জেলহত্যা দিবস-খুনিদের বিচার হোক

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাসে যে কলঙ্কজনক অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ঘটেছিল কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মতো আরেক ন্যক্কারজনক ঘটনা, যা জেলহত্যা বলে ইতিহাসে পরিচিত।


১৯৭৫ সালের এইদিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ জাতীয় চার নেতাকে রাষ্ট্রীয় শক্তির মদদ ও সমর্থনেই হত্যা করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের এমন পরিকল্পিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড সারা পৃথিবীতেই বিরল। জাতীয় চার নেতা_ তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও অনুসারী। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারই নির্দেশনা অনুসারে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই চার নেতা। তারা সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। অথচ স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পরে সেই স্বাধীন দেশেরই কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যার শিকার হতে হলো তাদের। এ হত্যাকাণ্ড শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়নি, বরং সদ্য স্বাধীন দেশ থেকে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনা মুছে দেওয়ার লক্ষ্যে নেতৃত্বশূন্য পরিস্থিতি তৈরি করাও ছিল ঘাতকদের লক্ষ্য। জাতীয় নেতাদের এই হত্যাকাণ্ডের মূল্য দশকের পর দশক সামরিক শাসনের অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও পশ্চাৎপদ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জাতি পরিশোধ করেছে। অবশেষে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরে এলেও জাতীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মামলা এখনও বিচারাধীন। বিচারের প্রক্রিয়াটিই শুরু হয়েছে অনেক দেরিতে। ফলে খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীরা দীর্ঘদিন গুরুতর অপরাধ করেও দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে। স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য এটি লজ্জাকর। আইনের শাসনের ক্ষেত্রেও এটি বড় একটি প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় যারা চার নেতাকে হত্যা করল তাদের যথাবিহিত বিচার বিলম্বিত হতে থাকলে বারবার অনিবার্যভাবেই এ প্রশ্ন উঠবে। বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে সরকারগুলোর ধারাবাহিক ব্যর্থতা ছিল, আন্তরিকতার অভাবও ছিল প্রকট। অভিযোগ উঠেছে, বিগত জোট সরকারের আমলে আলামত নষ্ট করে মামলাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। যে শক্তিগুলো বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হত্যাকাণ্ড থেকে লাভবান হয়েছে, তারা সঙ্গত কারণেই মামলার বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইবে। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করেই ইতিবাচক শক্তিকে আন্তরিকতা নিয়ে এগোতে হবে। শুধু দিবসটি এলে এ সংক্রান্ত তৎপরতা প্রত্যাশিত নয়। বিচার প্রক্রিয়ায় গতি এনে অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হলে সরকার, বিচার বিভাগসহ সবার আন্তরিক তৎপরতা প্রয়োজন। জাতীয় চার নেতাকে হত্যার জন্য যারা দায়ী, যারা হত্যাকারীদের মদদদাতা_ সবার শাস্তি নিশ্চিত হওয়া দরকার। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে এমন রাজনৈতিক হত্যার প্রতিবিধান করা সম্ভব। এমনিতেই অনেক দেরি হয়েছে, আর দেরি বাঞ্ছনীয় নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতিটি পদক্ষেপে যে নেতাদের নেতৃত্ব ও নির্দেশনা পেয়েছে জাতি, তাদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য এ বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক। জেলহত্যা দিবসে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সেই বীর নেতাদের
উদ্দেশে আমাদের শোক ও শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.