দূরদেশ- বিরল ঘটনার জন্ম দিলেন ক্রিস ক্রিস্টি by আলী রীয়াজ

যুক্তরাষ্ট্রে এখন আলোচনার বিষয় দুটি—প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কখনো কখনো এই দুটি বিষয় একত্র হয়ে যাচ্ছে, তখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ঘূর্ণিঝড় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কি না,


ঘূর্ণিঝড়-উপদ্রুত এলাকায় ভোট গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হবে কি না, এই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও মিট রমনি তাঁদের প্রচারণা কীভাবে চালাবেন, এসব। কিন্তু মঙ্গলবার থেকে এই আলোচনায় যুক্ত হয়েছে আরও একটি বিষয়, আরও একটি নাম।
বুধবার দেশের গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের আলোচনায় বারাক ওবামার পাশাপাশি সেই নামটিই শোনা গেছে সম্ভবত মিট রমনির চেয়ে বেশি, তিনি হলেন ঘূর্ণিঝড়-বিধ্বস্ত নিউজার্সির গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি। এর কারণ এই নয় যে তাঁকে এই ঝড়ের ধকল সবচেয়ে বেশি পোহাতে হচ্ছে। কারণ, রিপাবলিকান দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও এই ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং তাঁর সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্রিস্টি বলেন, ঘূর্ণিঝড় শুরু হওয়ার আগ থেকেই প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন এবং তাঁর এলাকার মানুষের বিপদ মোকাবিলায় যা করা দরকার, সে বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন। বুধবার প্রেসিডেন্ট নিউজার্সির দুর্গত এলাকা সফরে গেলে গভর্নর ক্রিস্টি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সাংবাদিকদের সামনে তাঁরা দুজনই বক্তব্য দেন এবং সেখানেও তাঁরা বলেন যে তাঁরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করবেন।
গভর্নর ক্রিস্টির রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝার জন্য এটা জানাই যথেষ্ট যে অনেকেই আশা করছিলেন, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন চাইবেন। তাঁকে রাজি করানোর জন্য শীর্ষস্থানীয় নেতারা কয়েক দফা তাঁর রাজ্যে গিয়েও অনুরোধ করেছিলেন। ক্রিস্টি তাতে সম্মতি দেননি। সে সময় অনেক বিশ্লেষক অনুমান করেছিলেন যে তিনি ২০১৬ সালে প্রার্থী হওয়ার জন্যই এবার রাজি হচ্ছেন না।
গভর্নর ক্রিস্টি আদর্শিকভাবে কেবল ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধেই নয়, তিনি ওবামার একজন কট্টর সমালোচকও বটে। ওবামার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন সরাসরি। ক্রিস্টির একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি কথা বলেন সোজাসাপটা। ২০১০ সালে অর্থনীতিকে চাঙা করতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, কিন্তু ক্রিস্টি তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। কেননা নীতিগতভাবে এভাবে অর্থনীতি চাঙা করার বিষয়ে একমত নন। রক্ষণশীলদের চোখে তিনি হয়ে ওঠেন অনুকরণীয় নেতা। গভর্নর হিসেবে তিনি কর্মচারীদের ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন, শিক্ষা খাতে ব্যয় হ্রাসের জন্য অনেক স্কুলশিক্ষককে চাকরিচ্যুত করেছেন। এ কারণেই রিপাবলিকান দলের এ বছরের কনভেনশনে তিনি ছিলেন কি-নোট স্পিকার বা মূল বক্তা। সেই বক্তৃতায় ওবামার কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি মিট রমনির ঘোর সমর্থক।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও দেশের এই সংকটকালে তিনি দলীয় রাজনৈতিক পার্থক্যকে বিবেচনায় না নিয়ে ওবামা প্রশাসনের সাহায্য গ্রহণ করছেন এবং অকুণ্ঠ চিত্তে প্রেসিডেন্টের প্রশংসাও করেছেন। ওবামাও তাঁদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য বিবেচনায় না নিয়ে তাঁর সঙ্গে একত্রে কাজ করছেন। নির্বাচনের এত কাছের একটা সময়ে এ রকম একটি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ভিন্ন দলের প্রার্থীর প্রশংসা করে ক্রিস ক্রিস্টি সবার মনোযোগ কেড়েছেন। অনেকের ধারণা, এই কাজটি করে ক্রিস্টি জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সম্ভাবনার অবসান ঘটালেন। কেননা, এই নির্বাচনে যদি ওবামা বিজয়ী হন, তবে রিপাবলিকানরা তাঁকেই এর জন্য অংশত হলেও দায়ী করবেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত তাঁর রাজনৈতিক জীবনের জন্য আত্মঘাতী বলে রক্ষণশীলরা মনে করলেও দেশের এবং মানুষের প্রয়োজনে গভর্নর ক্রিস্টি তা থেকে পিছপা হননি। আর তা করার মাধ্যমে তিনি তো তাঁর ঘোরতর সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
গত চার বছরে মার্কিন রাজনীতিতে দুই দলের মধ্যে সহযোগিতার উদাহরণ বিরল। পারস্পরিক সমালোচনা ও বিরোধিতা অভূতপূর্ব পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ক্রিস ক্রিস্টির এই ভূমিকা তাতে একটা বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। অনেকে বলছেন, ওবামা-ক্রিস্টির এই সহযোগিতা থেকে অন্যদের শেখার আছে। যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন, এই ঘটনা থেকে তাঁদের জন্য কিছু শেখার আছে কি না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.