আন্তর্জাতিক-মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেন্ডার বিভাজন by রজার কোহেন

আজীবন ডেমোক্র্যাট ক্লিভল্যান্ডের এক প্রখ্যাত ব্যবসায়ীর কাছে এবারের নির্বাচন কয়েকটি জ্বলন্ত প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছে। তিনি যে এবার রমনিকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন_ এ কথাটি তার স্ত্রীর কাছে কি পাড়তে পারবেন? এ জন্য তার স্ত্রী কি তাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবেন?


শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওই ব্যবসায়ী তার স্ত্রীর কাছে কথাটি বলতে সাহস করেননি এবং তিনি ওবামাকেই আগাম ভোট দিয়ে এসেছেন। তার মনের এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণাদায়কভাবে ওহিওর প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের মৌলিক গতিময়তা তুলে ধরেছে। এই রাজ্যের ভোটের ফলাফল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য নির্ধারক হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতি পরিচালনা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করতে তিনি যে সক্ষম সে ব্যাপারে বিশ্বাস স্থাপন করতে না পারার কারণে ওবামার ওপর হতাশা থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এখানকার যেসব পুরুষ ভোটার ডেমোক্রেটিক প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন, তারা এখন রমনির দিকে ঝুঁকেছেন।
পুরুষদের মধ্যে এই যে ভাবনা তার সঙ্গে নারীদের ভাবনার বিরাট পার্থক্য রয়েছে। নারীদের দেখা যাচ্ছে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক ইস্যুর ওপর আরও গুরুত্ব দেওয়া, কর্মস্থলে তারা যেসব সমস্যা মোকাবেলা করছে এবং বিশেষত গর্ভপাতের মতো বিষয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
আমার ওহিও জরিপ যদিও বিজ্ঞানসম্মত নয়, তথাপি গত কয়েকদিনে এখানকার বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার যা মনে হয়েছে, সেটাকে উড়িয়েও দেওয়া যাবে না। কারণ, জাতীয় পর্যায়ের জরিপে প্রাপ্ত সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচন ও ভোট প্রদানের ধরনে লিঙ্গ বিভক্তি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস ও সিবিএসের সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, নারীদের মধ্যে ৫২ শতাংশ ও পুরুষদের ৪৪ শতাংশ ওবামাকে সমর্থন করছে। অন্যদিকে রমনির পক্ষে নারী সমর্থনের হার ৪৪ শতাংশ ও পুরুষ সমর্থনের হার ৫১ শতাংশ।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা এখানে তীব্র আকার নিয়েছে। আমেরিকান পরিবারগুলোতে সকালের খাবার টেবিলে এখন অনেক স্বামী-স্ত্রী কাকে ভোট দেওয়া উচিত এ নিয়ে বিতর্ক করছে।
ওবামা পরাজিত হলে সেটা যে শুধু রমনির সঙ্গে প্রথম টিভি বিতর্কে বাজে পারফরম্যান্সের জন্য হবে তা নয়। মিট রমনিকে একজন দৈত্যের মতো অনুভূতিহীন পুঁজিপতি হিসেবে চিত্রিত করা এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখতে না পারাও নেতিবাচক প্রভাব রেখে থাকবে। তিনি করপোরেট আমেরিকাকে আশ্বস্ত করতে পারেননি যে, তিনি আসলে ব্যবসাবিরোধী নন। তাছাড়া তার অগ্রাধিকার যে তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সেটা তিনি কলেজ গ্র্যাজুয়েট থেকে হাইস্কুল ডিপ্লোমাধারী পর্যন্ত অনেক আমেরিকানকেই বোঝাতে সক্ষম হননি।
ক্লিভল্যান্ড ও শিকাগোতে আমি ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড ওবামাবিরোধী মনোভাব দেখতে পেয়েছি। ওবামার আপন শহরের এক অভিজাত পরিবারের সদস্য শিকাগোর একজন প্রধান নির্বাহী বর্ণনা করেছেন প্রেসিডেন্ট কীভাবে ইএসএ ইঙ্ককে চটিয়েছেন। ওবামা ২০০৯ সালে ৬০ মিনিটের এক সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ওয়ালস্ট্রিট ও ব্যাংকারদের সম্পর্কে যে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন সেটা থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে তার বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে ব্যবসায়ীরা তার ওপর রুষ্ট। তাছাড়া হোয়াইট হাউস অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের বক্তব্য না শোনার মানসিকতাও ব্যবসায়ী সমাজ ভালোভাবে নেয়নি। এর সঙ্গে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের নিজের অভিজ্ঞতার ঘাটতি তো আছেই। এখানে ২০০৮ সালের ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে মার্কিন অর্থনীতিকে বাঁচানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ, গাড়ি শিল্পকে রক্ষা করা এবং ওয়ালস্ট্রিটের প্রতি উদার মনোভাব গ্রহণের মতো বিষয়গুলো ব্যবসায়ীরা আলোচনাতেই আনছেন না।
ব্যবসা-বাণিজ্যের দেশে ওবামাকে ব্যবসাবিরোধী করে চিত্রিত করাটা তার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে দিয়েছে। বিশেষ করে এবার যখন নির্বাচনী প্রচারণায় দেদারসে টাকা খরচ করা হচ্ছে, তখন বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আর রমনি যদি নির্বাচনে পরাচিত হন তাহলে এ জন্য রিপাবলিকান পার্টির দক্ষিণপন্থি অংশের কাছে দীর্ঘদিন নিজেকে আটকে রাখা দায়ী হতে পারে। টি-পার্টির চরম দক্ষিণপন্থি সামাজিক কর্মসূচি তাকে গিলতে হয়েছিল। মডারেট অংশের কাছে ফিরতে তাকে দীর্ঘ সময় নিতে হয়েছিল। আসলে তিনি রিপাবলিকান মধ্যপন্থিদের ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে এগোলে যে ভোটে জিততে পারেন সেটা তার দীর্ঘদিন ধারণার মধ্যেই ছিল না।
শিকাগোর এক বন্ধু আমাকে বলেছেন, রিপাবলিকান এই মধ্যপন্থি কর্মসূচি নিয়ে অনেক আগেই রমনির এগিয়ে আসা উচিত ছিল। উভয় প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বীই এবার মোটা দাগের ভুল করেছেন। তবে কার ভুলটা গুরুতর ছিল সেটা আমরা আগামী সপ্তাহেই জানতে পারব।
ওবামা রমনিকে প্রতিযোগিতায় ফিরে আসতে সাহায্য করেছেন। কনভেনশনের পর রমনি টোস্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রথম টিভি বিতর্কের পর তিনি প্রতিযোগিতায় ফিরতে শুরু করেন। এরপর ডেমোক্রেটিক পার্টি তাকে বাজেভাবে উপস্থাপনের চেষ্টাও তার পক্ষেই গেছে। নিরাপত্তা বিভাগে কাজ করা একজন সাবেক মেরিন টমাস কিসের সঙ্গে আমি আলাপ করে দেখেছি, তিনি আজীবন ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়ে এলেও এবার ওবামার সমর্থন হ্রাসের প্রবণতা দেখে তিনি আদৌ নিশ্চিত নন প্রেসিডেন্ট এবার জিততে পারবেন কিনা। কিসের মনোভাবের কারণে ওবামা নির্বাচন নিয়ে ভাবতে পারেন।
তবে ওবামার পক্ষে সমর্থনও রয়েছে। মার্কেটিংয়ে চাকরি করা ৪৯ বছর বয়স্ক পামেলা স্টিভেনসনের প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করা যায়। পামেলা ওবামার পক্ষে আগাম ভোট দিয়েছেন। ভোট দেওয়ার সময় তিনি তার ১৯ বছর ও বিশ বছরের দুই ছেলেকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন, তারা যাতে ওবামার পক্ষে ভোট দেয়। তিনি বলেন, আমরা যত বেশি সংখ্যায় পারি ওবামার পক্ষে ভোট দেওয়ানোর চেষ্টা করছি। ওবামা যেন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবার ওভাল অফিসে আসীন হতে পারেন সেটাই তার লক্ষ্য।
এবার ভোটে দেখা যাচ্ছে, পুরুষ বনাম নারী হয়ে যাচ্ছে। নারী, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো, শ্রমিকরা কত সংখ্যায় এবার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে? রমনির ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে শেষ পর্যন্ত অনড় থাকবে কি? এখন কোনো রোমান্স অবশিষ্ট নেই। ওবামা এখন নারীদের শুভবুদ্ধি যেন শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে কায়মনোবাক্যে সেই প্রার্থনাই করতে পারেন।

রজার কোহেন :নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট; ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.