জেলা প্রশাসন-ক্ষমতা, কিন্তু কতটা? by জিএম ইউসুফ

একজন কর্মকর্তা যদি ৬৪টি কমিটির সভাপতি হন তাহলে কি কাজের গতি বাড়বে না কমবে? যদি কমিটি বিভাজিত হতো অর্থাৎ যার দফতরের কাজ তিনি যদি কমিটির সভাপতি হতেন তাহলে সেই কাজটি কি আরও গতিশীল হতো না?


ডিসি অর্থাৎ ডেপুটি কমিশনার পরবর্তীকালে প্রচলিত পদবি জেলা প্রশাসক, যদিও শব্দ দুটির অর্থ সমার্থক নয়। দেশের তিনটি প্রধান অঙ্গ_ বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ। ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে কিছু দিন আগ পর্যন্ত বিচার বিভাগের একটি বিরাট অংশ নির্বাহী বিভাগের অধীন ছিল অর্থাৎ আমলাদের হাতে ছিল। দেশ, জাতি ও বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা হয়েছে, এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। নির্বাহী বিভাগ পরিচালনার জন্য মন্ত্রী, আমলা, সাচিবিক কর্মচারীরা নিয়োজিত রয়েছেন। কাজের সুবিধার্থে নির্বাহী বিভাগকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর, অনুবিভাগ ইত্যাদিতে বিভাজন করে নির্বাহী বিভাগ ঢেলে সাজানো আছে। দেশের মূল ক্ষমতা যদি মন্ত্রণালয়, অধিদফতর এবং পরিদফতর হয়ে উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ওপর অর্পণ করা হতো তা হলে কাজের গতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আরও বৃদ্ধি পেত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে ডিসি/টিএনওদের তুলনায় অন্যান্য কর্মকর্তার ক্ষমতা একেবারেই সীমিত।
ডিসি প্রায় ৬৪টি কমিটির সভাপতি। এ ছাড়া আরও ছোটখাটো ১০-১২টির দায়িত্ব রয়েছে। টিএনওর কাছেও অনুরূপ দায়িত্ব দেওয়া আছে। জেলা-উপজেলায় কর্মরত বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা, যারা বিসিএস দিয়ে কর্মরত তারা কোনো অবস্থাতেই মেধা, প্রজ্ঞা, মনমানসিকতায় ডিসি-টিএনওদের তুলনায় কম নয় বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিক প্রজ্ঞার অধিকারী। একটি প্রশ্ন, একজন কর্মকর্তা যদি ৬৪টি কমিটির সভাপতি হন তাহলে কি কাজের গতি বাড়বে না কমবে? যদি কমিটি বিভাজিত হতো অর্থাৎ যার দফতরের কাজ তিনি যদি কমিটির সভাপতি হতেন তাহলে সেই কাজটি কি আরও গতিশীল হতো না?
ডিসি সাহেবরা আরও ক্ষমতা চান, বিশেষ করে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা, বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সভাপতি নিয়োগের ক্ষমতা ইত্যাদি। পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ডিসি সাহেবদের আরও ক্ষমতা না দেওয়ার কারণে আইন-শৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ ও বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে চরম অবনতি ঘটেছে। একটি প্রশ্ন, ডিসি সাহেবরা যখন বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তখন কি আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেনি? এসব বাড়তি ক্ষমতা যদি ডিসি সাহেবদের দেওয়া হয় তাহলে অন্যান্য অধিদফতরে কাজকর্মের গতিশীলতা হারাবে, তাদের মানসিক এবং সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। ফলে আত্মতৃপ্তি নিয়ে কাজ করার সুযোগ কম থাকবে। বিষয়টি সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।
প্রতি বছর ডিসি সাহেবদের সম্মেলন করা হয় এবং তাদের পক্ষ থেকে সরকার একটি লেখ্যচিত্র পেয়ে থাকে। আমি অনুরোধ করব সরকারকে, এ রকম সম্মেলন জেলা পর্যায়ের অন্যান্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নিয়ে যদি করা হয় তা হলে অন্য রকম চিত্র প্রকাশ পাবে। আমি মনে করি, অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়েও এরূপ সম্মেলন করা উচিত। সেখানে দেখা যাবে, উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ডিসি সাহেবদের নজরদারি যে একটি বাধা তা প্রকাশ পাবে।
কেউ যদি মনে করেন, ক্ষমতা দিয়ে কাজ করবে, তার এই ধারণা ভুল। কাজ করার জন্য যে জিনিস দরকার তা হলো ইচ্ছা, মনমানসিকতা, দেশাত্মবোধ, নিঃস্বার্থপরতা, মানুষের প্রতি দরদ, ভালোবাসা ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, ডিসি সাহেবদের আরও ক্ষমতা দেওয়া হলে অন্যান্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়বে। ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে বরং ডিসি সাহেবদের হাতে যেসব অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া আছে সেগুলো অন্যান্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের হাতে অর্পণ করা বাঞ্ছনীয়। সরকারের আরও জড়ড়ঃ খবাবষ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। মন্ত্রী, আমলা, উপদেষ্টাদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্ত সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে না কমাচ্ছে তা আমলে আনা দরকার। আল্লাহ সবাইকে সুমতি দান করুন।

জিএম ইউসুফ : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.