গ্যাসের সন্ধান ॥ কুমিল্লার শ্রীকাইলে-০ অক্টোবর-নবেম্বরে জাতীয় গ্রিডে দেয়া হবে ০ সুনেত্রতে ড্রিলিং শুরু কাল

কুমিল্লার শ্রীকাইলে গ্যাস পেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। শুক্রবার সকাল ন’টা থেকে গ্যাসের ফ্লো দিচ্ছে। ক্ষেত্রটি থেকে অক্টোবর-নবেম্বরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। প্রাথমিক অবস্থায় মনে করা হচ্ছে এখান থেকে দৈনিক ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে।
এদিকে রবিবার থেকে সম্ভাবনাময় সুনেত্রতে ড্রিলিং শুরু করতে যাচ্ছে বাপেক্স।
এ নিয়ে ১১ মাসের ব্যবধানে নিজস্ব জনবল এবং প্রযুক্তি দিয়ে দুটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করল বাপেক্স। গত বছর আগস্টে নোয়াখালীর সুন্দলপুরে গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের খবরে বাপেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেছেন, এ অর্জন সমগ্র জাতির।
বাপেক্স কর্মকর্তারা বলছেন, এটি হবে দেশের ২৫তম গ্যাসক্ষেত্র। অনুসন্ধান কূপ থেকে দৈনিক ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে। অনুসন্ধান কূপে এখন এক হাজার ৭০০ পিএসআইজি (প্রেসার পার স্কয়ার ইঞ্চি গ্যাস) চাপ রয়েছে। ক্ষেত্রটিতে কি পরিমাণ মজুদ রয়েছে এবং কতদিন গ্যাস উত্তোলন করা যাবে এসব বিষয়ে আজ শনিবার নিশ্চিত হওয়া যাবে।
পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনছুর শুক্রবার জনকণ্ঠকে বলেন, শ্রীকাইল থেকে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে হলে তিন কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া গ্যাসক্ষেত্রটি নতুন হওয়ায় একটি প্রসেস প্লান্ট বসাতে হবে। পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে বৃষ্টির কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে। আর বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড থেকে আপাতত একটি প্রসেস প্লান্ট ধার নেয়া হবে। তিনি বলেন, আশা করছি অক্টোবর-নবেম্বরের মধ্যে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে। জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, এখানে আরও একটি উন্নয়ন কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তবে এর আগে দ্বিমাত্রিক জরিপের ফলাফল ভাল করে বিশ্লেষণ করা হবে। তিনি বলেন, এ রিগটি এখানেই থাকবে। শীঘ্রই কূপ খননের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তিনি জানান, এখানে গ্যাসের দুটি লেয়ার রয়েছে। তিন হাজার ১৭ থেকে তিন হাজার ৪৩ মিটার গভীরতায় ডি লেয়ারের পুরত্ব ২৬ মিটার। যেখান থেকে এখন গ্যাস তোলা হচ্ছে। গ্যাসের আরেকটি স্তর ডি আপার লেয়ার রয়েছে দুই হাজার ৯২৭ থেকে দুই হাজার ৯৮৫ মিটার গভীরতায়। যেখানে পারফোরেশন করা হবে। ওই স্তর থেকেও গ্যাস তোলা হবে। তিনি বলেন, গত এক বছরে বাপেক্স তিনটি নতুন গ্যাসক্ষেত্রে অনুসন্ধান কূপ করেছে, যার দুটিতেই গ্যাস পাওয়া গেছে। আগামী রবিবার থেকে বাপেক্স সম্ভাবনাময় স্ট্রাকচার সুনেত্রতে ড্রিলিং শুরু করবে বলেও জানান তিনি।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমেদ ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রে কি পরিমাণ গ্যাস আছে এবং দৈনিক কি পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা যাবে তা জানতে শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে ড্রিলিং স্টিম টেস্ট (ডিএসটি) শুরু হয়েছে। ক্ষেত্রটিতে কি পরিমাণ গ্যাস রয়েছে তা আজ জানা যাবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি অনুসন্ধান কূপ থেকে দৈনিক ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দেয়া সম্ভব হবে।
শুক্রবার সকালেই গ্যাসের ফ্লো দিতে পারেÑ এমন খবরে বৃহস্পতিবার রাতেই শ্রীকাইল ছুটে যান পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান এবং বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শুক্রবার রাতে তারা শ্রীকাইল থেকে ঢাকায় ফেরেন।
গত ২৯ জুন ৩ হাজার ২১৪ মিটার পর্যন্ত খনন শেষে এ অনুসন্ধান কূপের খনন সমাপ্ত করে বাপেক্স। এরপর দু’দিন লগিং (গ্যাসের উপস্থিতি নিশ্চিত)-এর কাজ চলে। তখনই বাপেক্স জানিয়েছিল, কুমিল্লার মুরাদনগরের শ্রীকাইলে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
বিগত জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালে পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই শ্রীকাইলে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে ঘোষণা দেয় বাপেক্স। পরে পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় শ্রীকাইল থেকে গ্যাস উত্তোলন বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে না। কিন্তু কুমিল্লর বাঙ্গুরা থেকে বহুজাতিক কোম্পানি তাল্লো গ্যাস উত্তোলন করছে। বাঙ্গুরা এবং শ্রীকাইল একই ব্লকে (ব্লক ৯)-এ অবস্থিত। সঙ্গত কারণে শ্রীকাইলেও গ্যাস রয়েছে এমন ধারণা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রবল হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা যায়, ২০০৪-এ কূপ খননের স্থান নির্ধারণ সঠিক না হওয়ায় গ্যাস পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে চালানো ১৩২ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলা হয়, শ্রীকাইল একটি মাঝারি ধরনের গ্যাসক্ষেত্র হতে পারে। এতে ২৫০ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পরবর্তী সময়ে শ্রীকাইলে আবারও গ্যাসকূপ খননের প্রস্তাব দেয় বাপেক্স। একনেক ২০০৮ সালে শ্রীকাইলে কূপ খননের জন্য ৮১ কোটি ১২ লাখ টাকার প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন করে।
এছাড়া সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার সুনেত্রতে আগামী রবিবার অনুসন্ধান কূপ খনন শুরু করতে যাচ্ছে বাপেক্স। স্ট্রাকচারটির প্রায় ৬০০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপের ফলাফল বলছে, সুনেত্রতে বিশাল গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে। সুনেত্রর প্রকল্প পরিচালক নূরুল ইসলাম শুক্রবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, ড্রিলিং শুরুর প্রস্তুতি একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি রবিবার থেকেই ড্রিলিং শুরু করা সম্ভব হবে। আগামী চার মাসের মধ্যে আরও একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পেট্রোবাংলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এখন তিনটি ক্ষেত্র থেকে গ্যাস তুলছে। এর মধ্যে ১৯৯৫ সালে ভোলার শাহবাজপুর, ১৯৯৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সালদা নদী এবং গত বছরের ২৮ আগস্টে সুন্দলপুরে তৃতীয় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাপেক্স।
দেশে বর্তমানে ৮১টি কূপ থেকে প্রতিদিন দুই হাজার ১৯৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। উৎপাদিত গ্যাসের ৪২ শতাংশ বিদ্যুত উৎপাদনে, অর্থাৎ ৯৩১ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৫৩ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। সার উৎপাদনে ৬৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, যা মোট উৎপাদনের ৩ দশমিক ৬ ভাগ। অন্যান্য গ্রাহককে এক হাজার ১৬৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, যা মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
এখন পর্যন্ত দেশে গ্যাসের মজুদ ২০ দশমিক ৬২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট নিশ্চিত হওয়া গেছে। ব্যবহারের পর গ্যাসের অবশিষ্ট রয়েছে নয় দশমিক ৮৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।

No comments

Powered by Blogger.