চারদিক-একটি দরিদ্র ছবি by নেয়ামত উল্যাহ

আবদুল বারেক মাঝি ৪০ বছর মহাজনি গয়না নৌকা টেনেছেন দাঁড় বেয়ে। কখনো পাট, কখনো ধান-সুপারি। ভুসা মালভর্তি গয়না নিয়ে ভোলার মনপুরা হাজিরহাট ঘাট থেকে গেছেন হাতিয়া-সন্দ্বীপ, চরফ্যাশন, তজুমদ্দিন। কখনো ভোলা জেলার বাইরে।


মেঘনা, ইলিশা, তেঁতুলিয়া, কালাবদর, বুড়ি গৌরাঙ্গ, কীর্তনখোলা, বিষখালী—কত নদী চেনা তাঁর! চেনা ছিল চাঁদপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠি নদীবন্দর। সেসব বন্দরের হাটে যেতেন আড়তদারের মালামাল নিয়ে। আসার সময় আনতেন মুদি মালামাল। তখন এসব নদীর চেহারা ছিল আরও ভয়ংকর। উথালপাথাল ঢেউ। জীবনে অনেক তুফানের মধ্যে পড়েছেন কিন্তু নৌকা ডোবেনি। জলদস্যুর কবলেও পড়েছেন। তবে সব বিপদকে পরাজিত করে হয়েছেন গাজি। আবদুল বারেক মাঝি বলেন, ‘বারেক মাঝির এট্টা নামডাক আছিল। দিনো দিনো সোত্তুরডা বছর পাড় কইরল্লাম, সব মুসকিল আসান কইরছে আল্লা পাক, কিন্তুক সংসারের ঘানিডা ঠিকই টাইনতে আছি। মরোন ছাড়া এই ঘানি টানা শ্যাষ অইতো নো।’
কথাগুলো বলেন আর হাঁপান। কষ্টে ভরা এমন জীবনযাপনের কথা কাউকে বলতেও পারেন না। প্রতিবেশীরাই বুঝে মাঝেমধ্যে সাহায্য করে। কিন্তু প্রতিবেশীরাও বারেক মাঝির মতো কপালপোড়া অভাবী।
আবদুল বারেক মাঝির সঙ্গে আমার পরিচয় মনপুরা হাজিরহাট বাজারে। এটাই উপজেলা শহর। বন্ধু আমির হোসেন হাওলাদারকে দেখি সত্তরোর্ধ্ব আবদুল বারেক মাঝিকে সঙ্গে নিয়ে টাকা তুলছেন। বয়স ও অসুখ বৃদ্ধকে কুঁজো করে লাঠি ধরিয়েছে। পরিধানে ছেঁড়া ও ময়লা পোশাক। কেন সাহায্য দরকার? বারেক মাঝির স্ত্রী বৃদ্ধা মাফিয়া খাতুন (৬০) বাঁধের ঢাল থেকে নামতে গিয়ে বাঁ হাত ভেঙে ফেলেছেন। এখন পর্যন্ত চিকিৎসা হয়নি। রাতে ব্যথায় কাতর হয়ে চেঁচামেচি করেন। মনপুরা হাসপাতালে চিকিৎসক-সংকট। হাড় ভাঙার চিকিৎসার জন্য ভোলা যেতে হবে। কিন্তু টাকা নেই।
আমির হাওলাদার ও তাঁর বন্ধুরা সাহায্য উঠিয়ে এ পর্যন্ত অনেক মেয়ের বিয়ে এবং অনেকের চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন কেউ বড় ধরনের বিপদে পড়লে ওঁদের কাছে যায়। বারেক মাঝি স্ত্রীর রাতভর কষ্ট-বেদনা সহ্য করতে না পেরে আমিরের কাছে এসেছেন। সবার সাহায্যে এক হাজার ৮০০ টাকা উঠেছে। ওই টাকা নিয়েই ভোলা যাবেন চিকিৎসা করাতে। এসব নিয়ে কথাবার্তার এক সময় আমির হালদার ও মাহবুবুল হক আমাকে বললেন, ‘বৃদ্ধ বারেক মাঝিকে নিয়ে কিছু লিখুন।’
বারেক মাঝির ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। ক্রমানুসারে মেয়েদের নাম রিজিয়া, ফাতেমা, কুলসুম, রানু, আনোয়ারা ও অজিফা। একটি ছেলে ছিল। সেও মাঝি। কিন্তু ২০ বছর ধরে নিখোঁজ। বারেক মাঝি বলেন, ‘হুত (পুত্র) কি আর বাঁচি আছে, থাইকলে তো আইতোই।’ মেয়ে আর মেয়েজামাইয়েরা তাঁর বাড়িতে বেড়াতে আসে না। তবে তাদের বাড়িতে গেলে বাবাকে তারা আদর-যত্ন করে। কিন্তু অভাবের কারণে পথখরচা দিয়ে যেতে পারে না। মেয়েরা যে খরচ দিয়ে নেবে এমন সামর্থ্যও নেই। আবদুল বারেক বলেন, ‘মাইয়্যার বাড়ি খালি আতে ক্যামনে যাই। হ্যারপরে পথখরচ বাইর‌্যা গেছে।’
আবদুল বারেক মাঝি জানান, একসময় তাঁদের এমন অভাব ছিল না। তাঁরও চাষের জমি, গোয়ালে গরু ছিল। কিন্তু পৈতৃক বাড়ি মেঘনায় খেয়ে ফেলার পর থেকে যেখানেই বাড়ি করেছেন, সেখানেই নদী হামলে পড়ে সব নিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত পাঁচবার ভেঙে পথের পাশে বসিয়েছে।
কেমন করে সংসার চলে? জানা গেল, ঘরে দুজন বৃদ্ধ থাকলেও আবদুল বারেক একাই বয়স্কভাতা পান। তাও তিন মাস পরে ৯০০ টাকা। মাঝেমধ্যে অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতা করেন ইউপি সদস্যরা। খেয়ে না-খেয়ে চলে রাতদিন। আবদুল বারেকের সহজ উত্তর, ‘পাইলে খাই, না পাইলে না খাইয়্যা থাহি। দিন শ্যাষ, মাওলার ডাকেরমিল চাইয়্যা রইছি। কিন্তুক হেতির (স্ত্রী) ডাক-চিৎকার সইয্যো অয় না।’ বারেক মাঝি নিজেও অসুস্থ। বাতের ব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। তবুও নিজের ব্যথাযুক্ত শরীর আর নিজের অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে দিন পার করা।
যেদিন আবদুল বারেক মাঝির ঘর-সংসার দেখতে যাই, সে দিনটি ছিল আশ্বিনের শুরুর দিকে। এ সময় হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হয়। এবং সড়কের এ পাশে বৃষ্টি হয়, ওপাশে শুকনো রোদ্দুর। মেঘফাটা রোদ্দুর বড্ড কড়া। চামড়ায় ছ্যাঁকা লেগে যায়। মনপুরা হাজিরহাট বাজার থেকে যখন মোটরসাইকেলে বের হচ্ছি, তখন রোদ্দুর আর পাকা ছেড়ে কাঁচা সড়কে যেতেই ঝুম ঝুম বৃষ্টি। এ সড়কে রাতেও বৃষ্টি হয়েছে। দুই পাশে গাছ। রাস্তায় কাদা-পানিও বেশ। তার মধ্য দিয়ে মোটরসাইকেল চলছে। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে বারেক মাঝির ঘরটা পেয়েছি। বাঁধের ঢালে একটি ঘর। কিন্তু ঘর কই? কবি জসীমউদ্দীন লিখেছেন, ‘ভেন্না পাতার ছানি’। কিন্তু এটা কিসের ছানি? এক পাশে খরকুটো, টিনের টুকরো, অন্য পাশে ছেঁড়া পলিথিন, নাকি অন্য কিছু। ঘর নয়, যেন পাখির বাসা। খড়ের গাদার ভেতরে বসবাস। খাট-চকি কিছু নেই। স্যাঁতসেঁতে। ভেজা। কুঁজো হয়ে ঢুকতে হয়। আবদুল বারেক মাঝি চোখের পানি ফেলে বলেন, ‘অনেকের সামর্থ্য আছে হেইতেরাও পায় মাসে ৩০০ টিয়া (টাকা), আমগো ভিক্ষা করার সামর্থ্যও নাই, আমগোরে সরকার এট্টু বেশি টিয়া দিলে হয়তো ভালা চলত। নাইলে কোনো আশ্রমে ঠাঁই পাইলেও অইত।’

No comments

Powered by Blogger.