সুরের আলোয় জীবন চলা by জিয়াউর রহমান চৌধুরী

বাবা ওস্তাদ আফজালুর রহমান ছিলেন জন্মান্ধ। তাঁর দুই মেয়ে মহুয়া ও অন্তরাও তা-ই। বাবার মতোই সংগীতেও দারুণ পারঙ্গম দুই বোন। সংগীতই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। বাবার প্রতিষ্ঠা করা বিদ্যালয়ে শত শত শিক্ষার্থীর মধ্যে দুই বোন ছড়িয়ে দিচ্ছেন সুরের আলো


তিতাসপাড়ের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এখানেই জন্ম নিয়েছেন ওস্তাদ আফজালুর রহমান। সেতার, বেহালা ও সরোদের মতো বাদ্যযন্ত্রগুলোতে সুর বেজে উঠেছে তাঁর হাতের আপন মমতায়। সুরসম্রাট আফজালুর রহমান আজ আর নেই, নেই তাঁর সেই সুরও। তবলা, সেতার-সরোদ আজ আর বাজে না, বলে না তাঁর কথা। কিন্তু তাঁর সুরের সাধনা থেমে নেই। নিজে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় তাঁর মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সুরের আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সংগীত বিদ্যালয়। ইনার আইস ইনস্টিটিউশন ফর ব্লাইন্ডস। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় হাজারো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংগীতসহ ইংরেজিতে দক্ষতা, তথ্যপ্রযুক্তি আর সমাজসেবার পাঠ নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। আফজালুর রহমানের মৃত্যুর পর এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছেন দুই মেয়ে মহুয়া রহমান (রুবা) ও অন্তরা রহমান (টুংটাং)। আর সাহস জোগাতে তাঁদের পাশে আছেন মা আনোয়ারা রহমান। সব মিলিয়ে সংগীতই একসুতোয় বেঁধে রেখেছে এই পরিবারকে। যেখানে সীমাবদ্ধতা কোনো সমস্যা নয়, বরং কাজ করে অনুপ্রেরণা হয়ে। দুই বোনের কেউই বিয়ে করেননি। তাঁদের কাছে সংগীতই সব। সব বাবার রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটি।

বিদ্যালয়ের একদিন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইনার আইস ইনস্টিটিউশন ফর ব্লাইন্ডসের ছোট এক বাড়ির ভেতরে নিবিষ্ট মনে একদল ছেলেমেয়ে বেহালা, তবলা আর সেতার বাজিয়ে চলেছে। ছোট্ট বাড়িটার একচিলতে উঠোনে বসেছে নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সুরের মেলা।
উঠোনে জায়গা না পেয়ে বাড়ির সদর দরজায় আশ্রয় হয়েছে কারও কারও। যে যেখানেই জায়গা পেয়েছে, সে সেখানেই আসন পেতে বসেছে। আবার কেউ বা সমানতালে দুই হাতে তুলেছে তবলার বোল। সুরের এ পাঠশালায় দুই শিক্ষক মহুয়া আর অন্তরার কাছে তালিম নিচ্ছে নানা বয়সী ২০ শিক্ষার্থী। তবে, সুর সাধনায় ব্যস্ত শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকলেও একটা জায়গায় বড্ড মিল তাদের। কারণ, এদের প্রত্যেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সমাজের পিছিয়ে পড়া এই মানুষের মনের চোখ খুলে দিতেই ১৯৯০ সালে ওস্তাদ আফজালুর রহমান সংগীতশিক্ষার এ বিদ্যাপীঠটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিজে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় তাঁর মতো চোখের আলোহীন মানুষদের নিয়ে শুরু হয়েছিল এ বিদ্যালয়। তখন এর মূল পাঠ ছিল: অন্তরের চোখ দিয়ে দেখো। শুরুতে নাম ছিল ‘ইনার আইস ক্লাসিক স্কুল ফর ব্লাইন্ডস’ এখন সামান্য বদলে নাম হয়েছে ইনার আইস ইনস্টিটিউশন ফর ব্লাইন্ড।
ওস্তাদ আফজালুর রহমানের স্বপ্নের এ বিদ্যালয়ে এখন প্রতিদিন পড়তে আসে নানা বয়সের শিক্ষার্থী। এদের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতার শিকার। কেউ জন্মগতভাবে আবার কেউ বা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। তবে এদের সবার জীবনেই আলোর সন্ধান দিয়েছে ইনার আইস ইনস্টিটিউশন ফর ব্লাইন্ডস। এ বিদ্যালয়ের ছায়াতলে এসে দৃষ্টিহীন-আলোহীন এ মানুষগুলোই এখন নতুন করে মাথা তুলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। ‘আমরা কয়েক দিন আগেও নিজেদের জীবন নিয়ে ভুল ধারণায় ছিলাম। কিন্তু এ স্কুলে আসার পর মনে হলো, চোখে না দেখতে পারলেও আমি অন্য অনেক কাজ ভালোভাবেই করতে পারি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মানুষের চেয়েও আমি ভালো। যেমন আমি হয়তো হাতে ধরে অনেক কাজ করতে পারি না কিন্তু বেহালাটা আমি ভালোই বাজাতে পারি। একসময় নিজেকে অনেক ছোট মনে হতো, এখন আর এমন মনে হয় না। যা পারি না তা নিয়ে দুঃখ করি না। এ স্কুল সত্যিই জীবন বদলে দিয়েছে। সুরই এখন আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী।’ নিজের জীবন নিয়ে এ রকম আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাহবুবুর রহমানের।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সজীব এ বিদ্যালয় থেকে সংগীত শিক্ষা নিয়েছেন বছর পাঁচেক হলো। এখন তিনি কলকাতার শান্তিনিকেতনে সংগীত নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করছেন। দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় খোঁজ মিলবে এ বিদ্যালয়ের এরকম অসংখ্য শিক্ষার্থীর। যারা শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে হার মানিয়েছে সংগীত সাধনা আর মনের জোর দিয়ে। তাই মহুয়া অন্তরা মনে করেন তাঁদের মতো ইনার আইস ইনস্টিটিউশন ফর ব্লাইন্ডস বিদ্যালয়ে সংগীত আর বাদ্যযন্ত্র শেখার পর অনেকের জীবনই বদলে গেছে।

বাবার পথে মেয়েরা
ওস্তাদ আফজালুর রহমানের আদর্শ আর স্বপ্নের লালন করেই পথচলা দুই বোন মহুয়া আর অন্তরার। ‘বাবা জন্মের কয়েক বছর পরই অন্ধ হয়ে যান। কিন্তু তিনি চোখে দেখতে না পারলেও স্বাভাবিক মানুষের মতো অনেক কাজই করতে পারতেন। বাবা সব সময় বলতেন, ‘‘যারা চোখে দেখতে পারে না, তারা কিন্তু মনের চোখ দিয়ে আলোর খোঁজ ঠিকই পায়।’’ আর এ কারণে সমাজের অন্ধ মানুষের মনের চোখ খুলে দিতে তিনি ওই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, চোখ দিয়ে দেখতে না পাওয়া মানুষজন সুরের আলোয় নিজেদের মনের চোখে সব খুঁজে নিতে পারবে।’
মহুয়া আর অন্তরার সংগীতে হাতেখড়ি বাবার হাতেই। সেতার, বেহালা, তবলা আর সরোদ বাজানো বাবা তাঁদের নিজে হাতেই শিখিয়েছেন। এত দিনের চর্চায় যন্ত্রগুলো এখন তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় মুহূর্তেই সুর পেয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
বড় বোন মহুয়া জন্মেছেন ১৯৮০ সালে। আর ছোট বোন অন্তরার জম্ম ১৯৮৫ সালে। দুই বোনের মধ্যে মহুয়া পড়েছেন এইচএসসি আর অন্তরা এসএসসি পর্যন্ত। মহুয়া সবচেয়ে ভালো বাজান উপমহাদেশের অতি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র সরোদ। আবার দুই বোনই গান লেখেন, সুর করেন এবং সেগুলোতে কণ্ঠ দেন।
বাবার গড়া স্কুলে প্রতিদিন যেমন পালা করে সকাল-বিকেল চলে সংগীত আর বাদ্যযন্ত্র শেখানো, তেমনি এর পাশাপাশি শেখানো হয় কম্পিউটার আর প্রযুক্তির নানা বিষয়ও।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের উপযোগী করে দুই বোন মিলে তৈরি করেছেন অসংখ্য পাঠ—বইয়ের পাতা তাঁরা কণ্ঠে ধারণ করে নিয়ে পড়ানোর কাজটি করেন। এ প্রসঙ্গে অন্তরা রহমান বলেন, ‘বাবা সংগীত ভালোবাসতেন। তাই তিনি সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু পরে আমরা বুঝতে পারি, একজন শিল্পীর পাশাপাশি প্রযুক্তি ও অন্য সাধারণ জ্ঞানও থাকা প্রয়োজন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সব বিষয়েই দক্ষ হয়ে উঠতে হবে।’
সংগীতের পাশাপাশি গরিব ও অসচ্ছল পরিবারের শিশুরাও এ বিদ্যালয়ে গণিতসহ অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারে। বিনে পয়সায়। মূলত নিজেদের সংসারের আয়ের টাকা আর মা আনোয়ারা রহমানের সহযোগিতায় চলে এ বিদ্যালয়।
বড় বোন মহুয়া জাপানি, উর্দু আর ফারসির মতো বেশ কয়েকটি ভাষা জানেন। আর ছোট বোন অন্তরা দক্ষ প্রযুক্তি বিষয়ে। ‘আমরা সকাল হলেই রুবা আর টুংটাং আপুর কাছে চলে আসি। এখানে থাকতে আমাদের খুব ভালো লাগে। গান শিখি, কবিতা পড়ি। বিকেল পর্যন্ত আমাদের সময় ভালোভাবেই কাটে।’ আধো আধো বোলে এ কথাই বলতে চায় চার বছরের শিক্ষার্থী আনন্দ।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের নিয়ে এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে দুই বোনের, কাটছে মাস-বছর। মহুয়া-অন্তরার সর্বক্ষণের স্বপ্ন প্রতিটি প্রতিবন্ধী আলোকিত মানুষ হবে সক্ষমতা নিয়ে, সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবে। সুর আর জ্ঞানের আলোয় কেটে যাবে সব আঁধার।

No comments

Powered by Blogger.