একই বৃত্তে ঘুরছে রাজনীতি by এম আবদুল হাফিজ

অন্তত প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে নেই কোনো অভিনবত্ব বা বৃত্তবন্দি রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার সাহসী উদ্যোগ। শীর্ষ নেতৃত্ব ভুগছে প্রতিহিংসার এক প্রকার দুরারোগ্য বিকারে। সম্প্রতি ১৮ দলীয় জোটের গণসমাবেশ এবং তা ভণ্ডুল করতে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগের প্রাণান্তকর চেষ্টা সেটাই প্রমাণ করল।


ফরাসি অভিব্যক্তি 'ডেজা ভ্যু', যা বহুল পরিচিত কোনো কিছুর পুনঃদর্শন বোঝায়। সেই অনুভূতি নিয়েই দেখলাম ১১ জুনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অঘোষিত হরতাল ও সমাবেশে বিএনপির অক্ষম আস্ফালন। দেখলাম সেই বহুল পরিচিত রাজনৈতিক দৃশ্যপট, যা আমরা গত দু'দশকের 'গণতান্ত্রিক' বাংলাদেশে দেখে আসছি। অবশ্য বিএনপির মেয়াদেও এসব ছিল। তবে এখনকার দুর্বল এ সংগঠনটিকে আরও দুর্বল করতে এবং বেকায়দায় ফেলতে আওয়ামী লীগ যেসব হয়রানিমূলক পদক্ষেপ বেছে নিয়েছে তা জিঘাংসারই বহিঃপ্রকাশ। স্পষ্টতই বিএনপিকে অনিশ্চয়তায় ভোগাতে বা শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে দলটিকে বেকায়দায় রাখতে কর্তৃপক্ষ শেষ দিনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছে বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি না দিয়ে। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে মামলায় জড়িয়ে আন্দোলনের গতি ও গতিবেগ স্তিমিত করার অপচেষ্টার কথা বাদই দিলাম। যতক্ষণ আওয়ামী লীগের হাতে সেসব করার ক্ষমতা আছে, তারা তা করবেই। বিশেষ করে যখন বিএনপিও ক্ষমতায় থাকতে সেসব করেছে। শুরুতেই বলেছি, সেই একই প্রতিহিংসার রাজনীতির বৃত্তে এ দেশ ঘুরছে, যা প্রশমিত হওয়ার পরিবর্তে মাঝে মধ্যেই জিঘাংসার পর্যায়ে পেঁৗছে যায়।
গণসমাবেশ নিয়ে শুরু করেছিলাম। যদি ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি বিবেচনায় আনা যায়, তাহলে এ সমাবেশে বিএনপির সাফল্য শতকরা ১০০ ভাগ। যদিও নিন্দুকরা সুচের পেছনে ছেদা আবিষ্কারেও ব্রতী হয়েছে। বিএনপির একটি 'ক্যালিব্রেটেড মডারেশন'কে তাদের কাছে অক্ষম আস্ফালন মনে হয়েছে। তবে বিজ্ঞজনদের মতে, বিএনপির মডারেশন সময়োচিত হয়েছে।
একটি চলমান আন্দোলনের গতি, প্রকৃতি এবং কৌশল রাজনীতির অনেক উপাদানই নির্ণয় করে থাকে। রমজান মাসের প্রাক্কালে এবং গ্রীষ্মের এই তাবদাহে আন্দোলনের কোনো কঠোর পদক্ষেপ বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল জনগোষ্ঠীর কাছেও বিরক্তিকর হতো। তাছাড়া আন্দোলনের মেজাজকে ধরে রাখতে নেতৃত্বকে অনেক কথা বলতে হয়, যা অনেক সময় বাস্তবায়নের ঊধর্ে্ব। আওয়ামীরা এত সত্বর তাদের হাস্যকর ট্রাম্পকার্ড রাজনীতির কথা ভুলে গেল?
আমার কাছে হাস্যকর লাগে, যখন বাঘা বাঘা আওয়ামীকে বলতে শুনি, আসলে বিএনপির আন্দোলনের কোনো ইস্যু নেই। প্রকৃতপক্ষে ইস্যুর আধিক্যে বিএনপির জন্য সবচেয়ে মারাত্মক ইস্যু বাছাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। শুধু দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা ও অবক্ষয়ের বিষয়টিই যদি ধরা যায় এর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে বছরের পর বছর আন্দোলন চলতে পারে। যুগ যুগ ধরে যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এসব নিয়ে আন্দোলন দেশবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকার। ক্ষমতাসীনরা দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার ভেতর দিয়ে সমস্যাগুলোকে এতটাই লেজেগোবরে করে ফেলেছে, সেগুলোকে সুবিন্যস্ত করে একটি শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে অফফৎবংং করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমরা উৎসুক এমন পরিবর্তন দেখতে, যার মধ্যে মেধা ও পরিপকস্ফতার ছাপ থাকবে। আন্দোলন মানেই রাজপথভিত্তিক উত্তাপ নয়, সেটা তো সংসদের পরিসরেও হতে পারে। বিএনপির মধ্যে বেশকিছু প্রতিশ্রুতিশীল পার্লামেন্টারিয়ান আছেন, যাদের বুদ্ধিমত্তার উপস্থাপনা জাতি দেখতে চায়। গণতন্ত্র কিন্তু সবসময়ই সংখ্যাতত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল নয়। শানিত বুদ্ধি, যুক্তি ও বাগ্মিতা অনেক সময় একটি দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তেমন কিছু পার্লামেন্টারিয়ান পাকিস্তান আমলে রাওয়ালপিন্ডিতেও সংসদের ফ্লোর কাঁপাত। আমরা আমাদের সংসদে সেসব উত্তপ্ত বিতর্কের ট্র্যাডিশন ফিরিয়ে আনতে পারি না কেন? আমরা সবসময়ই সংসদে শুধু স্তুতি, বন্দনা ও স্তাবকতাই দেখব?
আমরা প্রায় ভুলে যেতে বসেছি যে, প্রয়াত শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার ব্যক্তিত্ব ও কৌশলে সামান্য কয়েকজন সদস্যের সমন্বয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের আসন দখল করেছিলেন। যে কোনো দলের জন্য সদস্য সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু গুণগতভাবে উন্নত একটি সরকার গঠনে গুণী এবং যোগ্য সাংসদ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বোঝা যায়, বিএনপি এখন মার্কটাইম করে নির্বাচন নিকটবর্তী হলে তুরুপের তাসটি ছাড়তে চায়_ আন্দোলন বা নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে চায়। ইতিমধ্যে যদি দলটি সংসদের সঙ্গে খানিকটা সংশ্লিষ্ট হয়, তা হবে বাড়তি অর্জন।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ
সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.