রক্তঝরা অমর একুশে

আজ সেই রক্তঝরা অমর একুশে_মহান শহীদ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার দিন। আমাদের গর্ব এবং আনন্দও আছে শত বেদনাস্মৃতির মধ্যেও। এ কারণে কালের পরিক্রমায় এই দিনটি আজ গোটা বিশ্ববাসীর জন্যই মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর উপলক্ষ।


১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সড়ক ধরেই আমরা ১৯৭১ সালে পেয়েছি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বাধীনতা, পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র_আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ।
একুশের মহান চেতনা_'একুশ মানে মাথা নত না করা'_এটিই স্লোগান হয়েও উঠেছিল। এসব কারণে দিনটির তাৎপর্য অনেক বেশি। একটি আত্মমর্যাদাশীল কল্যাণকামী অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ একুশের চেতনাকে ধারণ করেই এগিয়েছে। একুশের শহীদদের আত্মদানের মূল্যায়নও আমরা করছি এর মধ্য দিয়েই। আমাদের জাতীয় বিকাশ ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে একুশের শাণিত চেতনা বড় শক্তিও বটে। একুশের আত্মদান শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; ক্রমেই একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন ও অঙ্গীকারের বীজও রোপিত হয়েছিল এর মধ্য দিয়ে। বলা আবশ্যক, আমাদের ভূখণ্ডে বাংলা ছাড়াও ছোট অনেক জনগোষ্ঠীর অনেক আদিবাসীর নিজস্ব মাতৃভাষা রয়েছে। বাংলার পাশাপাশি সেসব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের পথও প্রশস্ত করতে হবে। সব মানুষের জন্যও চালু করা যায়নি। নিরক্ষর রয়ে গেছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। যে জন্য আমাদের ভাষাসৈনিকরা আত্মদান করেছেন, সেই প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলা আজও সর্বস্তরে চালু হয়নি। কাগজ-কলমে বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা বটে; কিন্তু সরকারি দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের চেয়ে ইংরেজির প্রাধান্য এখনো অনেক বেশি। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালুর উদ্যোগও রয়েছে। উচ্চ আদালতেও বাংলা এখন পর্যন্ত চালু হয়নি। উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের সিংহভাগ তরুণ-তরুণীর লেখাপড়ার মাধ্যমও এখন পর্যন্ত প্রধানত ইংরেজি। মাতৃভাষা চর্চাও শিক্ষার ব্যাপার। আমাদের পরভাষা শিখতেই হবে, তবে সে ভাষা আমরা শিখব মাতৃভাষায় সমভিব্যাহারে। মাতৃভাষার ভিত্তি পাকাপোক্ত করে তার ওপরই পরভাষার কাঠামো স্থাপন করা উচিত।
মনে রাখা উচিত, আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সবকিছুর মর্যাদা বৃদ্ধি করা যায় না। আমরা মনে করি, সর্বস্তরে বাংলা চালুর মধ্য দিয়েই তা করা সম্ভব। এসব বিষয়ে এ যাবৎ কথা হয়েছে বিস্তর, কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে আর উদাসীনতা কিংবা কালক্ষেপণ উচিত নয়। এ ব্যাপারে একটি জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এর বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ২০০০ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দান করে ইউনেসকো এ জাতির ভাষাকে যে স্বীকৃতি দিয়েছে, তা আমাদের জন্য আনন্দ ও গর্বের। কিন্তু আমরা বাংলার জন্য কী করছি সেটা এখন গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। গভীর শ্রদ্ধায় একুশের শহীদদের স্মরণ করার পাশাপাশি আমাদের দাবি, একুশের চেতনার প্রতি যেন আর কোনো অবমাননা না হয়_তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এমনটি যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল। সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর মূলোৎপাটনেও এর বড় প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.