বিলম্বের কারণে অনেক গ্যাস বেহাত হয়েছে-শ্রীকাইলে নতুন গ্যাসক্ষেত্র by অরুণ কর্মকার

রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার শ্রীকাইলে গতকাল শুক্রবার দেশের ২৫তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। গ্যাসের জন্য নিশ্চিত সম্ভাবনাময় হিসেবে শ্রীকাইলকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। তার প্রায় পাঁচ বছর পর ক্ষেত্রটিতে অনুসন্ধান কূপ করে গ্যাসের সন্ধান পেল বাপেক্স।


বাপেক্সের অনুসন্ধানে ক্ষেত্রটির দুটি স্তরে ৩১৮ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস মজুদের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুদ হবে ২০০ বিসিএফের মতো। সে হিসাবে এটি বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র নয়। তবে পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ-কর্মকর্তা বলেছেন, ইতিমধ্যে শ্রীকাইল ক্ষেত্রের অনেক গ্যাস বেহাত হয়ে গেছে। তাঁরা বলেন, শ্রীকাইল ও এর সংলগ্ন বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ভূগর্ভে অসংখ্য চ্যানেল রয়েছে। নাইকো-টাল্লো বাঙ্গুরা থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করার পর থেকে ওইসব চ্যানেল দিয়ে শ্রীকাইলের অনেক গ্যাস বাঙ্গুরায় চলে যাচ্ছে।
শ্রীকাইল ক্ষেত্রটি উন্নয়নে বিলম্ব করায় গ্যাস চলে যাওয়ার পরিমাণ আরও বেড়েছে। অনেকের ধারণা, উচ্চপর্যায়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কেউ কেউ জেনেশুনেই বিদেশি কোম্পানিকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার জন্য শ্রীকাইল ক্ষেত্রে বাপেক্সের অনুসন্ধান পিছিয়ে দিয়েছেন।
দেশের স্থলভাগের ৯ নম্বর ব্লকের অধীন বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্রের পরিচালক হিসেবে কানাডীয় কোম্পানি নাইকো ৬০ শতাংশের মালিক, আইরিশ কোম্পানি টাল্লো ৩০ এবং বাপেক্স (নন-অপারেটিং) ১০ শতাংশের মালিক।
শ্রীকাইল-বাঙ্গুরার এ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামালউদ্দিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শ্রীকাইলে গ্যাসের মজুদ আরও চার বছর আগে আবিষ্কৃত হতে পারত। ২০০৭ সালে সেখানে বাপেক্স দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালিয়ে গ্যাসের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তিনি ওই ক্ষেত্রটি উন্নয়নের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি রহস্যজনক কারণে ফেলে রাখা হয়।
জামালউদ্দিন বলেন, এ কথা সংশ্লিষ্ট সবারই জানা যে শ্রীকাইল ও বাঙ্গুরা ক্ষেত্রে গ্যাসের স্ট্রাকচার অভিন্ন। দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে অসংখ্য চ্যানেল রয়েছে। এ অবস্থায় যে ক্ষেত্রটিতে আগে উত্তোলন শুরু করা হবে, সেটিতে চলে আসবে অন্য ক্ষেত্রের গ্যাস। বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত একাধিক উন্নয়ন কূপ করে শ্রীকাইল থেকে গ্যাস উত্তোলন করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
পেট্রোবাংলা-বাপেক্সের সূত্রগুলো জানায়, গতকাল ক্ষেত্রটির যে স্তরে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে (ডি-স্যান্ড), বাঙ্গুরায়ও সেই একই স্তর থেকে গ্যাস তোলা হচ্ছে। বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্রে মোট পাঁচটি কূপ রয়েছে। এর মধ্যে চারটি থেকে প্রতিদিন ১০ কোটি (১০০ মিলিয়ন) ঘনফুটের বেশি গ্যাস তোলা হচ্ছে। অবশ্য এর মধ্যে এক কোটি ঘনফুটের মতো তোলা হচ্ছে আরও নিচের একটি স্তর (ই-স্যান্ড) থেকে।
বাপেক্স শ্রীকাইলে প্রথম অনুসন্ধান কূপ করে ২০০৪ সালে। কিন্তু ওই কূপটি খননের ভুল জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পেট্রোবাংলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, জায়গাটি ছিল একটি চ্যানেল। ফলে গ্যাসের চেয়ে পানি উঠেছিল বেশি। এ জন্য কয়েক দিনের মধ্যে কূপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। তখন এমন একটি পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়, যেন শ্রীকাইলে বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস নেই। কিন্তু কূপটিতে প্রথমে কিছু গ্যাস ওঠার পরেই গ্যাস আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। রীতি অনুযায়ী নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য বাপেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বোনাস দেওয়া হয়। পরে আবার তা প্রত্যাহারও করা হয়। এরপর শ্রীকাইলে অনুসন্ধানের বিষয়টি প্রায় অনালোচিতই রাখা হয়।
এরপর ২০০৭ সালে বাপেক্স সেখানে ১৩২ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করে। তার ভিত্তিতে শ্রীকাইলে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়। নতুন করে প্রকল্প তৈরিসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া শুরু করে বাপেক্স। কিন্তু ইতিমধ্যে আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের বিষয় অগ্রাধিকারে চলে আসায় শ্রীকাইলে কূপ খনন পিছিয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত বর্তমান কূপটি খননের সিদ্ধান্ত নিতেও পেট্রোবাংলা-বাপেক্স অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছে বলে সূত্রগুলো জানায়।
এখন দ্রুত শ্রীকাইল ক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবও বাপেক্সের পরিচালনা বোর্ড অনুমোদন করেছে।
গতকাল কূপটির তিন হাজার ২০ থেকে তিন হাজার ৪০ মিটারের মধ্যে মোট ১৫ মিটার পুরু গ্যাস স্তর থেকে এক হাজার ৭০০ পিএসআই চাপে গ্যাস উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের হিসাবে ওই স্তর থেকে দৈনিক অন্তত দেড় কোটি (১৫ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস তোলা যাবে। দ্বিতীয় গ্যাস স্তরটি এর ওপরে। দুই হাজার ৭০ মিটার থেকে শুরু হওয়া ওই স্তরটি প্রায় ২৫ মিটার পুরু। সেখান থেকে দৈনিক অন্তত দুই কোটি (২০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস তোলা সম্ভব হবে। দ্বিতীয় স্তরটিতে সব পরীক্ষা সম্পন্ন করে গ্যাসের প্রবাহ ঘটাতে চার-পাঁচ দিন সময় লাগতে পারে বলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমেদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন। তিনি বলেন, এই কূপটি খননে বাপেক্সের কর্তকর্তা-কর্মচারীরা সময় নিয়েছেন মাত্র ৫৫ দিন (৫ মে থেকে ৩০ জুন)। এত কম সময়ে এর আগে দেশে আর কোনো অনুসন্ধান কূপ খননের নজির নেই। এটি নিয়ে বর্তমানে বাপেক্সের আবিষ্কৃত ও উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্র চারটি। অন্য তিনটি হচ্ছে—ভোলার শাহবাজপুর, ব্রহ্মণবাড়িয়ার সালদানদী, নোয়াখালীর শাহজাদপুর-সুন্দলপুর। এই তিনটি থেকে এখন দৈনিক গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে সাড়ে আট কোটি (৮৫ মিলিয়ন) ঘনফুটের মতো। শ্রীকাইলে উৎপাদন শুরু হলে তা প্রায় ১২ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, আগামী অক্টোবর-নভেম্বর নাগাদ শ্রীকাইলের গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দেওয়া সম্ভব হবে।
দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ২৮০ কোটি ঘনফুট। উৎপাদন ২২০ কোটি ঘনফুট। দেশে মোট আবিষ্কৃত মজুদ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) ২০ দশমিক ৬২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এখন পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ১০ দশমিক ৮০ টিসিএফ।

No comments

Powered by Blogger.