নিজের জন্য শোক by আশাপূর্ণা দেবী

মাঝরাতে ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ ভয়ানক একটা অস্বস্তি অনুভব করলেন অবিনাশ। দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে, বুকের মধ্যে অজানা একটা কষ্ট। ঘুম ভেঙে গেল, দেখলেন সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গেছে, ঘাড়ের নিচে বালিশটা ভিজে থসথস করছে। উঠে বসতে গেলেন, পারলেন না।


ঘাড় তুলে বালিশটা উল্টে নিলে ভালো হয়; কিন্তু বুঝতে পারছেন পেরে উঠবেন না। হাত-পা নড়াতে পারছেন না, অবশ পাথর পাথর।
ষাটের কোঠা পার করতে চললেন অবিনাশ, জীবনে অনেক দেখেছেন, সেই অভিজ্ঞতা তীব্র একটা প্রশ্নের রূপে অবিনাশের মস্তিষ্কের কোষে কোষে সব স্নায়ুর পর্দায় পর্দায় যেন তীক্ষ্ন একটা করাত চালিয়ে গেল।
আমার কি তাহলে স্ট্রোক হলো? এই বুকের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসার কষ্ট? এই যে ঘাম, এই যে হাত-পা অবশ লাগা, এ সবই তো স্ট্রোকের লক্ষণ।
আতঙ্কে অস্থির হয়ে চিৎকার করে উঠতে গেলেন অবিনাশ কোনো একটা কারুর নাম ধরে_হয়তো বড় ছেলের, হয়তো ছোট ছেলের, হয়তো নাতনিদের কারো, হয়তো বা শৈলবালারই! নাঃ, শৈলবালার হতে পারে না, কবে আবার শৈলবালাকে নাম ধরে ডেকেছেন অবিনাশ যে, সেটা মুখে এসে যাবে? অভ্যাসে না থাকলে মরণকালেও আসে না।... সেই জন্যই মহাপুরুষরা বলে থাকেন 'নামের' অভ্যাস করতে।
সে অভ্যাসও করা নেই অবিনাশের, তাই অভ্যাসগত কোনো ডাকই ডাকলেন; কিন্তু যাকেই ডেকে থাকুন, সে ডাক কারো কানে গিয়ে পেঁৗছল না, কারণ ডাকটা ভেতরেই হাঁচোড়-পাঁচোড় করছে, গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না।
তার মানে অবিনাশের পক্ষাঘাত হয়ে গেল। অকস্মাৎ অতর্কিতে।
যে অবিনাশ বিছানায় শোবার আগে পর্যন্ত, উঁহু ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্তও সুস্থ স্বাভাবিক সহজ ছিলেন।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিদিন যা যা করেন, সবই করেছেন এতটুকু ব্যতিক্রম হয়নি, শরীরে এতটুকু বৈলক্ষণ্য অনুভব করেননি।
নিত্যনিয়মে ভোরবেলা উঠে পার্কে বেড়াতে গেছেন এবং ফেরার সময় ছোট নাতির জন্য খাটাল থেকে সামনে দোয়া গরুর দুধটুকু নিয়ে এসেছেন, যথারীতি গোয়ালাটাকে একবার ধর্মজ্ঞান সম্পর্কে অবহিত করিয়ে দিয়ে।
ওরা অবশ্য অবিনাশকে এটা করতে বলেনি, নাতির মা-বাবা, অর্থাৎ অবিনাশের ছোট ছেলে আর তার বউ, তারা টিনের ফুডেই নির্ভরশীল ছিল, অবিনাশই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ ব্যবস্থাটি করে ও দায় ঘাড়ে নিয়েছেন।
অ্যালুমিনিয়ামের যে পাত্রটি করে দুধ নিয়ে আসেন, সেটা নিয়েই বেড়াতে যান এবং নাতনিদের কাছে সগৌরবে ঘোষণা করেন, লোকে হাসল তো বয়েই গেল।
সে যাই হোক আজও যথারীতি বাড়ি ফিরেই একবার চা-টোস্ট খেয়েছেন এবং কাগজ পড়া সাঙ্গ করার পর আরো একবার হালুয়া, আলুমরিচ সহযোগে বড় কাপের চা পান করেছেন।
বুড়ো বয়সে সকালের দিকে খিদে যেন একটু বেশি পায়, অথচ বলতে লজ্জা করে, তাই নাতনিদের টিফিনের জন্য যা কিছু তৈরি হয়, অবিনাশ হঠাৎ হঠাৎ তার গন্ধ পেয়ে যান।
অবিনাশ টিফিনের রুটি-তরকারি নিয়ে যেতেন, অবিনাশের ছেলেরা লুচি-মিষ্টি, নাতনিরা টিফিনে অমন গবগব করে লুচি খেতে পারে না, সূক্ষ্ম কিছুর জোগান দিতে হয় ওদের। যেমন ডিম ভাজা, কুঁচো নিমকি, হালুয়া, আলুমরিচ ইত্যাদি।
রান্নাঘর থেকে বাতাসে তার সুবাস ভেসে এসে যেন উতলা করে তোলে অবিনাশকে। অবিনাশ খবরের কাগজখানা হাতে করেই অন্দরমহলের দিকে এগিয়ে যান।_শুনেছো খবর? মোতিহারীর কাছে বাস দুর্ঘটনায় একটা বিয়ের পার্টি একেবারে খতম!... অথবা উদাত্ত গলায় বলতে যান, কাণ্ড শুনেছো? গতকাল এক বিরাট অগি্নকাণ্ডের ফলে_
এসব সংবাদ পরিবেশনের টার্গেট অবশ্যই শৈলবালা, কারণ খবরের কাগজের সত্যিকার খবর রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কূটচাল-টালের কথা নিয়ে আলোচনা শৈলবালার সঙ্গে হতে পারে না, দেশের ব্যাপার নিয়ে মাথাব্যথার সময় নেই শৈলবালার। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেই শৈলবালা কর্তৃপক্ষের ওপর রেগে আগুন হন এবং দাম কিছু কমলেই প্রসন্ন হন। মন দিয়ে যদি শোনেন তো ওই ঘটনা ও দুর্ঘটনার খবর।... কী আর করা, ওইগুলোই আলোচ্য করতে হয়। তবে তেমন তাড়াতাড়ির সময় শৈলবালাও বলেন, থাক বাবু, ওসব আর এখন শোনাতে এসো না, সকালবেলাই মন খারাপ হয়ে যায়।
অবিনাশ কি আর বোঝেন না, ওই মন খারাপের কথাটা ছুতো মাত্র, ব্যস্ততার সময় খবরেই কান পাতার সময় নেই শৈলবালার। অবিনাশ বলে, না তাই বলছি, মানুষের বেঁচে থাকাটাই যেন এখন একটা আশ্চর্য ঘটনা হয়েছে_বলে একটু ঘুরঘুর করেই বলেন, গন্ধটা বেরোচ্ছে তো! হালুয়া করছো বুঝি?... আলুমরিচ ভাজছো না কি ডিম ভাজছো মনে হচ্ছে! ভাজছো কিসে? দালদায় না শর্ষের তেলে? গন্ধটা ভালো বেরিয়েছে।
তা ওই সূত্রেই হোক, আর শৈলবালার বিবেচনাতেই হোক, দ্বিতীয়বারের চায়ের সঙ্গে দ্বিতীয় একপ্রস্থ জলখাবার জোটে। আজও খেয়েছেন পরিতৃপ্তির সঙ্গে।
অবিনাশ মনে মনে যেন দিনটার ছবি দেখতে থাকেন, দেখতে চান কোথাও কিছু দুর্বলতার চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছে কি না। কোথাও তো কিছু দেখছেন না।
তারপর যথারীতি বাজারেও গেছেন। এটাও দ্বিতীয় প্রস্থ, বড় ছেলে সকালবেলা চাকর সঙ্গে নিয়ে বাজার করে আনে, তবু ছেলেরা অফিসে চলে যাওয়ার পর অবিনাশ আর একবার ঝড়তি-পড়তি বাজারটা ঘুরে আসেন এবং অখাদ্য কিছু মাল এনে হাজির করেন, যা ওরা ছোঁয় না।... কিন্তু থোড়, পুঁইশাক, মুখিকচু, মৌরলা পুঁটি_এসব জিনিস খায় না মানুষ। খায় না তো বাজারে বিক্রি হয় কেন? যাকগে, কেউ না খাক অবিনাশ একাই খাবেন। শৈলবালাসুদ্ধ আজকাল ধুয়ো ধরেছেন, ওসব খেলে অম্বল হয়। ওটা কোনো কথাই নয়, ফ্যাশানি বউ-ছেলের কাছে সুয়ো হওয়া। অবিনাশ ওসব সুয়ো হওয়া-হওয়ির ধার ধারেন না। বরং ওই বউমাদের দেখিয়েই একটি গাদা করে চচ্চড়ি খান আজও।
আবার বিকেলে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খেয়েছেন, ছোট নাতনিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার ডিউটি পালন করেছেন, পার্কে গেছেন ছোট নাতির সঙ্গে, ঝি যায় গাড়ি ঠেলে নিয়ে, তবু অবিনাশ সঙ্গে যান। নিশ্চিন্ত হয়ে ঝিয়ের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি হন না। যদিও নাতির মা মুখ টিপে হেসে বলে, কত বাচ্চাই তো লোকজনের সঙ্গেই পার্কে আসছে, কার আর দাদু আসছেন পাহারা দিতে?
তা বলুক, অবিনাশ যান, আজও গিয়েছিলেন। তারপর? তারপর আর কি, একে একে দুই ছেলে বাড়ি ফিরেছে, তাদের জন্য চা হয়েছে, সেই সঙ্গে যেমন খান একটু একটু খেয়েছেন, এবং আরো কিছুক্ষণ এটা-ওটা কথায় কাটিয়ে রাতের খাওয়া সেরে শুয়েছেন। এর মধ্যে কোথায় কোনখানে সেই বিরাট গহ্বরের ইশারা, যেখানে পা ফেলেই তলিয়ে গেলেন অবিনাশ সেন নামের লোকটা!
অবিনাশ আবার চেঁচাতে গেলেন, গলা দিয়ে শব্দ বার করতে পারলেন না, তার মানে সর্বশরীরেই পক্ষাঘাত হয়ে গেছে, জিভটাও বাদ দেয়নি সেই নিষ্ঠুর দস্যু।
পক্ষাঘাত! রোগটার বাজার-চলতি যে নামটা আছে, সেটা না ভেবে অবিনাশ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পাতা থেকে তুলে আনলেন এই অপ্রচলিত শব্দটা। এ শব্দটা 'প্যারালিসিস'-এর থেকে অনেক বেশি ভয়ংকর, আর অনেক বেশি রূঢ় বলেই কি? দুঃখের পরিমাপ করতে যেটা দরকার হচ্ছে।
এখন গ্রীষ্মকাল, তবু সন্ধের দিকে একটা বড় গোছের কালবৈশাখী হয়ে গেছে বলে বাতাস হঠাৎ অনেকটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, অবিনাশের ঠাণ্ডা লাগার ধাত বলে মাথার দিকের জানালাটা বন্ধ, সামনের টেবিলে টেবল ফ্যানটা ঘুরছে মৃদুমন্দ গতিতে। ঘরটা সরু, শোবার ঘর হিসেবে গণ্যও ছিল না, তাই সিলিং ফ্যান নেই, দরকারও হয় না, পাশের জানালাটা খোলা থাকলে হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যায়, আজ জানালাটার একটা কপাট বন্ধ।
এ সবই ঠিকঠাক করে গেছেন শৈলবালা শুতে যাওয়ার আগে। যান না অবশ্য বেশি দূরে, পাশের ঘরেই তার অবস্থান। এ ঘরটা তো ছোট্ট এক ফালি, ব্যবধান সামান্যই, দু'ঘরের মাঝখানের দরজাটা খোলাই থাকে শুধু, একটা পর্দা ঝোলে তাতে।... তবু কত দূরদূরান্তের ব্যবধান।
বড় ছেলের মেয়ে দুটো ধাড়ি হয়ে ওঠা পর্যন্ত অবিনাশ একটি পরম বস্তু হারিয়েছেন, আযৌবনের অভ্যাস শৈলবালার সানি্নধ্য। সেটা হারাতে হয়েছে ওই তুচ্ছ কারণটার জন্য। ওদের মা-বাপের ভাগে একটা মাত্র ঘর, বড় হয়ে যাওয়া মেয়ে দুটোকে নিয়ে শোয়া নাকি সভ্যতা নয়, অতএব সভ্যতা আর শোভনতা বজায় রাখতে শৈলবালা একদিন নিজেই এ ব্যবস্থা চালু করে বসেছেন।
সাবেক কালের এই বাড়িটার যে ঘরটায় অবিনাশের ফুলশয্যা হয়েছে এবং তদবধি চিরটাকাল কাটিয়ে এসেছেন, সে ঘর থেকে নির্বাসন ঘটেছে অবিনাশের। বিয়ের পাওয়া সেই সেকেলে ঢাউস জোড়া খাটে শৈলবালা এখন দুই নাতনিকে নিয়ে মৌজ করে শোন, অবিনাশ এই সরু ঘরটা, একটা সরু চৌকিতে।
প্রথম এ ব্যবস্থার প্রস্তাবে অবিনাশের মাথায় যেন হঠাৎ বজ্রাঘাত হয়েছিল; কিন্তু শৈলবালা আগে থেকেই শাসিয়ে রেখেছিলেন, খবরদার এ নিয়ে একটি কথা মুখে আনবে না, তাহলে লজ্জার আর শেষ থাকবে না। অতএব দুঃখ-অভিমান-ক্রোধ-ক্ষোভ সব কিছুই মনের মধ্যে পুষে রেখে মুখে তালাচাবি দিয়ে আছেন অবিনাশ।
বড় ছেলে যখন বলে উঠেছে, এক হিসেবে এ ঘরটাই তো দেখছি বেটার, দক্ষিণে এমন একটা বড় জানালা রয়েছে, যেটা আপনার ও-ঘরে ছিল না_তখন অবিনাশ মুখের সামনে খবরের কাগজটা তুলে ধরেছেন।
আর বউমা যখন বলেছেন, ঘরটা আজেবাজে জঙ্গলে বোঝাই হয়ে থাকত, বোঝাই যেত না এত সুন্দর। পূর্ব-দক্ষিণের দুটো জানালা খোলা থাকলে বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়, তাই না বাবা?... তখন অবিনাশ বলেছেন, বউমা, তোমাদের ধোপা আসবে কবে?
শৈলবালা অবশ্য বোঝেন, অবিনাশের নিশ্বাস ফেলার তারতম্যটুকু পর্যন্ত হাড়ে হাড়ে বোঝেন; কিন্তু সেই বুঝতে পারাটা অন্যকে বুঝতে দেন না, অবোধের ভানে থাকেন। তবু এখন অবিনাশ তার অন্তিম আর্তনাদ তাদের কানেই পেঁৗছাতে চেষ্টা করলেন, যারা তাঁর কথায় কর্ণপাত করাটা খুব একটা দরকারি মনে করে না।
কিন্তু পেঁৗছাচ্ছে কই? অবিনাশের আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে, আর ঘাম বাড়ছে। দুঃখ-যন্ত্রণায় জোরে কেঁদে উঠতে চেষ্টা করলেন, আর তখন গলা থেকে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোল, অনেকটা যেন ক্রুর কোনো জন্তুর আর্তনাদের মতো।
এখন অবিনাশ তার বড় নাতনির গলা শুনতে পেলেন, দিদা, ও দিদা, দাদু কী রকম চেঁচাচ্ছে।
তার মানে শৈলবালা এখনো সুখনিদ্রায় বিভোর, এ আওয়াজ তার সেই ঘুমের গভীরে গিয়ে পেঁৗছতে পারেনি।... উঃ, অবিনাশ এই হাত কয়েক দূরে পড়ে থেকে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছেন, আর শৈলবালা_
আবার বুকের কাছটায় কী যেন ড্যালা পাকিয়ে উঠল... তাই ভালো, সুখের ঘুম ভেঙে সকালে উঠে অবিনাশের মরামুখই যেন দেখে শৈলবালা আর তার ছেলেরা। মনে মনে স্ত্রী-পুত্রের প্রতি এই ভয়ংকর অভিশাপ বাণীটি উচ্চারণ করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চোখ দিয়ে এক ঝলক জল গড়িয়ে পড়ল অবিনাশের।
কিন্তু অবিনাশের অভিশাপ কার্যকর হলো না। পরক্ষণেই শৈলবালার সদ্য ঘুম ভাঙা আর্তস্বর_ও মা সে কী!
তৎপরক্ষণেই পর্দা নড়ল, শৈলবালার আলুথালু মূর্তিটি দেখা গেল পর্দার গায়ে।
অবিনাশ চোখ বুজলেন। জল গড়িয়ে পড়া চোখটা শৈলবালাকে দেখাতে ইচ্ছা হলো না। চোখ বুজে থেকেই অনুভব করলেন অবিনাশ, নাতনি দুটোও চলে এসেছে এ-ঘরে, আর মধ্যে ছোটটা তারস্বরে_বাপী বাপী, কাকু কাকু_রবে ডাকতে ডাকতে ছুটে বেরিয়েও গেল।
অবিনাশ অনুভব করছেন, শৈলবালা অবিনাশের সরু চৌকির কিনারাটুকুতেই বসে পড়ে অবিনাশের ডান হাতের নাড়িটা টিপে ধরেছেন। কবরেজ ঘরের মেয়ে এবং সহজাত বুদ্ধিতেও নাড়ি-জ্ঞানটা শৈলবালার প্রখর; আর সেই জ্ঞানটা সম্পর্কে রীতিমতো সচেতন। কারুর অসুখবিসুখ করলেই শৈলবালা আগে এসে তার নাড়িটা ধরেন।
অবিনাশ অনুভব করছেন শৈলবালা অবিনাশের হাতটা সাবধানে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে তাকে ঠেলে ঠেলে আপ্রাণ ডাক দিচ্ছেন, শুনছো? ওগো শুনছো? কী কষ্ট হচ্ছে_শুনছো? খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?
ইচ্ছে করলেই চোখটা খুলতে পারেন অবিনাশ, চোখের পাতায় পক্ষাঘাত হয়নি, তবু সে ইচ্ছে তিনি করলেন না। তিনি ওই আকুল ডাকটি উপভোগ করতে লাগলেন! শুনছো? ওগো বলো না কী কষ্ট হচ্ছে?... তার সঙ্গে শৈলবালার প্রেমস্পর্শ। অবশ্য এই স্বপি্নল উপভোগটি স্থায়ী হলো না, দুই ছেলেই এসে গেল। অবিনাশ চোখ বুজেই দেখতে পাচ্ছেন একজনের পরনে সিল্কের লুঙ্গি, আর একজনের ডোরাকাটা রাত-পায়জামা, বাপের বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে মুখ ঝুঁকিয়ে উচ্চ স্বরে ডাকছে, বাবা বাবা। তারপর নিচু গলায় বলল, ব্যাপারটা কী?
শৈলবালার উত্তর শুনতে পেলেন, কী জানি, রিঙ্কু আমায় ঠেলে জাগাল, দাদু কী রকম চেঁচাচ্ছেন বলে, এসে ডাকাডাকি করছি সাড়া পাচ্ছি না।
কিন্তু সুরটা এমন কেটে যাচ্ছে কেন? শৈলবালার কণ্ঠে তেমন হাহাকার ভাব ফুটল না কেন? বরং ক্ষণপূর্বের সেই ব্যস্ত আকুলতাও অন্তর্হিত, যেন বেশ আত্মস্থ ভাব। তার মানে ছেলেদের সামনে খেলো হবেন না। স্বামীর জন্য আকুলতা, এটা তাহলে শৈলবালার কাছে খেলোমি! হ্যাঁ তাই, আগেও এ জিনিস লক্ষ করেছেন অবিনাশ।
বড় ছেলে আরো একবার ডাকল, অবিনাশ সাড়া দিলেন না। ছেলেরা এখন ডাক্তারের কথা তুলল।
কে জানত চোখের ওপরকার ছোট্ট ছোট্ট এই পাতা দুটো এত বড় একটা আবরণ প্রাচীর, তার আড়ালে কতখানি আত্মগোপন করা যায়!
খুব দুঃখের সঙ্গে এখন অনুভব করছেন অবিনাশ বুকের সেই দারুণ কষ্টটা অনেক কমে গেছে, মনে হচ্ছে এখন বোধ হয় কথা বলতে পারবেন, ওদের ওই উদ্বেগকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলতে পারবেন, দোহাই বাবা, ডাক্তার-ফাক্তারকে আর এই মাঝরাত্তিরে ডাকতে যেতে হবে না। এক্ষুনি মরছে না তোদের বাবা।
মনে হচ্ছে বলতে পারবেন, সে অবস্থা হয়েছে, তবু বলতে চেষ্টা করলেন না অবিনাশ, দাঁতে দাঁত চেপে পড়েই রইলেন চোখ বন্ধ করে।
ভয়ানকভাবে অনুভব করছেন, কথা কয়ে উঠলেই হঠাৎ অবিনাশ সস্তা হয়ে যাবেন। নাঃ, এক্ষুনি সস্তা হয়ে যেতে ইচ্ছে নেই। বরং চোখ বুজে পড়ে সেই অবস্থাটা উপভোগ করবেন, ডাক্তার এলো পরীক্ষা করল, ডাকলে সাড়া দিচ্ছেন না শুনে ইশারায়-ইঙ্গিতে সন্দেহ প্রকাশ করল, সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস হওয়া বিচিত্র নয়। নির্দেশ দিল, একদম শুইয়ে রাখুন। কমপ্লিট রেস্ট।
তাহলে? তখন কিন্তু আর ছেলেরা বাপ সম্পর্কে এত উদাসীন থাকতে পারবেন না। আর শৈলবালা? শৈলবালার তখন উপযুক্ত শাস্তি হবে। এমন কায়মনোবাক্যে সারা দিন সংসার করে, ধর্মের সাক্ষী একবার রাতদুপুরে একটু জানালা বন্ধ আর পাখা খোলার কর্তব্য সেরে নাতনিদের নিয়ে আরাম-শয্যায় শুতে যাওয়া চলবে না।
ডাক্তারের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন অবিনাশ_তার আবরণ প্রাচীরের আড়ালে থেকে; কিন্তু সে প্রতীক্ষা সফল হলো না। অবিনাশ নিজের বলার কথাটাই শৈলবালার কণ্ঠে শুনতে গেলেন, থাক রে খোকা, এক্ষুনি ডাক্তারকে ডাকাডাকি করতে যাওয়ার দরকার নেই।
ছোট ছেলে বলল, না ডাকাটা কি ঠিক হবে?
হবে! আমার মনে হচ্ছে অন্য কিছু না, স্বপ্ন-টপ্ন দেখে 'বোবায়' ধরেছিল। নাড়ি বেশ ভালোই আছে। কবরেজ বাড়ির মেয়ে। সে অহমিকাটুকু প্রকাশ করতে দ্বিধা রাখেন না। উঃ, কী নির্লজ্জ নিষ্ঠুরতা। ছেলেদের কাছে নিজের মহিমা বজায় রাখতে কী নির্মমতা!
রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় অবিনাশের, মনের মধ্যে কথার চাষ চলে, বড় অহংকার দেখছি যে সর্বজ্ঞ হয়ে গেছো একেবারে! নাড়ি ভালো আছে! ভালো থাকতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল তাকে। নিজের নাড়ির এই দুর্ব্যবহারে আর একবার চোখে জল আসে, চোখ জ্বালা করে সেই নোনা জলে, তবু চোখ খোলেন না।
শৈলবালার নিশ্চিন্ত গলার স্বর ধ্বনিত হয়, পাখাটা বাড়িয়ে দে তো রিঙ্কু। আর জানালাটা ভালো করে খুলে দে... এই শুনছো_ জল খাবে?
জল! শব্দটা শুনে অবিনাশের পুরো স্নায়ু উন্মুখ হয়ে উঠল। অনুভব করলেন ঠিক এ মুহূর্তে এটাই খুব দরকার হচ্ছিল তার। আর চোখ বুজে থাকা চলবে না। ওরা হয়তো সাড়া না পেয়ে জল আনবে না, বলবে_থাক ডিস্টার্ব করে কাজ নেই, জাগলে খাবেন। অবিনাশ চোখ খুললেন।
বড় ছেলে বলল, বাবা, জল খাবে?
বড় ছেলের এ কণ্ঠস্বর কত দিন শোনেননি অবিনাশ? এমন করুণায় কোমল স্নেহ স্নেহ। মাথা নেড়ে জানালেন_হ্যাঁ। বড় নাতনি তাড়াতাড়ি জল এনে দিল। এও নতুন, সবাই জানে, দাদু হচ্ছেন দিদার বিজনেস।
ছোট ছেলে বলল, কী হলো হঠাৎ? এ স্বরটাও যেন বহু যুগের ওপার হতে ভেসে আসার মতো।
অবিনাশ দুহাত উল্টে বললেন, কী জানি! হঠাৎ বুকটা কেমন_বলেই খেয়াল হলো, হাত বেশ ঠিকভাবেই নাড়াতে পারছেন। কথাও বলতে পারলেন। সবার অলক্ষ্যে পা-টা একটু নাড়িয়ে দেখলেন, নড়ল। তার মানে অবিনাশ সেন নামের এ প্রৌঢ় ভদ্রলোকটির সব ঠিক আছে।
ছোট ছেলে বলল, এখন ঠিক লাগছে? না, ডাক্তার ডাকার দরকার আছে?
ডাক্তার ডাকার দরকার আছে কি না এ প্রশ্নটা রোগীকে করার নয়, শুনে অভিমান হলো অবিনাশের। আবার চোখে জল এলো, মাথা নেড়ে বললেন, না।
তাহলে শান্ত হয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করো। বুকের ওপর হাত রেখে ঘুমিও না, ওতে অনেক সময় এ রকম হয়।
শৈলবালা বিছানার পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চাদর কুঁচকে যাওয়া ভাঁজগুলো হাত দিয়ে প্লেন করছিলেন, সহজভাবে বললেন, একটা কাজ কর খোকা, তোদের কী সব হজমের ওষুধ-টষুধ আছে, তাই একটু দে। মনে হচ্ছে পেট গরম হয়ে_
খুবই স্বাভাবিক। খোকা অনায়াসে বলে, এসে দেখে আমারও তাই মনে হয়েছিল_বয়েস হয়েছে তা তো ভাবেন না, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে একটু ইয়ে হওয়া উচিত। অন্তত রাতের খাওয়াটা, আম-ফামগুলো না খেলেই ভালো হয়। আমার তো বাবার খাওয়া দেখে ভাবনাই হয়।
অবিনাশের মধ্যে যেন একটা প্রবল ভূমিকম্প হয়। তার এতক্ষণের আশার-আকাঙ্ক্ষার কষ্টে গড়া নিজের দাম মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। অবিনাশ একটা নেহাত সস্তা বুড়োয় পরিণত হয়ে গেলেন, যে রকম বুড়োরা ওজন না বুঝে খেয়ে রোগে পড়ে ভোগে আর ভোগায়।
শৈলবালা একটা গেঞ্জি নিয়ে এসে বললেন, গায়ের গেঞ্জিটা ছেড়ে ফেল।... খোকা, বুদু তোরা ঘুমোগে, যা।
খোকা একটা হাই তুলে বলল, আর ঘুম! ঘুমের বারোটা বেজে গেল।
বুদু বলল, হ্যাঁ, মাঝরাত্তিরে এরকম হৈচৈ_আমারই পেটের মধ্যে কেমন করছে। ঘুম আর হবে বলে আশা নেই। বলল, কিন্তু চলেও গেল। বলল না ঘুম যখন হবেই না তখন না হয় বাবার কাছেই বসে থাকি একটু।
নাতনিরা তো জলখাওয়া দেখেই চলে গেছে। এখন একা শৈলবালা_তাও নড়াচড়ার ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি সুস্পষ্ট।
অবিনাশ নির্লিপ্ত গলায় বললেন, তুমিও যাচ্ছ?
শৈলবালা অপ্রতিভভাবে বললেন, না, খোকা ওষুধটা দিয়ে যেতে ভুলে গেল কি না! দেখে এসে বসছি একটু।
বসে থাকতে হবে না, এখানেই শোও না!
শৈলবালা অবিনাশের পৌনে তিন ফুট চওড়া চৌকিটার দিকে তাকিয়ে আরো অপ্রতিভ গলায় বলেন, কী যে বলো_ভারী মাঠ-ময়দান বিছানা তোমার!
আশ্চর্য, এই কিছুদিন আগেও একসঙ্গেই শুয়েছেন শৈলবালা, অবশ্য সেই মাঠ-ময়দান খাটটাতে। আসলে কিছু অভ্যাস, একবার ছেড়ে দিলে, আর একবার সেটা করা যায় না। তাতে লজ্জা আছে। খাওয়া-পরা-শোয়া সব ব্যাপারেই।
অবিনাশ বললেন, একবার ট্রেনের বেঞ্চিতেও দুজনে এক কম্বল মুড়ি দিয়ে_
শৈলবালা তাড়াতাড়ি বললেন, থামো তো, সেদিন আর এদিন, এখন নাতনিরা দেখলে হাসবে না? যাই দেখি, খোকা কি করল_বলে উঠে গেলেন শৈলবালা। আমি ওষুধ খাব না, বলে অবিনাশ পাশ ফিরে দেওয়ালমুখো হয়ে শুলেন।
শৈলবালা বোধহয় দেখলেন শাপেবর। ছেলেরা ভুলেই গেছে_আবার তাদের ডাকাডাকি করতে লজ্জা করছে।... অহেতুক বসে থেকে অকারণেই টেবল ফ্যানটা একটু কমিয়ে-বাড়িয়ে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
নাতনি দুটো হয়তো জেগে আছে, ভাবতে পারে বুড়োবুড়ি এতক্ষণ কী প্রেমালাপ করছে। যৌবনে গুরুজনের কাছে লজ্জা, বার্ধক্যে লঘুজনের কাছে।
শৈলবালা চলে যেতেই আবার যেন কেমন দম আটকানো ভাব অনুভব করছেন অবিনাশ। উঠে বসলেন, গেঞ্জি না বদলেই আবার শুয়ে পড়লেন। আর শুয়ে শুয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন_ভগবান স্ট্রোকই হোক অবিনাশের।
পক্ষাঘাত নয়, একবারে চরম আঘাত। যাতে তার স্ত্রী-পুত্র সকালে এসে কপালে করাঘাত করে বলতে পারে_পেট গরম বলে চলে গিয়ে কী ভুল করেছি কাল!
বিশেষ করে শৈলবালা। সকালবেলা_কী গো, শরীর কেমন? বলে কর্তব্য সারতে এসে যখন দেখবেন তাঁর শাড়ি চুড়ি জন্মের শোধ খতম_তখন?
আবার একটা পৈশাচিক উল্লাস অনুভব করতে গেলেন, আবারও ব্যর্থ হলেন। অবিরল চোখের জলের ধারায় বালিশ ভিজতে লাগল।
অবিনাশ নামের একটা লোক একা একটা ঘরে নিঃশব্দে মরে পড়ে আছে, এই দৃশ্যটা ভাবতে গিয়ে বুক ফেটে যাচ্ছে অবিনাশের, যেন একজন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুদৃশ্য দেখছেন। সেই শায়িত মৃতদেহের দিকে চোখ ফেলছেন আর দম বন্ধ হয়ে কান্না উথলে আসছে, অথচ সেই নিঃসঙ্গ নিঃসঙ্গ দীন মৃত্যুটার জন্যই প্রার্থনা জানিয়ে চলেছেন অবিনাশ সেন।

No comments

Powered by Blogger.