কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

দেশের সব প্রভাতফেরির পথ গিয়ে থেমেছে ভাষাশহীদের পবিত্র বেদি শহীদ মিনারে। আজ মহান শহীদ দিবস। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে বায়ান্নর এই দিনে বাঙালির রক্তে রাজপথ রক্তাক্ত হয়েছিল। সেই রক্তের পথ বেয়ে এসেছে একাত্তর-মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা।


একুশে ফেব্রুয়ারি তাই মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে বাঙালির অস্তিত্বে এবং সত্তায়। বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বজুড়ে নিপীড়নের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একুশের চেতনা তাই আড়ালের অনুপ্রেরণাও বটে। এখন দেশে দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিউগলে বাজে একুশের অমর গানের সুর। তারা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে চেনে গভীর শ্রদ্ধায়। স্বাধীনতার মাত্র চার দশকের ভেতর এই অর্জন গৌরবের, অহংকারের। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি উন্মুক্ত করেছে বাংলার সব সম্ভার নিয়ে বিশ্বসভায় পেঁৗছানোর সুবর্ণ দুয়ার। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশ্বমাঝে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরার এমন সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। নিতে হবে পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ। এর আগে নিজেদের প্রস্তুতিরও দরকার আছে।
যদি প্রশ্ন তোলে কেউ, শহীদ মুনীর চৌধুরীর 'কবর' নাটক ছাড়া ভাষা আন্দোলন নিয়ে আর কয়টি বড় মাপের নাটক নির্মিত হয়েছে? শহীদ জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া' ছাড়া আর কয়টি ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে বায়ান্নর দৃশ্য নিয়ে? জানি, এসব প্রশ্ন অবান্তর। নাটকের প্রসঙ্গে বলি, স্বাধীনতার পর গত চার দশকে বাংলাদেশের মঞ্চে এমন একটি নাটকও কি মঞ্চস্থ হয়েছ যেখানে একুশ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রিত বিষয়-ঘটনার সংলাপ উচ্চারিত হয়নি? এমন কোনো পথনাটকের নাম কেউ উল্লেখ করতে পারবেন যেখান একুশ উপেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তি খাটো করা হয়েছে? বাংলাদেশের নাটকই একমাত্র শিল্পমাধ্যম যেখানে একটি বারের জন্যও বাংলা ভাষার মর্যাদা নষ্ট হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের সঙ্গে বেইমানি করা হয়নি। জাতীয় ক্ষেত্রের অনেক জায়গাতেই একুশ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভাজন হয়েছে, লোভ ও স্বার্থপরতার সঙ্গে আপস করা হয়েছে। শুধু নাটকের কর্মীরাই প্রতিটি কর্মপ্রয়াসে নতশির, নতজানু একুশ এবং একাত্তরের কাছে। নিজ ভাষায় অহংকারী সংলাপ উচ্চারণের অধিকার দেশের সব নিবেদিত প্রাণ নাট্যকর্মী পেয়েছেন প্রাণের একুশ থেকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে। দেশের অগণিত সৃজনশীল নাট্যকর্মী তাঁদের মৌলিক সৃজনশীলতার মাধ্যমে গড়ে তুলতে চাইছেন যে আলোকিত নাট্যভুবন, সে তো একুশ আর একাত্তরের আলোছায়ার পবিত্র পথ ধরেই। শত নোংরা-জঞ্জালের ভেতর, শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধ স্রোতে দাঁড়িয়ে পদ্মফুলের মতোই তাঁরা ফোটাতে চাইছেন শিল্পের নিজস্ব ফুল, নিজস্ব ভাষায়, নিজস্ব আঙ্গিকে। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের ধূলিঝড়ের মাঝেও বাঁচিয়ে রাখছেন বাংলা নাটকের নান্দনিক শিল্পবৃক্ষ, যার শিকড়-কাণ্ড-পত্রপল্লবে, শাখা-প্রশাখায় একুশের পবিত্র নির্যাস, একাত্তরের চেতনার অমিয়ধারা। নিজ ভূমিতে দাঁড়িয়েই সেই বৃক্ষ আন্তর্জাতিকতার আকাশ স্পর্শ করতে চায়। আমি আন্তর্জাতিকতা বলতে বিশ্বায়ন বোঝাতে চাই না। বিশ্বায়ন বাণিজ্যের শব্দ, নব্য পূঁজিবাদের আবিষ্কার। বিশ্বায়ন-বাণিজ্য সব সৃজনশীলতার নান্দনিকতাকে খেয়ে ফেলে নিজ স্বার্থে ন্যাড়া পণ্য বানিয়ে দেয়। দেশের অভ্যন্তরেও কি কম শত্রু, কম প্রতিবন্ধকতা! যারা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল, তাদের উত্তরসূরিরা কি আজও বেঁচে নেই! আছে এবং শক্তভাবেই আছে। যারা বাঙালির চিরায়ত দর্শন ও সংস্কৃতির ঘোরতর বিরোধী তাদের অস্তিত্বও সমাজে কম নয়। তারা বেশ দাপটের সঙ্গেই আছে। রক্তচোষা গিরগিটির মতো তারা প্রয়োজনমতো রং পাল্টায়। বায়ান্নর স্থানীয় শাসকের ভাষা উর্দুকে নিয়ে যারা মেতেছিল তারাই আজ বিশ্বশাসকের ভাষা ইংরেজির কাছে আত্মসমর্পন করে বাংলা এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। তাদের নিজ পরিবারে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা নেই, অফিসের ডেস্কে বাংলা অনুপস্থিত। লুটেরা শ্রেণীর টাকায় গড়ে ওঠা তথাকথিত গালভরা নামের বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের মর্যাদা বিপর্যস্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভাষাশহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ পর্যন্ত নেই।
দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, স্বাধীনতার পর চার দশকের অনেকটা সময় ধরে বাঙালির শাসনভার ছিল তাদের হাতে যারা বাংলা ও বাঙালি চেতনাবিরোধী। রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে তারাই যারা স্বপ্রণোদিত হয়ে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দর্শনকে চিরতরে শিকড়চ্যুত করতে চেয়েছে। 'কবর' এবং 'জীবন থেকে নেয়া' সৃষ্টির জন্য এদেরই ষড়যন্ত্রে আমরা হারিয়েছি মুনীর চৌধুরী এবং জহির রায়হানকে। এই অপশক্তির শাসনামলে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে বাঙালির শুদ্ধ ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চাকে বিকলাঙ্গ করার চেষ্টাও চলেছে বারবার। জাতির ইতিহাস বিকৃত করে নতুন প্রজন্মকে শেখানো হয়েছে উদ্ভট এক ইতিহাস। যার সঙ্গে অমর একুশ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্কই নেই। বাংলাদেশ এবং বাঙালির অস্তিত্বের ওপর যা ছিল ভয়াবহ আঘাত। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন দেশের শুভবোধসম্পন্ন মানুষ এবং একুশ ও একাত্তরের চেতনাশ্রিত শিল্পকর্র্মীরা। প্রতিরোধের কর্মযজ্ঞে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের চেয়ে তাঁরা খুব একটা পিছিয়েও ছিলেন না।
তবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া কোনো অর্জন তো সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। তাই লেখার শুরুতে যে সমন্বিত উদ্যোগ এবং আপন প্রস্তুতির কথা বলছিলাম, তা এখন সম্পন্ন করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যথাযথ নির্দেশনায়। যদিও দেরি হয়ে গেছে, তবু সময় তো পার হয়ে যায়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে বিশ্বজুড়ে তৈরি করা যেতে পারে নতুন বলয় এবং সেটা হতে পারে বাংলাদেশের উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.