কালের আয়নায়-জেলহত্যা এবং বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা ছিল একই বছরের ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অসমাপ্ত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। ১৫ আগস্টের প্রত্যুষে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার দ্বারা বাংলাদেশে যে রক্তক্ষয়ী প্রতিবিপ্লবের সূচনা তার সফল সমাপ্তি ঘটে ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চার নেতার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।


এই প্রতিবিপ্লবী সাফল্যের ধারাতেই ঘটে ৭ নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান, যা থেকে এর প্রকৃত চেহারা স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড যে একদলীয় বাকশাল শাসনের নিপাত কিংবা একজন নেতাকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা নয়, বরং যে আদর্শ ও লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা_ এর সরব প্রকাশ ঘটে ৭ নভেম্বর। আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সেক্যুলার ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্রকে বর্জন করে বাংলাদেশ আবার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধতাভিত্তিক পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় আদর্শে ফিরে গেছে। বাংলাদেশকে আর আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান ঘোষণা করা হয়নি_ কেবল বাংলাদেশ নামের বহিরাবরণটি রক্ষা করে পাকিস্তানের চেয়েও একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার দিকে যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশের সেক্যুলার রাজনৈতিক শক্তি ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানের মতোই মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি ঐক্যবদ্ধ হয়। পেছনে সক্রিয় মদদ জোগায় পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। তাদের পেছনে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নীতি ছিল পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত একটি ইসলামী জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করা, যা এ অঞ্চলে কমিউনিজমের প্রসার প্রতিহত করবে। সে জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে, আগে থেকেই যা ছিল পাকিস্তানের ছায়া দ্বারা প্রভাবিত_ তাকে নতুন করে ভারতবিদ্বেষী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়। তারা প্রেরণা লাভ করত তাদের পূর্বতন পাকিস্তানি সামরিক অভিভাবকদের কাছ থেকে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সময়ে আমাদের প্রতিবেশী ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পরম সুহৃদ ও বন্ধু ভারতের নীতি ছিল চাণক্যসুলভ। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের পাইকারি গ্রেফতার ও নির্যাতনের কারণে বিপর্যস্ত সেক্যুলার শক্তিকে সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে তারা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে 'অন্ধকার মেঘের ভেতরে সূর্যের আলো' হিসেবে অভিহিত করে। এমনকি তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক কথাটিও ভারতের রাষ্ট্রপতির মুখ থেকে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ভারত জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে পরবর্তী সেনাশাসক এইচএম এরশাদের আমল পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কখনোই রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করতে পারেনি। জিয়াউর রহমান এবং তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি বাংলাদেশের মাটিকে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হতে দিয়েছিল। স্পষ্টতই এটা ছিল পাকিস্তানের হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে প্রক্সি ওয়ার পরিচালনা। অন্যদিকে লে. জেনারেল এইচএম এরশাদের শঠতা ও প্রতারণা ভারতের তরুণ প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ধরে ফেলেন বাংলাদেশের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ ও উদ্ধার কাজের জন্য ভারতের দেওয়া হেলিকপ্টার ফেরত পাঠানোর ঘটনায়। এ সেনাশাসকের ধূর্ত আচরণ তার নিজের মুখোশই উন্মোচন করে দেয়।
তবে আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতিতে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক আর নেই। পাকিস্তান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের দ্রোন বিমান হামলায় বিপর্যস্ত। ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের মাটিতেই যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন সেনারা হত্যা করে লাশ নিয়ে নিরাপদে চলে গেছে সে দেশের শাসকদের কোনো রকম অবহিত না করেই। বাংলাদেশে চিরকালের ভারত-বৈরী বিএনপি তাই ভারতের দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য হয়েছে। তারা এটাও বুঝে গেছে যে, পাকিস্তানের আইএসআই নামের সংস্থাটিও আর আগের মতো শক্তিমান নেই। ভারত এ সুযোগে তাদের পুরনো বন্ধু আওয়ামী লীগের প্রতি দৃশ্যত পক্ষপাতিত্ব ত্যাগ করে খালেদা জিয়াকে কোলে টেনে নেওয়ার ভান করছে। এর একটিই ইতিবাচক বা ভালো দিক_ দিলি্লর শাসকদের খুশি করার জন্য খালেদা জিয়া যদি ভারতবিরোধী নীতি ত্যাগ করেন, জামায়াতে ইসলামীর আশ্রয় থেকে বের হয়ে আসেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা ও বিদ্বেষের একটি জোয়ার যে সর্বদা বহমান তার অনুপস্থিতিতে সুস্থ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটি ধারা যদি পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে তাহলে মস্ক অ্যান্ড মিলিটারির অভিশপ্ত প্রভাব থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে। এর দ্বারা আওয়ামী লীগের সাময়িক ক্ষতি হলেও বাংলাদেশের এবং বৃহত্তর অর্থে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে শুভ প্রভাব পড়বে। ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত ঘটনার পর ৩৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে এবং দোষীরা দণ্ড পেয়েছে। কিন্তু জেল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার এখনও সম্পন্ন হয়নি। ভারতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য স্থাপনের উদ্যোগের প্রভাবে যদি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা বেগবান হয়, তাহলে জাতীয় চার নেতার রক্তদান সার্থক হবে। যে মহান আদর্শের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছেন সে আদর্শের পথে বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে যাবে এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনেও তারা পুনর্জন্ম লাভ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে ভারতের পদক্ষেপ কী হবে সেটাও আমাদের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে ভারতের ক্ষমতাসীনদের নীতি ও কৌশল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করেনি। একইভাবে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের সাম্প্রতিক উদ্যোগ গ্রহণের উদ্দেশ্য যদি শুধু হেজিমনোয়াল হয়, অর্থাৎ বাংলাদেশকে কায়দায় পেয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তারের অভিপ্রায়টিই বড় হয়ে থাকে কিংবা ভারতের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রশ্নে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে এক ধরনের সপত্নীসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে ভারতের জন্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা হয়, তাহলে নয়াদিলি্ল দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ফের বড় ধরনের ভুল করবে। তাদের মনে রাখা উচিত হবে যে, পচনশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে দক্ষিণ এশিয়া এবং সার্বিকভাবে এশিয়াতে চীনের অগ্রাভিযান রোধ করা যাবে না। চীনের সঙ্গে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে এবং থাকবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের বড় শক্তি হচ্ছে তাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো এবং নৈতিক বল। আধিপত্যবাদী নেশায় সেই গণতান্ত্রিক শক্তি ও নৈতিক বল বিসর্জন দিয়ে তারা যদি সুপারপাওয়ারে পরিণত হওয়ার বাসনা চরিতার্থ করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে এবং সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বার্থ হাসিলে লিপ্ত হয়_ যে পথে তারা রয়েছে বলেই আমার মনে হয়, তাহলে চাণক্য কুনীতি ব্যর্থ হতে বাধ্য।
আজ ৩ নভেম্বর। মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন যে চারজন নেতা_ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এম কামরুজ্জামান, তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাদের আত্মাহুতি তখনই সার্থক হবে, যখন দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক ও সমাজবাদী রাষ্ট্র
হিসেবে আবার বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।
ঢাকা, ২ নভেম্বর ২০১২

No comments

Powered by Blogger.