খালেদার অবস্থান পরিবর্তনে দিল্লির ‘সতর্ক’ আশাবাদ

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে ভারত। তবে ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘প্রশ্রয় না দেওয়া’ আর ‘পেছনে নয়, সামনে তাকানোর’ বিষয়ে খালেদা জিয়ার প্রতিশ্রুতিকে দিল্লি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।


এই অভিমত ব্যক্ত করে ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বিএনপির চেয়ারপারসনের দৃষ্টিভঙ্গিকে দিল্লি স্বাগত জানালেও এটিকে ‘সতর্ক আশাবাদ’ হিসেবেই বিবেচনা করছে।
ঢাকা-দিল্লির রাজনৈতিক ও কূটনীতিক সূত্রগুলো গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার এবারের দিল্লি সফরে ভারত নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন চোখে পড়েছে। একইভাবে ভারতও তাঁর সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে যে শুধু সরকার নয়, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী দিল্লি।
খালেদা জিয়া এই এক সপ্তাহের সফর শেষে আজ শনিবার দেশে ফিরছেন। সফরের শেষ দিনে আজ সকালে তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। খালেদা জিয়া গতকাল দিল্লিতে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি নীতিন গাড়কারির সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।
দিল্লির কূটনীতিক সূত্র বলছে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে প্রশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে খালেদা জিয়ার আশ্বাসে সেখানকার সরকারি মহলের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে আশার সঞ্চার হয়েছে।
সেই সঙ্গে অতীতমুখী না হয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে তাঁর ভবিষ্যৎমুখী হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিও সেখানে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের সাবেক একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক বক্তব্যের পর ভারতের রাজনৈতিক মহলগুলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার চেষ্টা করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বন্ধুত্বের বিশেষ একটি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে বলে দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। বিশেষ করে, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উদার সহযোগিতার ভূয়সী প্রশংসা দিল্লি প্রতিনিয়ত করে চলেছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধান দুই বন্দর ব্যবহারসহ ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। এ ছাড়া বাণিজ্যসহ সহযোগিতার অন্য ক্ষেত্রগুলোতে অগ্রগতি হয়েছে বলে দুই পক্ষই দাবি করছে। যদিও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি কিংবা ’৭৪-এর সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়নের মতো চার দশকের অমীমাংসিত সমস্যা এখনো ঝুলে আছে। সব মিলিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে ‘সুস্থ পরিবেশ’ সৃষ্টি হয়েছে বলে ভারত মনে করে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে সহযোগিতার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে, এমন শঙ্কা থেকে ভারত তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার নীতিতে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক আহমেদ চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবার দিল্লি সফরে যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন, তা নিয়ে এখানে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছি। তবে এ কথা ঠিক যে, যেসব প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিবর্তন কেমন হবে, সেটি ভারত পর্যবেক্ষণ করবে।’
গত বৃহস্পতিবার দিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তারা মন্তব্য করেন, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর বিদায়ের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে জেঁকে বসবে তালেবান গোষ্ঠী। এরপর তালেবানরা পাকিস্তানের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করবে। আর পাকিস্তানের ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীর সম্পর্ক নতুন নয়। এমন এক পরিস্থিতিতে তালেবানের পুনরুত্থানে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মাথাচাড়া দেওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
যে প্রতিশ্রুতি খালেদা জিয়া ভারতের নেতৃত্বকে দিয়েছেন, তার ব্যত্যয় হলে এর প্রভাব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কেমন হবে, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কূটনীতিক মনে করেন, এর ফলে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে হতাশা সৃষ্টি হবে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে বর্তমানে যে ইতিবাচক আবহ তৈরি হয়েছে, তার পরিবর্তে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত নিয়ে খালেদা জিয়ার পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হলে তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি অগ্রগতি হিসেবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের জন্য সেটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
তবে খালেদা জিয়ার ভারত সফর নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করছে, খালেদা জিয়াকে নিয়ে ভারত সরকার বাড়াবাড়ি করেছে। বিশেষ করে তাঁকে যেভাবে আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে, সেটি যথার্থ কি না, তা নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের একাংশের মনে প্রশ্ন রয়েছে।
অন্যদিকে, বিএনপি নেতৃত্বের একটি অংশ খালেদা জিয়ার সফরকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে দেখতে চাইছে। তবে মাঝারি সারির কিছু নেতা মনে করেন, ভারত-বিরোধিতা বিএনপির একটি অন্যতম রাজনৈতিক অস্ত্র। খালেদা জিয়া সম্প্রতি ভারত নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে দলটির ভারত-বিরোধী অস্ত্রটি আর হাতে থাকল না।

No comments

Powered by Blogger.