গন্তব্য ঢাকা-খোয়াই নদীর তীরে by শর্মিলা সিনড্রেলা

বাড়ির পাশেই খোয়াই নদী। চাইলেই যখন-তখন ঝাঁপিয়ে পড়া যায় সেখানে। বাজার থেকে কিনে মাছ খাওয়া হয় কদাচিৎ। তবে মাছ খাওয়া হয় প্রায়ই। মন চাইলে নদী থেকে মেরে মাছ খাওয়া হয় পেট পুরে। আবার নিজের যেটুকু জমি আছে তাতে চাষবাস করে বাড়ির সবাইকে নিয়ে দুধে-ভাতে বছর ঘুরে যায় অনায়াসেই।


তবু সেসব ছেড়ে পড়ে থাকা এই পরবাসে। পরবাস! নয়তো কী? যেখানে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরলে হাতপাখা নিয়ে পাশে বসার মানুষ থাকে না, যেখানে কষ্ট পেলে পাশে থাকার কেউ নেই, যেখানে আনন্দে ভাসলে ভাগ করে নেওয়ার মানুষ থাকে না—তাকে তো পরবাসই বলতে হয়। কোনো এক গ্রামে পরিবার-পরিজন ফেলে রেখে অনেকেই দিন কাটান এই ঢাকায়। কিন্তু কেন? কিসের আশায় এই জীবন? শুনি আজিজুল হকের মুখ থেকে। যিনি তাঁদেরই মতো একজন।
আজিজুল হকের বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই থানায়। সেখানেই থাকেন আজিজুল হকের প্রিয় মানুষগুলো। মা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে। তবু সব ছেড়ে তিনি ঢাকায়। কারণ, তিনি বসে থাকতে মোটেও চান না। এই কাজ করে জীবন বদলের আশায় আজ থেকে ১৫ বছর আগে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। ঢাকা শহরের তখন বিশাল নামডাক। গ্রাম থেকে অনেকেই ঢাকায় আসছেন। আর বদলে ফেলেছে নিজেদের জীবন যাপনের ধরন। আজিজুল হকও এলেন ঢাকায়। স্বপ্ন ছিল এমন কিছু একটা করবেন, যাতে পরিবারের সবার ভবিষ্যৎ জীবন অন্তত নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু কী করবেন? মাথায় ভাবনার ঘুরপাক। অবশেষে ‘মুড়ির মোয়ার ব্যবসা শুরু করলাম। না, সেইহানেও কুলাইল না। আইজ পাঁচ-ছয় বছর ধরে এই ব্যবসা।’
এখনো তাঁর ব্যবসাটা অতীব সাধারণ। মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ ভবনের সামনে ফুটপাতে বসে তিনি এখন বিক্রি করেন মোজা। শুধুই মোজা। ‘তাইতেই কত কষ্ট। রোজ যাত্রাবাড়ী থেকে এহানে আসি প্রুতিদিন সকাল আটটায়, আবার বাড়িত যাই সেই রাইত ছয়টায়।’ সেই যাত্রাবাড়ী থেকে রোজ মহাখালী এসে ব্যবসা করা!! ‘নাইলে আর কী করমু। এহানে তাও একটু ব্যবসা হয়, ওদিকে তো তাও হয় না। এই ছিজনে বেশি বিকরি (বিক্রি) হয় না। শীতের ছিজন আমার লগে ভালো। তখন বেশি বিকরি চলে।’
‘আমি যহন খুবই ছোট, তখন আবার বাবা মারা গেছে। আমি বাড়ির বড় পোলা। সংসার তাই আমার ওপরেই পড়ে। একটুও পড়াশোনা তখন করতে পারছি না। দিনে পেটের কাম করছি আর রাইতে নিজের কাম করছি। মানে দিনে মানুষের জমিতে কাম করে টাকা আনছি বাড়ির জন্যে, আর রাতে নিজেদের যতটুক জমি আছিল তাতে কাম করছি। তাই এখন চাই নিজের পোলা-মাইয়ারে পড়ামু।’ নিজে যে জিনিসটা পাননি, তা ছেলেমেয়েদের বুঝতে দিতে চান না আজিজুল হক। তাই তো গ্রামে জমি থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় কাজ করেন ‘যদি মাস শেষে দুই হাজার টাকাও আসে, তা থেকে এক হাজার ছেলের জন্যে আর এক হাজার মেয়েরে দিতে পারমু।’ বলেন আজিজুল হক।
‘গ্রামে থাকা সব সময় ভালা। এখানে কখনো ফানি থাহে না তো আবার বিদ্যুৎ থাহে না। গ্যাসেরও তো সমস্যা হয়। কোথাও যেতে চাইলে জ্যামের কারণে যাইতে পারি না। বাড়িত গেলে এই সব সমস্যা নাই। তাছাড়া বাড়ি যেতে মন চায় মায়ের জন্যে। মায় যদি একবার ডাকে তয় আর একদিনও ঢাকায় থাকি না। ছুইট্যা যাই।’ গ্রাম আর মা বুঝি একই রকম প্রিয় আজিজুল হকের কাছে।
গ্রামে গেলে একেক সময় একেক ধরনের ভালোলাগা থাকে আজিজুল হকের কাছে। এই যেমন ‘অহন তো বর্ষা। অহন সব জমি-জায়গা ডুইব্যা গেছে। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িও অহন যাওন লাগব নাও দিয়া। আমার পরিবারেরও অহন কামকাজ নাই। কেবল রান্নাবান্না আর রেস্ট করব। আবার যদি শীতের সময় বাড়ি যায়, তাহলে খেতে ফসল থাহে তহন কাম করন লাগে। গ্রীষ্মেও তো মাঠে ফসল থাহে।’
বাড়ি যাবেন কবে আবার? প্রশ্ন করতেই জবাব আসে ‘এই তো জষ্ঠি মাসে আসছি। আবার শবে বরাতের আগে যামু। বাড়ি গেলে যদি টাকার ঠেকা না থাহে, তাইলে খাওন-দাওন ভালোই হয়। আর যদি ঠেকা থাহে, তাইলে কম হয়। আমার মাইয়া পাবিয়া পড়ে ক্লাস নাইনে। আর ছেলে জাবেদ পড়ে মাদ্রাসায়। ছেলেটা মাওলানা হয়ে গেলে আর ঢাকায় থাকমু না। আর হয়তো দু-তিন বছর লাগব। বাড়িঘর চাই না। একটু জমি করতে পারলেই যথেষ্ট।’ রাস্তার পাশে কিছু মোজা নিয়ে বসে ঢাকা আর গ্রামের পার্থক্য খোঁজেন আজিজুল হকরা। আশায় থাকেন কবে সেই দিন আসবে, যখন আবার সবাইকে নিয়ে গ্রামের সেই শান্ত সুন্দর পরিবেশে নির্বিঘ্নে জীবন যাপন সম্ভব হবে।
শর্মিলা সিনড্রেলা

No comments

Powered by Blogger.