খালেদা জিয়ার ভারত সফর- নীতি পরিবর্তন নিয়ে বিএনপিতে দুই মত

সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ ও ট্রানজিটের মতো বিষয়গুলোতে সব সময় সোচ্চার থেকেছে বিএনপি। কিন্তু এবার ভারত সফরের সময় বিরোধীদলীয় নেতা এসব বিষয়ে তেমন উচ্চকণ্ঠ ছিলেন না।


বরং দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক-উন্নয়নের স্বার্থে ক্ষমতায় গেলে ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে প্রশ্রয় না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন খালেদা জিয়া।
বিএনপির চেয়ারপারসনের ভারত বিষয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দলের নেতৃত্বের অপর অংশ মনে করছে, এ সফরের মধ্য দিয়ে বিএনপি সম্পর্কে ভারতের সংশয় দূর হয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্কে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে দলের একাংশ প্রকাশ্যে না বললেও এটা মনে করছে, দলীয় চেয়ারপারসনের সাম্প্রতিক বক্তব্যের ফলে ভারতবিরোধী অস্ত্রটি ভবিষ্যতে ব্যবহার করা দলটির জন্য দুরূহ হয়ে পড়বে।
বিএনপির একটি অংশের মত, খালেদা জিয়াকে দিল্লিতে উষ্ণ আতিথেয়তা দেওয়ার মধ্য দিয়ে কংগ্রেস সরকারের বিএনপি সম্পর্কে বৈরী মনোভাবের পরিবর্তনেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এ মনোভাব বজায় থাকলে সফরটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
অবশ্য দলের অপর অংশটির মত, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপসকামী মনোভাবই প্রকাশ করেছে বিএনপির নেতৃত্ব। কারণ, ভারত সব সময় অভিযোগ করে আসছে, তার দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিয়েছে বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির শাসনামলে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের প্রসঙ্গটি ভারত জোরালোভাবে উল্লেখ করে। এমন এক প্রেক্ষাপটে ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে ঠাঁই দেওয়া হবে না বললে ভারতের অভিযোগ জোরালো ভিত্তি পায়।
ফলে নির্বাচন সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে দলটির ভিন্নমতাবলম্বীদের অভিমত। বিশেষ করে ভারত বিরোধীদলীয় নেতার সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ায় দলের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিনের সন্দেহ আর অবিশ্বাস দূর করতে ছাড়ের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে করে আগামী নির্বাচনে দল শেষ পর্যন্ত কতটা লাভবান হবে, সেটি একমাত্র সময়ই বলে দেবে। আবার দলের নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, অতীতে বিএনপির ভারতবিরোধিতার একপেশে নীতি সঠিক ছিল না।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির ভারতবিরোধিতার জন্য আওয়ামী লীগ ও ভারতের সরকারগুলো দায়ী। কারণ, তারা শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে পোষ্যপুত্রের মতো সম্পর্ক গড়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের নীতি প্রণয়ন করে।’
এ প্রসঙ্গে দলের আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা এম কে আনোয়ার বলেন, ‘কেন আমরা ভারতবিরোধী হলাম, তারা বুঝতে পেরেছে। একটি দলের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে অন্য দলগুলো থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন ভারত এক পা এগিয়ে এসেছে, আমরাও এগিয়ে গিয়েছি।’
বিএনপির ব্যাপারে ভারতের মনোভাব পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বিএনপির নেতারা দুটি বিষয়কে সামনে আনছেন। একটি হচ্ছে, তাঁদের মতে, ভারত মনে করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা কম।
আরেকটি মত হলো, গত মে মাসে ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরের সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতে বলেছিলেন, ‘কোনো একটি দলের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চায় ভারত।’ মওদুদ ও এম কে আনোয়ার—দুজনেই এ বক্তব্যকে মনোভাব পরিবর্তনের সংকেত বলেছেন।
খালেদা জিয়ার ভারত সফরের প্রেক্ষাপটে বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে বলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করা হয়েছে—এমন খবর গণমাধ্যমে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা কোনো পদস্থ কর্মকর্তা জামায়াত সম্পর্কে এ ধরনের কথা খালেদা জিয়াকে বলেছেন বলে আমরা জানি না। পত্রিকাগুলো এসব লিখে বাতাস গরম করেছে।’
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারত সফরে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান ও ঢাকা মহানগর আমির রফিকুল ইসলামের বৈঠক হয়। চীন সফরে যাওয়ার আগেও এ দুই নেতার সঙ্গে কথা হয় বলে জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়। এ দুই নেতা দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে আছেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে বিএনপি। তাই ক্ষমতায় যাওয়ার স্বার্থে বিএনপি যদি আমাদের ত্যাগ করে, তাতে আমরা মোটেও চিন্তিত হব না। কারণ, আমাদের হারাবার কিছু নেই।’

No comments

Powered by Blogger.