ধন্য আশা কুহকিনী by এম আবদুল হাফিজ

বিগত সাড়ে তিন বছরের আমলনামার দিকে কিঞ্চিৎ দৃষ্টিপাত করলেও ক্ষমতাসীনদের এ সময়ে অনুতপ্ত হয়ে মেয়াদের অবশিষ্ট সময়টুকু জনগণের যন্ত্রণা লাঘবে আত্মনিয়োগ করার কথা। সবার এমন ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে জোটনেত্রী থেকে শুরু করে মহাজোটের তৃণমূল পর্যন্ত সর্বত্রই মেজাজ পরিতৃপ্তির ও এক প্রকার সেলিব্রেশনের।


সর্বাধিক দলীয়করণ থেকে শুরু করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী পর্যন্ত দশম পার্লামেন্ট জয়ের সব কৌশল ইতিমধ্যেই নির্ধারিত করার পরও দুচিন্তা কিছু থেকে থাকলেও মহাজোট তা কালেভদ্রে প্রকাশ পেতে দেয়। বরং ক্ষমতাসীনদের প্রত্যয় দৃপ্ত উচ্চারণে তা চাপা পড়ে যায়। অধিবাস্তব কথাবার্তায় তারা পরবর্তী নির্বাচনেও তাদের নিশ্চিত জয়ের আবহ ফুটিয়ে তোলে।
ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এটাই নিয়ম। চারদলীয় জোট সরকারও তাদের অন্তিম সময়ে এমনটাই করেছিল। আরও অতীতের কোষ্ঠী ঘাঁটলে দেখা যায় যে, সেই পাকিস্তান আমল থেকে ক্ষমতাচ্যুতির সময় ঘনিয়ে এলেই দেখা যেত যে ক্ষমতাসীনদের মনোবৈকল্য শুরু হয়ে যেত। আওয়ামীদেরও এখন সেই অবস্থা। তারা এখন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, উন্নয়নের ধারাকে বহমান রাখতে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে তাদের অপরিহার্যতার কথা বলে।
অনেক দিন ধরে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি অভিব্যক্তিগুলোকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত এটুকুই বুঝেছি যে, ওগুলো নিছক রেটোরিক। তা না হলে এ কথা তো সত্য যে, অনেক মুক্তিযোদ্ধার ভিক্ষাবৃত্তির ওপর বেঁচে থাকার সচিত্র প্রতিবেদন মাঝে মধ্যেই সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়। আবার অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাই চুটিয়ে বাঁচার কৌশলও রপ্ত করেছেন। অন্তিমে যেটা কঠিন সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়, তা হচ্ছে শ্রেণী-স্বার্থ, পরিবারতন্ত্র এবং কায়েমি স্বার্থবাদ।
অপরিহার্যতা? তা হয়তো সত্য এই দেশটার স্বার্থকে আরও বিপন্ন করা এবং জনগণের দুর্ভোগকে প্রলম্বিত করার জন্য। জনগণই আপনাদের বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলায় ও ভোগবাদে নিমজ্জিত হওয়ার বলির পাঁঠা। বঙ্গবন্ধুকে আবেগ ভরে ভালোবেসে তারাই আপনাদের ২০০৯ সালের প্রদোষলগ্নে ক্ষমতায় বসিয়েছিল বুকভরা প্রত্যাশা নিয়ে। এই জনগণই মাঠে ফসল ফলিয়ে দেশকে স্বনির্ভর করে, যা নিয়ে আপনারা ক্ষমতাসীনরা গর্ব করেন, এই জনগণই জীবনবাজি রেখে বিদেশ বিভুঁইয়ে পাড়ি জমায়, পদে পদে অপদস্থ হয়, আপনাদের দূতাবাসও তাদের অবজ্ঞা করে।
ক্ষমতাসীনরা তাদের রাজনীতির স্বার্থে একটুখানি অন্তর্দর্শন করলেই বুঝবেন যে দেশবাসীরা কতভাবে তাদের কাছে প্রতারিত। দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে মহাজোটের ক্ষমতার অন্তিম সময়ে এসেও তারা জর্জরিত। আওয়ামী নেতৃত্ব তাদের মিষ্টি কথায় ও নানা আশ্বাস বাণীতে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কখনোই তাদের ছাড়েনি। ইচ্ছা বা অনিচ্ছার সব সরকারি পদক্ষেপ মুনাফাখোরদের অনুকূলেই গেছে।
আর দুর্নীতি? দুর্নীতি সম্বন্ধে বলতে গেলে এক 'বিষাদসিন্ধু' রচিত হবে, যার সুযোগ এই নিবন্ধে নেই। কুইক রেন্টাল সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি তো এখন ওপেন সিক্রেট। ভুক্তভোগী মানুষরা জানে থানা পুলিশের দুর্নীতি ও নির্যাতন। শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক সংস্কারের কথা বলেন। কিন্তু এদিকে তাদেরই দুর্বৃত্ত সহযোগী ক্যাডাররা তছনছ করেছে দেশের প্রেসটিজিয়াস শিক্ষাঙ্গনগুলো। জাহাঙ্গীরনগর ও বুয়েটের অচলাবস্থা এখন সংবাদ শিরোনাম।
তবু ক্ষমতাসীনরা আশা করে আছেন মহাজোট অন্তঃপ্রাণ জনগণ নাকি আওয়ামীদের ছাড়া সবাইকেই প্রত্যাখ্যান করবে। তাই যদি হয় তাহলে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কেন এত ছলনা? ক্ষমতাসীনরা কোনো কিছুকে এত ভয় করেন না শুধু ক্ষমতাহীনভাবে বাঁচার বাস্তবতাকে ছাড়া। কিন্তু বাস্তবতাবর্জিত কোনো কৌশলই তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পারে সাহায্য করবে না।
তার চাইতে ক্ষমতাসীনরা বরং তাদের বাকি দিনগুলাকে তাদের ব্যর্থতা পুষিয়ে দিতে যদি ব্যবহার করে তাহলে ভালো করবে। জাতির উজ্জীবনে বিভিন্ন চেতনার পুনরুক্তি হয়তো প্রয়োজনীয়, কিন্তু অতি ব্যবহার সেগুলোকে হীনম্লান করে দেয়। তাছাড়া সেগুলো তো নৈর্ব্যক্তিক, নির্বিকার। একজন ক্ষুধার্ত বা শোকার্ত মানুষের কাছে ওই চেতনাগুলোর কোনো মাহাত্ম্য নেই, না সেগুলো তাদের কষ্ট লাঘবে কোনো কাজে লাগে।
সরকারের এমন কোনো খাত নেই যেখানে মহাজোট দুঃশাসনের আঁচড়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়নি। এই ক্ষতগুলোর আরোগ্যই এখন মহাজোটের অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। নির্বাচনে কে কাকে নির্বাচিত করবে সেটা একান্তই জনগণের ব্যাপার। তাদের যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞান আছে, এই ক্ষমতাকে প্রয়োগ করার।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিএসএসআইআই ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.