শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন- কৃষকবন্ধু ফিরোজ by বরুন রায়

বছর আটেক আগের কথা! পাবনার বেড়া পৌর এলাকার হাতিগাড়া মহল্লার এম আর এম ফিরোজ (৩৫) নামের এক যুবকের মাথায় ঢুকেছে ঘাস চাষের পোকা। জমিতে যে ঘাস চাষ করা যায়, বেড়ার কৃষকেরা সে তথ্য জানতেনই না।


ফিরোজ কয়েকজন কৃষককে অনেক বুঝিয়ে ঘাস চাষ করান। প্রথমবার তিনিই খরচপাতি দেন। এরপর যা ঘটল, সে কথা এলাকাবাসীর জানা।
অন্য ফসলের তুলনায় ঘাস চাষে লাভ বেশি—দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল কথাটা। বেড়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে সাঁথিয়া, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, চাটমোহর ও শাহাজাদপুরে কয়েক হাজার বিঘায় এখন ঘাসের আবাদ হচ্ছে। শুধু ঘাস চাষেই সীমাবদ্ধ নেই ফিরোজের কীর্তি, কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতির চাষে আগ্রহী করতে অক্লান্ত খেটে চলেছেন মানুষটি। এ জন্য এলাকার কৃষকদের নিয়ে গড়েছেন একটি কৃষিক্লাব। নিজের টাকায় কিনেছেন বেশ কিছু কৃষিযন্ত্র। ধান চাষ ও মাড়াইয়ের সময় কৃষকেরা বিনা খরচে এসব যন্ত্র তাঁর কাছ থেকে ধার নেন।
শুরুটা যেভাবে: ২০০৪ সালের শুরুর দিকে বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটায় খামারিদের নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন ফিরোজ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত খামারিরা বারবার গো-খাদ্যসংকটের কথা বলছিলেন। সেই অনুষ্ঠানই তাঁকে ঘাস চাষে অনুপ্রাণিত করে। বাড়ি ফিরে ঢাকায় ঘাসের বীজের একাধিক আমদানিকারকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি; নেন প্রশিক্ষণ। কৃষকদের ‘জাম্বো’ জাতের ঘাস চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু তেমন সাড়া মিলেনি। ওই বছর তিনি বেড়া ও সাঁথিয়ার ২০ জন কৃষককে বিনা মূল্যে বীজ ও চাষের খরচ দিয়ে ঘাস চাষে রাজি করান। ঘাসের ফলন ও লাভ দেখে চাষিরা অভিভূত।
ফিরোজ বলেন, ‘গবাদিপশু পালনে বিখ্যাত এ এলাকায় ঘাস চাষের জন্য আমাকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে। তবে ভেবে ভালো লাগে যে ঘাস চাষের কারণে এলাকার কৃষক ও গো-খামারিরা যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন।’
এবার অন্যদের পাশে: ঘাস চাষে ব্যাপক সাফল্য ফিরোজের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। ২০০৯ সালে কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় তিনি ‘বেড়া কৃষিক্লাব’ গড়ে তোলেন। বেড়া পৌর এলাকার হাতিগাড়া, শম্ভুপুর ও পায়না মহল্লার অর্ধশতাধিক কৃষক এখন এই ক্লাবের সদস্য। ফিরোজ এর সভাপতি। বেড়া স্টেডিয়াম মার্কেটে ফিরোজের রয়েছে বীজ ও কীটনাশক বিক্রির একটি দোকান। নাম সোনালি বীজ ভান্ডার। নামে দোকান হলেও এটি আসলে বেড়া কৃষিক্লাবের কার্যালয়। ফিরোজ হাতিগাড়া এবতেদায়ি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন বলে সকালে দোকান খুলতে পারেন না। দোকান খোলা হয় বিকেল চারটার দিকে। সন্ধ্যা হলেই এখানে একে একে ভিড় জমান কৃষিক্লাবের সদস্যরা।
কৃষিভিত্তিক প্রচুর বই ও সিডি জোগাড় করে রেখেছেন ফিরোজ। লেখাপড়া জানা সদস্যদের বইগুলো দেন। যাঁরা লেখাপড়া জানেন না, ফিরোজ তাঁদের বসিয়ে বইগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ পড়ে শোনান। সিডিগুলো দোকানে চালিয়ে কৃষকদের দেখান। এ ছাড়া ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে তাঁর দোকানে নিয়মিত কৃষিভিত্তিক আলোচনা চলে।
অসচ্ছল কৃষকদের কৃষিক্লাব থেকে নগদ টাকা ও কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতি) দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ জন কৃষককে সার, বীজ ও নগদ টাকা মিলিয়ে লক্ষাধিক টাকার সহায়তা দেওয়া হয়।
হাতিগাড়া গ্রামের বর্গা চাষি জুনায়েদ হোসেন বলেন, ‘আগে সুদে টাকা ধার কইর‌্যা চাষ করত্যাম। কিন্তু ফিরোজ ভায়ের কৃষিকিলাবে ভর্তি হওয়ার পর আর টাকা ধার করা লাগে না। এ বছরেও চাষ করার জন্য কৃষিকিলাবের থ্যা দুই হাজার টাকা, এক বস্তা ইউরিয়া সার, ৩০ কেজি লাল সার ও ২৬ কেজি মাইট্যা সার পাইছি।’
যন্ত্রপাতি ও টাকা দিয়ে সাহায্য: ফিরোজের কাছে একটি ড্রাম সিডার, পাঁচটি নিড়ানি যন্ত্র, চারটি কীটনাশকের সেপ্র মেশিন, ধান মাড়াইয়ের একটি যন্ত্র, একটি ধান কাটার যন্ত্র, দুটি বড় ফ্যান (ধান ওড়ানোর জন্য) ও একটি সেচযন্ত্র রয়েছে। দুই বছর ধরে কৃষকেরা এসব যন্ত্র ধার নিয়ে চাষাবাদ করছেন।
পায়না গ্রামের সিদ্দিক আলী খান, ওসমান ফকির, তসলিম উদ্দিন; হাতিগাড়া গ্রামের রজব আলীসহ বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, কৃষকেরা পালা করে যন্ত্রগুলো ব্যবহার করেন। আগে সেচযন্ত্র ও সেপ্র মেশিনের জন্য দোকানে লাইন ধরতে হতো, গুনতে হতো প্রচুর ভাড়া। এখন বিনা টাকায় এসব যন্ত্র পাওয়া যায়।
হাতিগাড়া গ্রামের আলাউদ্দিন আলীর চোখে এখন খুশির ঝিলিক। কারণ, প্রায় আট মাস ধরে তিনি যে দুটি ছাগল পালন করছেন, তারা হূষ্টপুষ্ট হয়েছে। শিগগিরই এগুলো বাচ্চা দেবে। হতদরিদ্র আলাউদ্দিন স্বপ্ন দেখছেন এ ছাগল থেকে বাড়তি আয়ের। আলাউদ্দিন কিন্তু নিজের টাকায় এগুলো কেনেননি। ফিরোজই তাঁকে উন্নত জাতের ছাগল দুটি কিনে দিয়েছিলেন।
অর্থের জোগান মেলে যেভাবে: অসচ্ছল কৃষকদের সহায়তা ও কৃষিক্লাবের পেছনে সব মিলিয়ে বছরে প্রায় লাখখানেক টাকা ব্যয় হয়। এ ছাড়া ছাগল পালনের জন্যও বছরে অর্ধলক্ষাধিক টাকা ধার দিতে হয়। এই টাকার জোগান আসে কোত্থেকে—এমন প্রশ্নের জবাবে ফিরোজ জানান, ছোটবেলা থেকে বেড়া পৌর এলাকার হাতিগাড়া গ্রামে নানাবাড়িতে মানুষ হয়েছেন তিনি। এখনো সেখানেই বাস করেন। বর্তমানে তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা। তাঁর তিন মামা আমেরিকা প্রবাসী। ফিরোজকে খুব ভালোবাসেন তাঁরা। কৃষকদের পাশে ফিরোজকে এভাবে দাঁড়াতে দেখে প্রতিবছর এ বাবদ তাঁরা আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ফিরোজের কয়েকজন বন্ধুও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বেড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘ফিরোজ সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে চমৎকৃত হয়েছি। এককথায় তাঁকে কৃষকের বন্ধু বলা যায়। কৃষির উন্নয়নে এমন মানুষের খুবই প্রয়োজন।’

No comments

Powered by Blogger.