গাজীপুরে ট্রেন খাদে এক যাত্রী নিহত, অর্ধশত আহত-বিভিন্ন রুটে ৬ ঘণ্টা পর ফের চলাচল শুরু by মোস্তাফিজুর রহমান টিটু

গাজীপুর, ১৩ জুলাই ॥ গাজীপুরে শুক্রবার খুলনাগামী যাত্রীবাহী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেন রেললাইন ভেঙ্গে ইঞ্জিন ও বগি নিয়ে ছিটকে পার্শ্ববর্তী খাদে উল্টে পড়ে। এতে একজন নিহত এবং প্রায় অর্ধশত যাত্রী আহত হয়েছে। এ ঘটনায় ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল প্রায় ৬ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। নিহত রেলযাত্রীর নাম রুহুল আমিন হেলাল (২৮)।


তিনি পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া থানার চর ভাঙ্গুড়া গ্রামের আব্দুল গফুরের ছেলে। এ ঘটনায় দু’টি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে।
দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের গার্ড আলাউদ্দিনসহ কয়েক যাত্রী জানান, শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে ঢাকার কমলাপুর স্টেশন হতে যাত্রী নিয়ে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেন খুলনার উদ্দেশে যাত্রা করে। পথে টঙ্গী স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর এ ট্রেনকে সাইড দিতে গাজীপুরের ধীরাশ্রম স্টেশনের আউটার সিগনালে বঙ্গবন্ধু সেতু হতে ঢাকাগামী যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ট্রেনটি দ্রুত গতিতে ধীরাশ্রম স্টেশনের হোম সিগনাল পার হয়ে ১নং মেইন লাইন দিয়ে স্টেশনে প্রবেশের সময় হঠাৎ বিকট শব্দে ট্রেনের ইঞ্জিনটি আড়াআড়িভাবে উল্টে গিয়ে ছিটকে পার্শ্ববর্তী খাদে পড়ে যায়। এ সময় ইঞ্জিনসংলগ্ন যাত্রীবাহী একটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ইঞ্জিনের ওপর আছড়ে পড়ে এবং আরও দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ট্রেনের ‘ড’ বগির যাত্রী রুহুল আমিন হেলাল বগির নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত এবং ট্রেনের চালক নজিবুর রহমান ও সহকারী চালক ইন্দ্রজিত সরকারসহ অন্তত অর্ধশত যাত্রী আহত হয়। আহতদের মধ্যে ট্রেনের কর্মচারী মোজাম্মেল হক (৪৫) এবং যাত্রী মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের আবু সাইদের স্ত্রী নিপা বেগমকে (২৩) গাজীপুর সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এদের মধ্যে গুরুতর আহত নিপা বেগমকে পরে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সংবাদ পেয়ে গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের একটি দল, পুলিশ, র‌্যাব ও স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। দীর্ঘ চেষ্টার পর বগির নিচ থেকে নিহতের লাশ উদ্ধার করে গাজীপুর সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনাসহ সবকটি রুটের রেলযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় ইঞ্জিনসহ রেললাইন দুমড়ে মুচড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সময় ইঞ্জিনের তেলের ট্যাংক ফেটে জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ে। তবে অগ্নিকা-ের কোন ঘটনা ঘটেনি। এদিকে দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহেরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাগণ ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। উদ্ধার কাজ শেষে প্রায় ৬ ঘণ্টা পর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা থেকে নীলসাগর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন যাত্রীসহ সুন্দরবন এক্সপ্রেসের ১১টি বগি নিয়ে খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে গেলে ট্রেন চলাচল পুনরায় শুরু হয়।
রেলওয়ের ঢাকা-১ এর সহকারী প্রকৌশলী ওয়াজির আহমেদ মজুমদার জানান, দুর্ঘটনায় একটি রেল ছিটকে দূরে পড়ে এবং প্রায় তিন শ’ ফুট রেললাইন ভেঙ্গে ও দুমড়ে মুচড়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ঘটনায় ট্রেনের ইঞ্জিন এবং অপর তিনটি বগিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার আগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
জয়দেবপুর রেলজংশনের স্টেশন মাস্টার জিয়া উদ্দিন জানান, ঘটনার সময় ঢাকাগামী যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ধীরাশ্রম রেল স্টেশনের আউটার সিগনালে দাঁড় করিয়ে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্টেশনে প্রবেশের সময় ওই দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি জানান, বৃষ্টির কারণে ঘটনাস্থলের মাটি নরম হয়ে রেলের সিøপারগুলো নড়বড়ে হয়ে যায়। এতে ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
উদ্ধার কার্যক্রম ॥ বেলা ১২টার দিকে ঢাকা থেকে উদ্ধারকারীদল একটি রিলিফ ট্রেন নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনটি লাইন থেকে সরিয়ে নেয়া হলে বিকল্প পথে ট্রেনলাইন সচল হয়। এ সময় যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। তবে বিকল্প রুট ৩নং লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও ক্ষতিগ্রস্ত লাইনটির মেরামত কাজ আগামী সোমবারের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য ॥ প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় মজিবুর রহমান ও মকবুল হোসেন জানান, দ্রুতগতিসম্পন্ন ট্রেনটি ধীরাশ্রম স্টেশনে প্রবেশের সময় হঠাৎ বিকট শব্দে ইঞ্জিনটি আড়াআড়িভাবে ছিটকে পার্শ্ববর্তী একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে খাদে পড়ে যায়। এ সময় সঙ্গের বগিটি যাত্রীসহ ওই ইঞ্জিনের ওপর আছড়ে পড়ে থেমে যায়। আরও দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়। আতঙ্কিত যাত্রীরা চিৎকার শুরু করেন। অনেকে জানালা দিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে পড়েন। এতে আরও অর্ধশত যাত্রী আহত হয়। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রেরণ করে। তারা জানান, গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ইঞ্জিন আটকে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে যাত্রীরা রক্ষা পেয়েছে।
তদন্ত টিম গঠন ॥ দুর্ঘনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য দুটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ আরমান হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের ঢাকা বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ পরিবহন প্রকৌশলী সালাহ্ উদ্দিন আহমেদ, সিগনাল প্রকৌশলী মোঃ জাকারিয়া ও মেকানিক্যাল প্রকৌশলী সাদেকুর রহমান। চার দিনের মধ্যে এ কমিটিকে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়াও রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে অপর একটি চার সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির অন্যরা হলেনÑ মেকানিক্যাল প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান হায়দার, বেলাল হোসেন, পরিবহন প্রকৌশলী চন্দন কুমার দাশ। সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
দুর্ঘটনাস্থলে মন্ত্রী ॥ যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংবাদ পেয়ে বেলা ১২টার দিকে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি হতাহতসহ যাত্রীদের খোঁজখবর নেন। তিনি দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে এক লাখ টাকা অনুদান দেয়ার এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার ঘোষণা দেন। পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, অপ্রত্যাশিত এ দুর্ঘটনার জন্য আমি মর্মাহত ও দুঃখিত। তবে এর জন্য রেলের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে না। ট্রেনের ইঞ্জিন বা ট্র্র্যাকের কারণে ভবিষ্যতে এ দুর্ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে আমরা আরও যতœবান হব। তিনি আরও বলেন, রেলওয়ে বিভাগটি দীর্ঘদিনের অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার। স্বল্প ব্যয়ে নিরাপদ ভ্রমণের জন্য রেলওয়ে বিভাগ যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে না পারে সে ব্যাপারে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তবে সে ষড়যন্ত্রকে কাটিয়ে আমরা একটি অবস্থানে আসতে পেরেছি। ৯টার ট্রেন এখন ৯টায়ই ছাড়ে। রেল স্টেশনগুলোও এখন আগের থেকে অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তিনি দুর্ভোগের শিকার যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিহতের লাশ গ্রামের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য রেল কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এ সময় রেলওয়ের মহাপরিচালক আবুতাহের, গাজীপুরের এডিসি জেনারেল দেওয়ান হুমায়ুন কবিরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। উদ্ধার কাজ তদারকির জন্য মন্ত্রী দ্বিতীয় দফায় বিকেল ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে যান।
যাত্রী দুর্ভোগ ॥ ধীরাশ্রমে ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের সবকটি রুটে প্রায় ৬ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় ঢাকাগামী যমুনা ও একতা এক্সপ্রেস ট্রেন জয়দেবপুর জংশনে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ মেইল মির্জাপুর স্টেশনে, সিল্কসিটি ট্রেন মৌচাক স্টেশনে, জামালপুর কমিউটার ট্রেন রাজেন্দ্রপুর স্টেশনে, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেন কাওরাইদ স্টেশনে এবং নীলফামারীগামী নীলসাগর ট্রেনটি টঙ্গী স্টেশনে আটকা পড়ে। প্রায় ৬ ঘণ্টা এসব ট্রেন আটকা পড়ায় যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ সময় অনেকে বিকল্প ব্যবস্থায় গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হন। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ট্রেন চলাচল শুরু হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

No comments

Powered by Blogger.