খুলনায় রাস্তার যা-তা অবস্থা-কাজে দুর্নীতি দেখতে পায় এক কমিটি ধামাচাপার চেষ্টা আরেক কমিটির by পার্থ সারথি দাস

খুলনা-পাইকগাছা সড়কের আঠারোমাইল থেকে তালা বাজার অংশে যত দূর চোখ যায়, শুধুই এবড়োখেবড়ো আর খানাখন্দ। পিচ নেই অধিকাংশ স্থানে। যান চলাচল টিকিয়ে রাখতে গত বছর সড়কটিতে যে ইট ফেলা হয়েছিল, সেগুলোই বিধ্বস্ত হয়ে এমন দশা। এ অবস্থায় সড়কটি দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে খুবই সাবধানে কচ্ছপ গতিতে।


এর পরও কোনো কোনো গাড়ি আটকে পড়ছে গর্তে। কয়েক দিন আগে মোটরসাইকেলে খুলনার আঠারোমাইল থেকে সাতক্ষীরার তালা বাজার পর্যন্ত যেতে যেতে মনে হয়েছে, এ যেন অনন্ত দুর্ভোগের পথ। জেঠুয়া গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বললেন, 'রাস্তা আর ভালো হইব না।'
ভালো যে হবে না তা বোঝা গেল আরো কিছু তথ্য জানার পর। জানা গেল, গত বছর জলাবদ্ধতার পর খুলনার আঠারোমাইল থেকে পাইকগাছা পর্যন্ত সড়কটি সংস্কার করা হয়নি। বর্ষা আসায় এখন তোড়জোড় চলছে এ সড়ক সংস্কারের। সড়কের বিভিন্ন অংশ সংস্কারের জন্য একাধিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে একাধিক প্রকল্প। কিন্তু জলাবদ্ধতা রোধে সড়কের একটি অংশ মাটি ভরাট করে তিন ফুট উঁচু করতে হবে। সেই কাজই করা হয়নি। এ কারণে সংস্কার করেও কোনো ফল হবে না। এ অবস্থায় চলতি বর্ষায় আবারও সড়কডুবির শঙ্কা রয়েছে।
খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার এই সড়ক শুধু নয়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক সড়কই এখন চলাচলের অনুপযোগী। এ অঞ্চলে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নিয়ে চলছে ব্যাপক দুর্নীতি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের খুলনা জোনের ছয় জেলায় ৪০টি সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অর্থে অকারণে প্রশস্ত করা হয়েছে সড়ক। তৈরি করা হয়েছে সড়কদ্বীপও। এ ছাড়া কাজ না করে ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। কাজ না করে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তখনকার যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব)। পরে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে এম বদরুল মজিদ সওজের স্থানীয় প্রকৌশলীদের নিয়ে তদন্ত করে ক্রয়নীতি লঙ্ঘন হয়েছে বলে দেখতে পান। সরকারি অর্থ অপচয়ের বিষয়টিও ধরা পড়ে তাঁদের কাছে। কিন্তু অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি বেমালুম চেপে যান তাঁরা প্রতিবেদনে। এরপর এ কে এম বদরুল মজিদকে প্রধান করেই আবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু দুই মাস হতে চললেও ওই কমিটি মাঠে গিয়ে আর তদন্ত করেনি। জানা গেছে, দ্বিতীয় বার মাঠপর্যায়ে পাঠানো কর্মকর্তার তদন্তের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখাই নথিপত্রে প্রশ্ন তুলেছে দুই দিনে ৪০ সড়ক কিভাবে সরেজমিনে পরিদর্শন সম্ভব হলো তা নিয়ে।
জানতে চাইলে এ কে এম বদরুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তদন্তাধীন বিষয়ে আমি কথা বলব না।' তবে আবার তদন্তে যেতে বলা হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
বদরুল মজিদের নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, যশোর সড়ক সার্কেলের আওতাধীন সাতটি জেলার মধ্যে ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরা জেলায় মেরামত খাত থেকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যার অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়ভাবে সড়ক প্রশস্ত করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বা হচ্ছে। অন্যদিকে যশোর, কুষ্টিয়া ও নড়াইল জেলার মেরামত খাতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল এবং অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় মেরামত না হওয়ায় ওই সব জেলার অধিকাংশ সড়ক ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৪ ও ২৫ নভেম্বর ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী সওজের স্থানীয় প্রকৌশলীদের নিয়ে 'ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর জরুরি পুনর্বাসন প্রকল্প এবং মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ' কাজ পরিদর্শন করেন। এরপর মন্ত্রণালয়ে তিনি প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদনের এক জায়গায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ের বিষয়টিকে অস্পষ্ট ও তদন্তযোগ্য বলে মন্তব্য করা হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, খুলনা জোন ও যশোর সার্কেলের আওতায় রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কাজ না করে বিল পরিশোধের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা সমন্বয়ে অতি জরুরি তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে কমিটি গঠনপূর্বক দায়িত্ব প্রদান করা যায়।
এরপর গত ২৮ ডিসেম্বর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কাজ না করেও বিল পরিশোধের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনাটি তদন্ত করতে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) এ কে এম বদরুল মজিদকে। সদস্য করা হয় সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী (সেতু ডিজাইন বিভাগ-১ ঢাকা) মো. রেজাউল করিমকে। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিলেও এই সময়ের মধ্যে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
গত ২ ও ৩ মার্চ দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি সড়কের ঝিনাইদহসহ পাঁচ জেলায় তত্ত্বাবধায়ক, নির্বাহী ও উপবিভাগীয় প্রকৌশলীদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে। তদন্ত কমিটি প্রকৌশলীদের নিয়ে দুই দিনে ৪০টি সড়ক পরিদর্শন করে। ৪০টি সড়কের কাজেই এক খাতের অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করে ক্রয়নীতি লঙ্ঘনের এবং অর্থ অপচয়ের অভিযোগ করে কমিটি। সেই সঙ্গে দোষী প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। কিন্তু আগের কমিটির প্রতিবেদনে উল্লিখিত অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি। এ কমিটি বলছে, আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক নয়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ৬৩টি সড়ক ও মহাসড়কের ৫৭৪ কিলোমিটারই ভাঙাচোরা। এর মধ্যে জরুরি পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় ২৩টি সড়ক ও মহাসড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে গত মে মাস থেকে তা বন্ধ রয়েছে। ১৫৪ কোটি টাকার মধ্যে গত মে মাস পর্যন্ত তিন কিস্তিতে মাত্র ১৬ কোটি ১২ লাখ টাকা ছাড় হয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থের ছাড় না দেওয়ায় ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
সওজ খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, বেতগ্রাম-তালা-পাইকগাছা-কয়রা সড়কটি ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে আঠারোমাইলে ৮০ মিটার অংশ বাজার এলাকা থেকে নিচু। প্রথম ১০ কিলোমিটার অংশ মেরামতের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে গত মাসের শেষ সপ্তাহে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ লাখ টাকা। ১১ থেকে ২০ কিলোমিটার অংশ মেরামতের জন্য ১৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই অংশ মাটি ভরাট করে তিন ফুট উঁচু করতে হবে। এ কারণে অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন। ২১ থেকে ৫২ কিলোমিটার অংশ মেরামতের কাজ শুরু হলেও শেষ হয়নি। ৫২ থেকে ৬৫ কিলোমিটার অংশের মেরামতকাজ গত ১২ জুন শুরু হয়েছে। এ অংশে ব্যয় হবে এক কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

No comments

Powered by Blogger.