শুধু চাল খাওয়ানো নয়, উন্নয়ন পরিকল্পনাও জরুরি by মহসীন হাবিব

দশ মণ ওজনের একটি সিন্দুক টেনে সরানো কি একজন বা দুজন মানুষের কম্ম? যত কায়িক শক্তিই থাকুক, তা সম্ভব নয়। কিন্তু সিন্দুকটির নিচে চারটি চাকা থাকলে তা অবলীলায়, সামান্য ধাক্কা দিলেই গড়িয়ে চলতে শুরু করে। ওই চাকা হলো কৌশল বা টেকনিক। আর এ কৌশল অবলম্বন করতে মানুষ প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।


প্রয়োজনের তাগিদে কৃষিকাজ থেকে শুরু করে পাহাড় কেটে সমান করতে, মায় বুর্জ খলিফা তৈরি করতে কৌশলকে এত প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে যে এখন কায়িক পরিশ্রম প্রায় উঠে যাচ্ছে। সব কিছু চলে সুইচ বা বোতাম টিপলে। চুইংগাম চিবাতে চিবাতে চেয়ারে বসে ছোট্ট একটি বোতামে চাপ দিলে দেখা যায় দানবদর্শন ক্রেন বিশাল আয়তনের রেলওয়ে কোচ নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সাজিয়ে রাখছে। ছোট্ট একটি বোতামে চাপ দিয়ে মানুষ, এমনকি প্রাইমারি স্কুলঘরের মতো লম্বা ক্ষেপণাস্ত্র এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিক্ষেপের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিচ্ছে গোটা জনপদ। এসব সুবিধাভোগের কারণে পৃথিবী এত বেশি কৌশল বা টেকনিক-নির্ভর হয়ে গেছে যে অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, প্রশাসন পরিচালনা_কোনো কিছুই এখন আর কৌশলের বাইরে নয়। শুধু বাংলাদেশকে মাঝেমধ্যে কৌশলবিহীন লোহার সিন্দুক গায়ে ঠেলতে দেখা যায়। তারই একটি হলো সরকারের বর্তমান খোলাবাজারে চাল বিক্রি বা ওএমএস চাল কার্যক্রম।
সরকারের ওএমএস কার্যক্রম ও খাদ্যনিরাপত্তা প্রচেষ্টা দেখে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী ভাঙন রোধ প্রকল্পের কথা মনে পড়ছে। হাস্যকরই বটে। নদী ভাঙন রোধে ব্লক তৈরির নামে বাংলাদেশ সরকারের মূল্যবান অর্থ, তাও আবার দুই-চার হাজার নয়, কোটি কোটি টাকা কিভাবে পানিতে যাচ্ছে এবং মাস্তান ধরনের ঠিকাদাররা পকেটে পুরছে সে কাহিনী আরেক দিনের জন্য তোলা থাক। আপাতত অতি প্রয়োজনীয় ওএমএসের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকুক। মাত্র কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বাহবা পাওয়ার মতো দারুণ এক উক্তি করেছেন। বলেছেন, 'প্রয়োজনে সকল উন্নয়নকাজ বন্ধ করে দিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। দেশে একজন মানুষকেও না খেয়ে মরতে দেব না।' প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ফুটে উঠেছে। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ তাগিদ ফুটে উঠেছে। তবে তিনি যদি এটি কথার কথা বলে থাকেন বা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন খাদ্যনিরাপত্তার ব্যাপারে তা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে কোনো কথা নেই। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে যদি তিনি উন্নয়ন বন্ধ রেখে শুধু চাল খাওয়ানোর চিন্তা করে থাকেন, তাহলে সেটা আরো বড় বিপদের ইঙ্গিত বলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যদি সব উন্নয়নকাজ বন্ধ রেখে মানুষকে খাওয়াতে থাকেন, তাহলে অতিসত্বর খাওয়ানোর সামর্থ্যও ফুরিয়ে যাবে। তখন না থাকবে উন্নয়ন, না থাকবে খাদ্য। একূল-ওকূল দুকূলই যাবে।
সরকারের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে দেশকে খাদ্যনিরাপদ করতে এবং চালের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। এটা তো খুবই ভালো কথা। নিঃসন্দেহে উদ্যোগগুলো জনমানুষকে নিয়ে সরকারের উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু কৌশলের অভাবে সব কিছু যেন বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোতে রূপ নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সরকারের এখন জাহাজে ভাসমান চালসহ মোট ১১ লাখ টন চাল হাতে রয়েছে। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং ভারত থেকে শিগগিরই আসছে প্রায় সাত-আট লাখ টন চাল। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে সাড়ে চার লাখ টন চাল এবং চার লাখ ৩৫ হাজার টন গম ক্রয়ের প্রক্রিয়া চলছে। এটাও ইতিবাচক সংবাদ। কিন্তু অতি স্থূল শোনা গেলেও একটি মৌলিক প্রশ্ন সরকারকে করা যেতে পারে। হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী সরকারের হিসাবে চার কোটি। প্রতি পরিবারে পাঁচজন করে ধরা হলে (তাই বলা হয়) ৮০ লাখ পরিবার। এর সঙ্গে এখন নিম্নবিত্তদের সঙ্গে নিম্ন-মধ্যবিত্তরাও ওএমএসের চালের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। সরকার কত দিন এভাবে খোলাবাজারে বিশাল ভর্তুকি দিয়ে চাল খাওয়াবে? এরপর খাওয়াতে না পারলে রাজনৈতিক ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এর পরও জানা গেছে, সরকার আট টাকা কেজি চাল আর ছয় টাকা কেজি আটা খাওয়ানোর পরিকল্পনা করেছে। আড়াই কোটি লোককে এ মূল্যে চাল ও গম দেওয়া হবে। এ বিশাল ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারের সত্যিই উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হচ্ছে না তো? শুধু চাল খাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী! আবারও বলছি, মানুষকে ন্যায্যমূল্যে চাল খাওয়াতে হবে। কিন্তু সেদিকে লক্ষ রাখতে গিয়ে অন্য সব পরিকল্পনা যেন ভেস্তে না যায়। অধিকন্তু সরকারের এসব পরিকল্পনার মধ্যে অপরিকল্পনা ও অসংগতির ছাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারকে পুরোপুরি কৌশলবিহীন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশব্যাপী সরকারের যে ওএমএস কার্যক্রম চলছে সেখানে পর্যাপ্ত ডিলার নিয়োগ করা হয়েছে, চাল সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। অথচ অসংখ্য মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে চাল না পেয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছে।
ন্যায্যমূল্যে চাল সরবরাহ করে সাধারণ দরিদ্র মানুষকে ক্ষুধার হাত থেকে রক্ষা করা সরকারের একটি অন্যতম প্রধান দায়িত্ব, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর পাশাপাশি সরকারকে লক্ষ রাখতে হবে মানুষের মধ্যে ওএমএসের চাল বছর ধরে খাওয়ার প্রবণতা যেন তৈরি না হয়। এসব কার্যক্রম চলতে পারে বিশেষ বিশেষ সময়ে। শুনতে খারাপ শোনা যেতে পারে, কিন্তু সারা বছর এভাবে চাল খাওয়াতে গেলে একদিকে যেমন সরকারকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হবে, উন্নয়নকাজ ব্যাহত হবে; অন্যদিকে বাজারের চেয়ে যথেষ্ট কম মূল্যে চাল পাওয়ার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে অলসতা ভর করতে পারে। ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং বা ভিজিএফ কার্যক্রম চলতে পারে সীমিত আকারে। কিন্তু এভাবে ব্যাপকহারে চালাতে গেলে রাজার ভাণ্ডার ফুরাতে সময় লাগবে না। তখন সরকার কী করবে? তাই প্রয়োজন এ চাল খাওয়ানোর পাশাপাশি এমন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া, যাতে মানুষ আয় করে কিনে খেতে পারে। যাতে কৃষকের ঘরে চালের অভাব না হয়। আর সে জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনায় হাত দেওয়া।
যেমন এই ওএমএস দিনের পর দিন চালানোর বদলে সরকারের উচিত বাজারের দিকে নজর দেওয়া। বাজারে দ্রব্যমূল্য কেন অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটা তদারকি করার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া। বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা আংশিক সত্য। কিন্তু সরকার একটু খতিয়ে দেখছে কি, আন্তর্জাতিক বাজারে কতটুকু মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে আর দেশে কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে? যতটুকু জানি, আন্তর্জাতিক বাজারে এযাবৎকালে সবচেয়ে বড় খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তার পরও সেটা ৩৩ শতাংশ নয়, যা দুই বছরে বাংলাদেশে হয়েছে। সরকার চোখ বুজে থেকে শুধু দরিদ্র মানুষকে খাওয়াতে চাইলে কি চলবে? কেন আজ অবধি বাজার মনিটরিং শক্তিশালী হলো না?
ওএমএস চাল কালোবাজারে চলে যাওয়ার সমূহ ঝুঁকি রয়েছে। কিছু কিছু অভিযোগও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এটা সরকার কিভাবে রোধ করবে, সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি? সরকার মজুদ ঠেকাতে পারবে তো? মনে পড়ে ৯০-পরবর্তী সরকারের খোলাবাজারে চাল বিক্রির হাজার হাজার টন খাদ্যশস্য চলে গিয়েছিল কালোবাজারে। তখন কালোবাজারিরা জেলায় জেলায় প্রকাশ্যে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী নানা বাহিনীকে বস্তাপ্রতি ৫০ পয়সা রেট করে ঘুষ দিয়ে ওপেন মার্কেটেই কারসাজি করেছিল। ১৯৫৪ সাল থেকে প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খয়রাতি সাহায্য হিসেবে পিএল ৪৮০ গম সরবরাহ করত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সে সাহায্য প্রদানের প্রয়োজনীয়তা যুক্তরাষ্ট্রের ফুরিয়ে যায়। এখন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো খয়রাতি সাহায্য নেই। যা ব্যবস্থা করার তা সরকারকেই প্রধানত করতে হচ্ছে। কিন্তু সরকার যদি কৌশল অবলম্বন না করে, পরিকল্পনা তৈরি না করে, তাহলে ওএমএসের চাল প্রদান এক ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দেখা দেবে আগামী দিনগুলোতে।
সরকার হতদরিদ্রদের যে আট টাকায় চাল এবং ছয় টাকায় গম খাওয়ানোর পরিকল্পনা করেছে, সেখানে প্রতি কেজি চালে ভর্তুকি দিতে হবে ১৯ টাকা ৯৩ পয়সা। যে দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষকে সরকার টার্গেট করেছে, তাদের খাওয়াতে ছয় মাসে চাল লাগবে ৯ লাখ ৬০ হাজার টন। ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। আপাতত দরিদ্র মানুষকে বাঁচানোর এসব পরিকল্পনা প্রশংসনীয়। কিন্তু একটি দেশ এভাবে চলতে পারে না। ভবিষ্যতে যেন এমন করে খাওয়াতে না হয় সে ব্যবস্থার দিকে সরকারকে এগোতে হবে। আবারও বলছি, তা করতে হলে যেসব পরিকল্পনা দরকার তা কিন্তু চোখে পড়ছে না। যেমন_সরকার কৃষি ভর্তুকির একটি বড় অংশ ক্ষুদ্র কৃষিঋণের মাধ্যমে দিচ্ছে। এটাও সরকারের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কৃষিমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দুজনই দেশে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁদের সততা ও সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই_এ কথা বুকে হাত রেখে বলা যায়। কিন্তু সঠিক পথে সব কিছু এগোচ্ছে সে কথা বুকে হাত রেখে বলা যায় না। দেশে প্রয়োজন কৃষি অবকাঠামো শক্তিশালী করা। কৃষকের উৎপন্ন শস্য পরিবহনের পথ থাকতে হবে মসৃণ। কৃষককে যে করেই হোক আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম পেঁৗছে দিতে হবে। কৃষকের শস্য মজুদের আধুনিক ব্যবস্থা থাকতে হবে ইউনিয়ন পর্যায়ে। যে কৃষক কলসি ভরে পানি নিয়ে ক্ষেতে দিয়ে ফসল ফলায়, তাকে পাঁচ হাজার টাকা কৃষিঋণ দিয়ে বরং দেনার বোঝাই বাড়ানো হবে, কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। আলুর মূল্য কমে পাঁচ টাকা কেজি হয়েছে। অথচ আলুচাষিকে এক কেজি চাল কিনতে হয় আট কেজি আলুর সমান মূল্যে। আলু সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন কোল্ডস্টোরেজের ব্যবস্থা করা। তাহলেই চাল এবং আলুর মূল্যে ভারসাম্য আসত। অথচ কয়টি কোল্ডস্টোরের ব্যবস্থা সরকার এযাবৎ করেছে? তাই সরকারকে পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোনোর পরামর্শ দেওয়া জরুরি। বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব সরকারের নীতিনির্ধারকদের হাতে কার্যকরী পরিকল্পনা পেঁৗছে দেওয়া।

লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.