
অন্য সবার সঙ্গে ওসমানের অসাড় দেহ শীত ঘাসের স্তূপের মধ্যে ঢলে পড়ে। ওসমান শুধু এইটুকু স্মরণ করতে পারে, আস্ত আকাশটা এক আজব কারিশমায় ক্ষুদ্র এক নক্ষত্রে পরিণত হয়েছিল।
এরপর ঘোরের মধ্যে ছিন্নবিচ্ছিন্ন স্বপ্ন, সে তোফায়েলের লাশ কাঁধে করে পাহাড়, নদী অতিক্রম করছে, সেই সন্ধ্যার নারী তাকে দেখে বলছে, তোমাকে এখন নেকড়ের মতো দেখাচ্ছে কেন? হাসপাতালে অর্ধমৃত মানুষদের মাঝখানে নিজেকে জীবিত আবিষ্কারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অন্য এক প্রশ্ন, সেদিন ঠিক কী হয়েছিল?
এরপর কুয়াশা, এরপর রাত্তির, ক্ষতস্থান ফুঁড়ে প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে একটিই প্রশ্ন, কী হয়েছিল?
কী অপরিসীম ক্রন্দন!
কোত্থেকে ভেসে আসছে গো? নাকি মায়ের কোরআন তেলাওয়াত_এমনই ক্রন্দনময় ছিল সেই কণ্ঠ। চোখ প্রসারিত করে। কোনো মানুষের সম্পূর্ণ রূপ নেই এখানে, গজ, ব্যান্ডেজ, প্লাস্টারে সব ঢাকা পড়ে গেছে। জ্ঞান ছিল না, সেই এক ভালো ছিল, মগজ কচলে এক করে দিয়েছে নানা রকম কৌতূহল, ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে যায়।
কী শান্তি! মৃত্যু কি এর চেয়ে বেশি শান্তি দিতে পারে? সেও তো এক ধরনের অনন্ত ঘুম, যার বোঁটা ছিঁড়ে ঝপাত করে সে এই স্বর্গবাসীদের মাঝখানে এসে পড়েছে, সব ছায়া হয়ে আসার সময় অস্ফুট ঠোঁট নড়ে ওঠে, লাঙল নিয়ে কে যাচ্ছে গো?
আমি।
কোনে গো?
পাহাড় চাষ করতে।
পাহাড়, শীত রাত্তির, আলতাফ ভাইয়ের ও মাই গড, এরপর ঘুম।
যেন চোখের সামনে আতশি কাচ, ঝলক দিয়ে ওঠে, তার মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধীর মুখ, তার সঙ্গে ও কে? ইয়া বড় গোঁফ? ঘুম ভাঙার পরও ওসমানের ঘোর কাটে না, কর্নেল ওসমানী? কী বলছে ওরা? বেদনার্ত কান উন্মুখ হয়, ওরা বলছে, মেঘের মতো, বৃষ্টির মতো সেই শব্দ_এই মাসের মধ্যেই আমরা স্বাধীনতা পাব।
এটা কোন মাস?
পরের উনি্নদ্র রাত উল্টেপাল্টে যেতে থাকে মাসের হিসাব গুনতে গিয়ে। তোফায়েল, ওই তালপাতার বাঁশিটা আবার বাজা, এই দেখ দেখে আমি তলিয়ে যাচ্ছি...। ওসমান কার হাত চেপে ধরে।
কে?
আমি সাইফুল।
সাইফুল কে?
আমাকে চিনছেন না? একসঙ্গে এতদিন যুদ্ধ করলাম, এরপর যেন বাতাসের মতো কিছু শব্দ আছড়ে পড়ে ওসমানের কানের কাছে, জানেন ওসমান ভাই, বীরের মতো সম্মুখযুদ্ধ করতে করতে মারা গেছেন আলতাফ ভাই? গুট্টু, বাবলু ওরাও নেই। তোফায়েল ছিল ওদের চর, এখান থেকে সব সংবাদ নিয়ে ওদের দিত।
স্টপ! স্টপ! চেঁচাতে গিয়ে ওসমানের পুনরায় সমস্ত দেহ শিথিল হয়ে আসে।
এরপর চোখের সামনে সাদা ছাদ ছাড়া কিছু নেই।
সমস্ত যন্ত্রণা, বীভৎস খিঁচুনি জমা হয়ে কণ্ঠে, ওসমান আর্তনাদের মতো করে বলে ও আল্লা? এত জঘন্য আলো ঢুকছে কোত্থেকে! আমাকে কঠিন দোজখে নিক্ষেপ কর তোমরা, আমিই ওকে বিশ্বাস করেছিলাম, আমিই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছি।

No comments

Powered by Blogger.