মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন- বিজয়ী কি ঠিক হয়েই আছে? by হারুন-অর-রশীদ

নিজের ভোট দিয়ে দিয়েছেন বারাক ওবামা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট আগাম ভোট দিলেন। তবে শুধু বারাক ওবামা নন,পাক্কা ৬৫ লাখ মার্কিন নাগরিক ভোট দিয়েছেন এরই মধ্যে।


এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে: ৬ তারিখের নির্বাচনী দ্বৈরথের দুই সপ্তাহ আগেই কি তবে ফল ঠিক হয়ে গেছে?
প্রেসিডেন্টের আগাম ভোট দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে আগেভাগে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো। সে বিষয়টা নেহাত আনুষ্ঠানিকতা হলেও দুই শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রচারণা শিবিরই মনে করছে, আগাম ভোট দেওয়ার চর্চাটা এবার নির্বাচনের ফলের একটা বড় নির্ধারক হতে পারে।
এর আগে শুধু প্রবাসী মার্কিন ও বিদেশে মোতায়েন সেনারা আগাম ভোট দিতে পারতেন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার অন্তত ৩৫ শতাংশ ভোটার আগাম ভোট দেবেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এর হার ছিল ৩০ শতাংশ। দলীয় সমর্থনের দিক থেকে ‘দোদুল্যমান’ অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডা, কলোরাডো, আইওয়া ও ওহাইওতে আগাম ভোটের হার হতে পারে এর চেয়ে অনেক বেশি।
জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাইকেল ম্যাকডোনাল্ড বলেছেন, কলোরাডোতে ৮৫ শতাংশ ভোট পড়বে নির্বাচনের দিনের আগেই। ফ্লোরিডাতে হবে ৭৫ শতাংশের কাছাকাছি। আর ওহাইওতে আগাম ভোট হবে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের মতো। এই অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রতিটিতেই আগাম ভোট দেওয়ার সহজ ব্যবস্থা আছে বলে উল্লেখ করলেন ম্যাকডোনাল্ড।
যেসব অঙ্গরাজ্যে বিষয়টি অনুমোদিত, সেখানে আগাম ভোট বেশ কয়েক দিন আগেই শুরু হলেও গণনা হবে নির্বাচনের দিনই। তবে ম্যাকডোনাল্ড বলেন, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর দিকে খেয়াল রাখলে সম্ভাব্য চূড়ান্ত বিজয়ী কে হবেন, তা ধারণা করা হয়তো সম্ভব। ম্যাকডোনাল্ড আগাম ভোটের সংখ্যা এবং সম্ভব হলে কোন দলের পক্ষ থেকে ভোটগুলো দেওয়া হয়েছে তার হিসাব রাখেন।
২০০৮ সালের স্মৃতিচারণা করে ম্যাকডোনাল্ড বলেন, ‘সেবার নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগেই আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে ওবামা জিতছেন। কারণ, আগাম ভোটে কলোরাডোতে খুব ভালো করেছিলেন তিনি। আর সেবার নির্বাচনী ফলাফলের হিসাবে কলোরাডোর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
কিন্তু এ বছর প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুবই তীব্র। এতটাই তীব্র যে আগাম ভোট থেকে ফল আঁচ করা মুশকিল হবে। তবে তার পরও ম্যাকডোনাল্ডের ধারণা, বেশির ভাগ আগাম ভোট পড়বে একেবারে শেষ মুহূর্তে। তখন হয়তো বিজয়ীর ব্যাপারে একটা ইঙ্গিত মিলবে।
জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ট্রে হুডের মতে, মার্কিন রাজনীতিতে কোনো না কোনো ধরনের আগাম ভোট অন্তত দুই দশক ধরে নির্বাচনী ফলাফলের ক্ষেত্রে একটা নিয়ামক। ওই সময়ে টেক্সাস ও টেনেসির মতো কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ভোট পড়ার হার বাড়াতে ভোট দেওয়ার সুযোগ-সুবিধা বাড়াত।
বর্তমানে ৩২টি অঙ্গরাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া নির্বাচনের দিনের আগে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেয়। ‘কৈফিয়তহীন’ অনুপস্থিত ব্যালট বা আগাম ভোট কেন্দ্রে গিয়ে এ ভোট দেওয়া যায়। ভোটাররা কোনো কারণ না দেখিয়েও অনুপস্থিত ব্যালট চাইতে পারে নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের কাছে। আগাম ভোট কেন্দ্র সাধারণত ছুটির দিনে খোলা থাকে। অনেক ভোটারের জন্য এ সময়ই ভোট দিতে যাওয়া সহজতর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেই সামরিক বাহিনীর সদস্য, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিদেশে বসবাসরত নাগরিকেরা সবাই ডাকযোগে অনুপস্থিত ব্যালট দিয়ে ভোট দেওয়ার অনুরোধ করতে পারেন।
গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আগাম ভোটের বিষয়টি আয়েশের চেয়ে বরং রাজনৈতিক কৌশলের অংশই হয়ে উঠেছিল বেশি। সেবার হাজার হাজার আগাম ভোট বারাক ওবামাকে নর্থ ক্যারোলাইনার মতো কিছু অঙ্গরাজ্যে এগিয়ে রাখে। ট্রে হুড বলেন, ভোটার টানার ক্ষেত্রে আগাম ভোট কীভাবে নির্বাচনী প্রচারণা কৌশলকে প্রভাবিত করে গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগে।
এবারের নির্বাচনে উভয় শিবির তাই নিজ নিজ প্রার্থীর ভোট বাড়াতে আগাম ভোটের দিকে নজর দিয়েছেন। ওবামা ফর আমেরিকার উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের যোগাযোগ পরিচালক জো জেপেচকি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের তারিখ একটা নয়, ১১টা তারিখ আছে এ দেশে।
সপ্তাহ দুয়েক আগে উইসকনসিনের আগাম ভোট কেন্দ্রগুলো খোলা হলে ওবামার প্রচারকর্মীরা সমর্থকদের দলে দলে কেন্দ্রে নিয়ে গেছেন। কিছু কট্টর ওবামা-সমর্থক তো প্রথম দিনই ভোট দেওয়ার জন্য ভোট কেন্দ্রের বাইরে তাঁবু পেতে অবস্থান নেন।
এদিকে রমনির সমর্থকেরাও কিছু ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের ভোটারের হার বাড়ার বিষয়টি ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করছেন। তাঁরা বলছেন, চূড়ান্ত দ্বৈরথে কে জয়ী হবে তারই ইঙ্গিত এটি। রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির সাবেক কর্মকৌশল পরিচালক এড্রিয়ান গ্রে টুইটারে লিখেছেন: নর্থ ক্যারোলাইনা: জিওপি (রিপাবলিকান দলের আদুরে নাম—‘গুড ওল্ড পার্টি’) সমর্থকেরা আগাম ভোট দিচ্ছেন ২০০৮ সালের এই সময়ের ১২৬ শতাংশ হারে। সেখানে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেওয়ার হার ৯৭ শতাংশ। ২০০৮ সালের একই সময়ের তুলনায় রিপাবলিকানরা ৫০ হাজার বেশি ভোট দিয়েছেন।
দীর্ঘ সময় ধরে ভোট দেওয়ার এই পদ্ধতির কারণে রাজনৈতিক দলগুলো মনস্থির না করা বা দলনিরপেক্ষ ভোটারদের নিজেদের বক্তব্য শুনিয়ে দলে টানার সুযোগ পায়। এ ধরনের ভোটারদের ভোট ফলাফলের ক্ষেত্রে খুব জরুরি।
ম্যাকডোনাল্ড বলেন, প্রতিটি আগাম ভোটের পরই প্রচারকর্মীরা তালিকার পরবর্তী নামের দিকে মন দিতে পারেন। তালিকা ধরে ধরে কেবল উচ্চ সম্ভাবনা নয়, কম থেকে মাঝারি সম্ভাবনার ভোটারদের দিকেও অন্য লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন তাঁরা।
আগাম ভোটের এই ঢল প্রার্থীদের কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়, না স্রেফ নির্বাচনের দিন এমনিতেও দেওয়া হতো এমন ভোট আগেভাগে দেওয়া হয় মাত্র—রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এখনো সে বিষয়ে নিশ্চিত নন। ২০০৮ সালে ওবামার বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তার সঙ্গে সম্ভবত পদ্ধতির চেয়ে ব্যক্তির সম্পর্কই বেশি।
ট্রে হুড বলেন, সেবার নানা পরস্পর সম্পর্কিত ঘটনা ঘটেছিল যা আর কখনোই ঘটবে না। যেমন, প্রথমবারের মতো দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনাও ছিল বেশি। অনেকেই কাকে ভোট দেবেন, সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন তুলনামূলকভাবে আগে। এসব কারণে সৃষ্টি হয় ব্যালট-জোয়ার। হুড বলেছেন, এবার কী হয় তা দেখার অপেক্ষায় আছেন তিনি। দেখতে চান ২০০৮ সালের পুনরাবৃত্তি হয়, নাকি এটাই প্রমাণিত হয় যে সেবার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রার্থী ওবামার জন্যই ব্যতিক্রম হয়েছিল।
আগাম ভোটের কেরামতি নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও প্রচারকর্মীরা যেমন লোকজনকে উৎসাহ দিতে ছাড়ছেন না, তেমনি আগেভাগে ভোট দিতে আগ্রহী মানুষেরও কমতি নেই।
আইওয়া অঙ্গরাজ্যের ডে মইনের অধিবাসী অ্যামি পালাজিন জানান, আগাম ভোটের এন্তার প্রস্তাব পেয়েছেন তাঁরা। পালাজিন ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা-কর্মীরা দেখা করেছেন। ডাকেও অনেক প্রচারপত্র, নির্দেশিকা ইত্যাদি পেয়েছেন তাঁরা। ডাকযোগে ভোট দেওয়ার জন্য ব্যালটের অনুরোধ করেছিলেন এ দম্পতি। গত অক্টোবর মাসের শুরুতে তা পূরণ করে পাঠিয়েও দিয়েছেন। ‘আমরা ভোটটা আগেভাগে দিতে চেয়েছিলাম। মনে হলো, ওবামাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এটা একটা ভালো উপায়,’ বলেন পালাজিন। পাঁচ মাসের একটা বাচ্চা রয়েছে তাঁর। সে কারণে ভোট দেওয়ার এই সহজ সুযোগকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। আরেকটা বিষয় ভালো লেগেছে পালাজিনের যে আগাম ও ঘরে বসে ভোট দিতে পারার কারণে তিনি ব্যালট পেপার ভালোভাবে পড়ে দেখতে পেরেছেন। বিভিন্ন প্রার্থী ও তাঁদের আদর্শ ও অঙ্গীকারের বিষয়গুলো অনলাইনে দেখে ভেবেচিন্তে ভোট দিতে পেরেছেন। শুধু তো ওবামা নন, কংগ্রেস নির্বাচনের প্রার্থীদেরও ভোট দিতে হয়েছে তাঁকে। পালাজিন বলেন, ‘যোগ্য প্রার্থীকেই যেন ভোটটা দিই, সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম আমি।’
তবে পালাজিনের মতে, আগাম ভোটের এত সুবিধা সত্ত্বেও এর মধ্যে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার মতো রোমান্টিকতার ছোঁয়াটি নেই। ২০০৮ সালে তিনি নিউইয়র্ক সিটিতে থাকতেন। হার্লেমের একটা স্কুলে ভোট দিয়েছিলেন সেবার। এখনো মনে পড়ে, গোটা ব্যায়ামাগারের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছিল ভোটারদের দীর্ঘ সারি। তাতে ছিলেন প্রথমবার ভোট দেওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত অনেক তরুণ। সব মিলিয়ে বেশ উৎসব-উৎসব পরিবেশ। সে তুলনায় আগাম ভোটকে একটা পানসে ব্যাপার বলেই মনে হয় অ্যামি পালাজিনের।
 সূত্র: বিবিসি

No comments

Powered by Blogger.