মুক্তাঙ্গন আদৌ মুক্ত ছিল by আসিফ আহমেদ

মুক্ত নয় মুক্তাঙ্গন_ এ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে শুক্রবার সমকালে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ও অতিমাত্রায় ব্যস্ত এলাকা পুরানা পল্টনের মোড়ের কাছে অবস্থান এর। ছোট্ট এক খণ্ড মাঠ এখন রেন্ট-এ কারের চালকরা দূরপাল্লার যাত্রীদের 'গলাকাটার' জন্য মুক্তভাবেই ব্যবহার করে। এ জন্য তারা নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে চাঁদা দেয়।
'মুক্তাঙ্গন' শব্দটি মুক্ত-যুক্ত, তবে এর প্রতিষ্ঠার পেছনে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর সময়কালের খামখেয়ালি যুক্ত ছিল, সেটা এখন অনেকেই বিস্মৃত। সমকালের প্রতিবেদনে লেখা হয়, 'স্বাধীন মতপ্রকাশের স্থান হিসেবে ১৯৭৯ সালে মুক্তাঙ্গনের প্রতিষ্ঠা। যুক্তরাজ্যের হাইড পার্কের চিন্তাধারা থেকে এর পত্তন। হাইড পার্কে পৃথিবীর যে কোনো দেশের নাগরিক তার বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন। যুক্তরাজ্য সরকারের সমালোচনা করেও হাইড পার্কে বক্তৃতা দেওয়া বৈধ। একই লক্ষ্যে মুক্তাঙ্গনের প্রতিষ্ঠা হলেও তা মুখ থুবড়ে পড়েছে।'
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে স্বাধীন দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ক্ষমতার দখল যায় সামরিক বাহিনীর হাতে। তখন কথা বলার স্বাধীনতা নেই। সংবাদপত্রের কণ্ঠরুদ্ধ। বেতার-টিভি কেবল সরকারের মুখপত্র। সংগঠন করা নিষিদ্ধ। বছরখানেক যাওয়ার পর ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মো. সায়েম এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান 'ঘরোয়া রাজনীতি' নামে এক আজব ব্যবস্থা চালু করেন। এর আওতায় রাজনৈতিক দল কিংবা অন্য যে কোনো সংগঠন চার দেয়ালের ভেতরে কমিটির সভা করতে পারত। তবে তাদের মতামত সংবাদপত্রে পাঠাতে হলে প্রথমে যেত সরকার নিয়ন্ত্রিত 'বাসসের' কাছে এবং সেখান থেকে 'সামরিক-ছাড়পত্র' মিললে প্রকাশ পেত সংবাদপত্রে। এই 'ঘরোয়া রাজনীতিরই' অনুষঙ্গ ছিল মুক্তাঙ্গন। সেনাছাইনি থেকে ১৯৭৬ সালে (১৯৭৯ সালে নয়) ফরমান এলো_ হাইড পার্কের আদলে 'মুক্তাঙ্গন' প্রতিষ্ঠিত হলো এবং সেখানে 'যে যা খুশি বলতে পারে'। দেশব্যাপী নিষ্ঠুর সামরিক শাসনকে আড়াল করার জন্যই এমন আয়োজন ছিল। দেখা গেল যে কিছু অতি উৎসাহী লোক 'মুক্তাঙ্গনে' প্রতি বিকেলে হাজির হয়ে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা করছেন। মাইক ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। কখনও কখনও মঞ্চ ব্যবহারের জন্য বক্তাদের লাইন পড়ে যেত। প্রথম প্রথম সংবাদপত্র মুক্তাঙ্গনে দেওয়া বক্তৃতার অংশবিশেষ প্রচার করতে থাকে। এর মাধ্যমেই পাঠকরা জানতে পারে যে, মুক্তাঙ্গনে কোনো কোনো বক্তা সরকারের কাছে কিছু দাবি তুলে ধরছে কিংবা কেউ কেউ সরকারের সমালোচনা করছে। ব্যস, দ্রুতই নতুন সামরিক ফরমান জারি হলো_ মুক্তাঙ্গনে দেওয়া বক্তৃতার কোনো অংশ সংবাদপত্রে প্রকাশ করা যাবে না। সেখানে যে যা বলবে, সেটা হাতেগোনা কয়েকজন শ্রোতার (কখনও কখনও কেবলই বাদাম বিক্রেতা কিংবা ভবঘুরেরাই থাকত এ দলে) কর্ণকুহর ভেদ করে যাবে, অন্য কারও জানার উপায় থাকবে না। সামরিক শাসনের জাঁতাকলে মতপ্রকাশ যখন পিষ্ট হচ্ছিল, তখন এ অঙ্গনে বলা নানা কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ হওয়ায় যে ছিটেফোঁটা নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ মিলছিল, এভাবে অঙ্কুরেই তার বিনাশ ঘটে। মুক্তাঙ্গন দ্রুতই হারিয়ে ফেলে আকর্ষণ। সামরিক শাসকদের তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। তারা মতপ্রকাশ ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিষিদ্ধ রেখেই ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। এ সংসদেই সংবিধান সংশোধনসহ সামরিক শাসকদের জারি করা সব ফরমান পাস হয় (যা বাতিল হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক রায়ে)।
এমন 'মুক্তাঙ্গনের' জন্য আহাজারির কোনো দরকার আছে কি? রাজধানীতে অবশ্যই মানুষের মতপ্রকাশের জন্য উন্মুক্ত স্থানের প্রয়োজন রয়েছে। ছোট ও বড় সব ধরনের সমাবেশ করায় সরকারের তরফেও সহযোগিতা থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সেটার স্ট্যান্ডার্ড কোনোভাবেই 'সামরিক ফরমানে প্রতিষ্ঠিত' মুক্তাঙ্গন হতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.