একটি রাস্তাও ভাল নেই- ০ ২১ হাজার কিলোমিটার সড়কের প্রতিটিই ত্রুটিপূর্ণ- ০ ১০ জেলার রাস্তা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত by রাজন ভট্টাচার্য

সড়ক ও জনপথের ২১ হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে শতভাগ ভাল রাস্তা নেই একটিও। ঢাকা-ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম-খুলনা দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই তিন সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে খানাখন্দ আর ভাঙাচোরা দেখা দিয়েছে। রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বে অবহেলার কারণে এই তিন সড়কের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যে বরখাস্ত করেছেন


যোগাযোগ মন্ত্রী নিজেই। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৭০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তার চিত্র বেহাল। ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম বিভাগসহ অন্তত ১০ জেলার রাস্তা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১৫ রোজার মধ্যে দেশের সকল রাস্তা মেরামতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রাস্তা সংস্কারে প্রয়োজন প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। প্রকৌশলীরা বলছেন, অতিরিক্ত মালামাল পরিবহন, অতিবৃষ্টি, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবসহ ড্রেন না থাকার কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। ওজন নিয়ন্ত্রণে করা হচ্ছে ‘মোটরযান এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১২।’ এদিকে রাস্তা সংস্কারে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছে একাধিক টিম। রাস্তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করাসহ সংস্কারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে টিমের সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন। নিয়মিত বরাদ্দ দিয়েই সড়ক সংস্কার করার কথা জানিয়েছেন সওজের কর্মকর্তারা।
মেরামতে প্রয়োজন
১৫০ কোটি
সড়ক ও জনপথের কর্মকর্তারা বলছেন, যথাযথ রক্ষাণাবেক্ষণসহ আকস্মিক বন্যার কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকার সড়ক মহা-সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ রোজার মধ্যে জেলা সড়কসহ দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছেন যোগাযোগ মন্ত্রী। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বর্ষায় দেশের ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়কে সর্বক্ষণিক যানবাহন চলাচল নির্বিঘœ রাখতে মন্ত্রণালয়ের ৩২ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গঠন করা হয়েছে একাধিক টিম। যারা সড়ক মহাসড়কের অবস্থা দেখতে নিয়মিত ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন। যেখানেই সড়কের বেহাল চিত্র চোখে পড়ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা সমাধানের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
দেশের সাত জেলার বন্যাবিধ্বস্ত শতাধিক সড়ক মেরামতেই দেড় শ’ কোটি টাকা চেয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিন আগে পাহাড়ী ঢল ও অতিবর্ষণের কারণে সৃষ্ট বন্যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ব্যবস্থা যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে বাঁধ ভেঙে সড়ক তলিয়ে গেছে। কোথাও বিধ্বস্ত হয়েছে সেতু। কক্সবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও কুড়িগ্রাম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। চট্টগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক-সড়কের মধ্যে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যানবাহন চলাচলের জন্য পুরোপুরি উপযোগী করতে এই মহাসড়ক মেরামতের জন্য অধিদফতর থেকে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৭০ লাখ টাকা।
যেসব এলাকায় বেহাল দশা ॥ বৃহত্তর চট্টগ্রামের বেশিরভাগ রাস্তা বেহাল। নিজের চোখেই খুলনা-ঢাকা মহাসড়কের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রাস্তার বেহাল দশা দেখে সওজের কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ‘ঈদের আগে রাস্তা ঠিক না করতে পারলে খবর আছে।’ এর আগে তিনি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পরিদর্শনে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে রাস্তার বেহাল চিত্র চোখে পড়ে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মন্ত্রী। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তাৎক্ষণিকভাবে সওজের ঢাকা জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাহাবুদ্দিন আহমেদসহ আরেক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। ঢাকা-টাঙ্গাইল-সাভারসহ দেশের যে প্রান্তেই সড়ক পরিদর্শনে গেছেন মন্ত্রী সেখানেই যথাযথভাবে রাস্তা মেরামত ও রক্ষাণাবেক্ষণ না করার চিত্র চোখে পড়েছে।
অধিদফতরের সিলেট জোন থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের চার জেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১২টি সড়ক। এর মধ্যে শুধু সিলেট জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৯টি সড়ক। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে একটি করে সড়ক বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কও রয়েছে। সিলেটে পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যার কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর মধ্যে রয়েছে, সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-বালাগঞ্জ, সারি-গোয়াইনঘাট, দরবস্ত-কানাইঘাট-শাহবাগ, সিলেট-গোলাপগঞ্জ-চারখাই, বিমানবন্দর-বাদাঘাট সড়ক।
সওজের তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রামে আটটি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক হলো ছয়টি, যার মধ্যে রাজীবপুর- রৌমারী-দাঁতভাঙ্গা সড়কের অবস্থা বেশি কাহিল। এ সড়কের এক জায়গায় ৩০ মিটার অংশ বানের পানিতে ভেসে গেছে। এখানে তৈরি করা হয়েছে বাঁশের সেতু। সওজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, একইভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন সড়কও মেরামত করতে হবে জরুরী ভিত্তিতে।
এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বেশ কিছু স্থানে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরে গেছে বিটুমিন ও কংক্রিট। ছোট বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে কিছু স্থানে। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই রুটের শ্যামগঞ্জ বাজারে রাস্তার অবস্থা যেমন বেহাল। তেমনি প্রায় দুই কিলোমিটার জায়গা রাস্তা সরু হওয়ায় যানজটে ভোগান্তি নিত্যদিন। এছাড়া নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার রাস্তার প্রায় পুরোটা জুড়েই দুর্ভোগ আর দুর্ভোগ। এই সড়কটি সরু হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে দুটি গাড়ি ক্রসিং করা কষ্টকর। একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে অন্য গাড়িটি যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হয়। কাদা পানিতে দু’পাশের রাস্তার প্রায় অর্ধেক অংশ এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পয়েন্টে গর্ত তো আছেই। মাদারিপুরের কালকিনি, খাগড়াছড়ির ঢাকা-মাটিরাঙা রাস্তা, সাভারের বিশমাইল-জিরাব সড়ক, ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৭০ কিলোমিটার চলাচলের অযোগ্য ॥ দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক একটি। মাত্র এক বছর আগে ঈদকে সামনে রেখে এই রাস্তাসহ আরও কয়েকটি রাস্তার বেহাল অবস্থা নিয়ে সারাদেশে হইচই। বলতে গেলে পুরো রাস্তাটিই চলাচলের অযোগ্য ছিল। বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের। যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে তাঁকে সরানোর অন্যতম কারণ ছিল রাস্তা সংস্কারের ব্যর্থতা।
এক বছরের মাথায় আবারও রাস্তাটির বেশ কিছু অংশে এখন বেহাল দশা বিরাজ করছে? এ প্রশ্ন এখন সবার সামনে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বারইয়ারহাট ও রড় দারোগারহাটসহ সব মিলে ৭০ কিলোমিটার রাস্তা এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। মীরসরাইয়ের রড় দারোগারহাট, ছোট কমলদহ, সরকারহাট, হাদি ফকির হাট, নয়দুয়ার, কলঘর, বড় তাকিয়া, বাইপাস, মীরসরাই সদর সহ ৪০ কিলোমিটার রাস্তার কার্পেটিং উঠে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। জানা গছে, ২০১১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংস্কারে ব্যয় হয় ৪৫ কোটি টাকা। প্রশ্ন উঠেছেÑ এক বছরে রাস্তার বেহাল দশা কেন।
রাস্তা ভাঙার কারণ ॥ প্রকৌশলীরা বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে রাস্তা নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ হলো অতিরিক্ত মালামাল পরিবহন। এর সঙ্গে রয়েছে অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতাসহ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করা। সড়ক রক্ষাণাবেক্ষণ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর গর্তসহ নষ্ট হওয়ার সড়ক মেরামত ও আস্তর দেয়া। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই রাস্তা পাকা করা। দেশের বেশিরভাগ সড়ক ১৫ টন মালামাল পরিবহনের উপযোগী করে নির্মাণ করা। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সর্বোচ্চ ২০ টন লোড ধারণের উপযোগী। কিন্তু সিঙ্গেল এক্সেলের ট্রাক/লরি দিয়ে নিয়মিত ৩৫ টনের বেশি মালামাল পরিবহন করা হচ্ছে। এজন্য দ্রুত সময়ের রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া দিনে ২৫/৩০ হাজার যানবাহনর চলাচল করছে এই মহাসড়ক দিয়ে। যা মাত্রাতিরিক্ত। এছাড়া সড়ক-মহাসড়কের পাশে ড্রেন না থাকা ও অতিরিক্ত নগরায়নের কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাস্তা থেকে বৃষ্টির পানি সরতে পারে না। ফলে রাস্তা নষ্ট হয়।
সওজের ঢাকা জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাহাবুদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সড়কের ধারণক্ষমতার বেশি মালামাল পরিবহনে দ্রুত সময়ে রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। ভবিষ্যতে আমাদের দেশে ২০/২৫ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সড়ক নির্মাণের বিকল্প নেই। অন্যাথায় সড়ক রক্ষা করা কঠিন হবে। এছাড়াও মালামাল পরিবহনে ওজন নিয়ন্ত্রণে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ‘মোটরযান এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১২’ করছে। চলতি বছরের এক জুলাই থেকে এই নীতিমালা কার্যকর করার কথা। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সওজের বার্ষিক বরাদ্দ অর্থ দিয়ে রাস্তা সংস্কার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, ঢাকা জোন সহ দেশের সকল রাস্তা পুরোপুরি ভাল তা বলা যাবে না। বলতে গেলে শতভাগ ভাল রাস্তা নেই। বৃষ্টিতে অনেক রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ ঈদের মধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়কসহ জেলা রুটগুলোও যানবাহন চলাচলের উপযোগী করে তোলা হবে।

No comments

Powered by Blogger.