দশ গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ নিয়ে ফিরে গেলেন জেলা প্রশাসকরা-দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে by তৌহিদুর রহমান

তিন দিনব্যাপী জেলা সম্মেলন শেষে জেলা প্রশাসকরা সরকারের বিশেষ দশটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ নিয়ে ফিরে গেলেন। এসব নির্দেশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে এসব নির্দেশ বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়।


জেলা প্রশাসকদের সমাপনী অধিবেশনে যেসব নির্দেশ অগ্রাধিকারভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য দশটি হচ্ছেÑ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, রমজান সামনে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং জোরদার, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল রোধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, বিদ্যুত পরিস্থিতি সামাল দেয়া, ঈদে ঘরমুখী মানুষের চলাচল নিশ্চিত, উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে আবহাওয়া উপযোগী ফসল উৎপাদনে পদক্ষেপ গ্রহণ, বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার পাসপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা গ্রহণ, সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ও রাষ্ট্রবিরোধী এনজিও’র কার্যক্রম বন্ধে কার্যক্রম গ্রহণ।
জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে প্রশাসন থেকে জনগণ যেন সহজেই সেবা পান সে বিষয়ে নির্দেশনা দেন।
জেলা প্রশাসক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের রমজান সামনে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার, অতিরিক্ত মুনাফাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, প্রতিবছর রমজানের শুরুতে অনেক ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকেন। ব্যবসায়ীরা যাতে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারেন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জেলা প্রশাসক সম্মেলনে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঈদে বাড়ি যাওয়া নিশ্চিত করতে দেশের সকল সড়ক যোগাযোগ সচল রাখতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেন। ঈদে যেন কোনভাবেই সড়ক চলাচল ব্যাহত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়া মহাসড়কে নসিমন-করিমন যেন না চলে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। একই সঙ্গে ঈদে বাড়ি যাওয়া নিশ্চিত করতে দেশের সড়ক যোগাযোগ চলাচল করতে নির্দেশ দেয়া হয়।
বৈঠকের দ্বিতীয় দিনে পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার জেলা প্রশাসক অফিস থেকে পাসপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে। সে কারণে কোনভাবেই যেন রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট না পায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরদিকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে কক্সবাজার এলাকার স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়।
মাঠ পর্যায়ে কৃষি খাতে কোন সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার নির্দেশ দেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ে কৃষি খাতের সমস্যা দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। আর সমস্যা মাঠ পর্যায়ে সমাধান না করা গেলে, দ্রুত মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের ধারাবাহিকতার ধরে রাখার নির্দেশ দেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়া বিবেচনায় নিয়ে ফসল উৎপাদনে জোর দেন তিনি।
সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পে যেন স্বচ্ছতা ও জবাবহিতিহা বজায় থাকে সে নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পে যে কোনভাবেই স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। এছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও দ্রুততা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ জেলা প্রশাসক সম্মেলনে জানান, বিদেশ থেকে টাকা এনে অনেক এনজিও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করছে। জেলা পর্যায়ে এনজিওগুলোর কার্যক্রম আরও নিবিড়ভাবে তদারক করতে হবে। অনেক এনজিও’র রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় ইতোমধ্যে নিবন্ধন বাতিল করেছে সরকার।
সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেন, মাদকদ্রব্য এখন একটি জাতীয় সমস্যা। সর্বনাশা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করতে তিনি জেলা প্রশাসকদের প্রতি আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসকদের উল্লেখযোগ্য সুপারিশ
সম্মেলনে জেলা প্রশাসকরা বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি পদের জন্য সুপারিশ করেন। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসকরা সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষমতা চান। তবে এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব আলাদা হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের আদেশে ফৌজদারী আইন সংশোধন করা হয়েছে। সুপ্রীমকোর্ট বলে দিয়েছে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ কি কি কাজ করবে। সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে জেলা প্রশাসকদের বিচারিক ক্ষমতা দেয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। আর তা দেয়ার বিধানও নেই আইনে। অপরদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অর্থ যোগাতে মোবাইল গ্রাহকদের প্রতি কলে ১০ পয়সা সারচার্জ আরোপ করার সুপারিশ করেন জেলা প্রশাসকরা। এছাড়া বন্যা এলাকায় বাঁধ নির্মাণ, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অর্থ যোগাতে মোবাইল গ্রাহকদের প্রতি কলে ১০ পয়সা সারচার্জ আরোপ, বিদ্যুত পরিস্থিতি উন্নয়ন, ভূমি অফিসে সহকারী কমিশনার/কানুনগো/সার্ভেয়ার ইত্যাদি শূন্য পদ পূরণ, বিএসটিআই-এর জনবল বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা মনিটরিং করার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট, টিআর-কাবিখা প্রকল্প এককভাবে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে বণ্টন না করা ইত্যাদি সুপারিশ করেন। তবে এসব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে।
গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলন উদ্বোধন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। ওইদিন বিকেলে সচিবালয়ে কার্য অধিবেশন শুরু হয়। প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, পরিকল্পনা ও গৃহায়ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত অধিবেশন হয়।
দ্বিতীয় দিনে ভূমি, পরিবেশ ও বন, যোগাযোগ, রেলপথ, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, শ্রম ও কর্মসংস্থান, প্রবাসী কল্যাণ, পররাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও পরিবার, মহিলা ও শিশু, জনপ্রশাসন, খাদ্য ও দুর্যোগ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত অধিবেশন হয়।
শেষ দিনে তথ্য ও সংস্কৃতি, যুব ও ক্রীড়া, বস্ত্র ও পাট, বেসমারিক বিমান ও পর্যটন, পানি সম্পদ, নৌপরিবহন, আইন ও বিচার, সমাজকল্যাণ, বিদ্যুত ও জ্বালানি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধিবেশন বসে। তিনদিনে ২০টি কর্ম অধিবেশনে ৩৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মন্ত্রী-সচিবসহ শীর্ষ কমকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়।

No comments

Powered by Blogger.