ধর্ম-শান্তি বিনির্মাণে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইহকালীন জীবনে মানবজাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য বিভিন্ন ধর্মে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ধর্ম মানুষকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, জীবনের নিরাপত্তা, সম্মান ও মর্যাদা সহকারে সমাজের সবার সঙ্গে মিলেমিশে শান্তি বিনির্মাণের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। জন্মগতভাবে বিশ্বের সব মানুষ রক্তসম্পর্কীয় গভীর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ।


কারণ তারা সবাই মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। এ কারণেই বিশ্বের সব মানুষ পরস্পর ভাই ভাই। একই পিতা-মাতা থেকে জন্মগ্রহণ করে বংশপরম্পরায় মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। অনন্তর পৃথিবীতে মানবসন্তানের বংশ বৃদ্ধির ফলে তারা বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হয়ে যায়। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে একজন নর ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর আমি তোমাদেরকে অনেক সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
ধর্মের সব বিধিবিধান ও আচার-অনুষ্ঠান শান্তি বিনির্মাণ, মানবকল্যাণ এবং মানুষকে সত্য-সুন্দর ও সুখ-শান্তির দিগ্দর্শন প্রদানে নিয়োজিত। পৃথিবীর সব কটি প্রধান ধর্মের প্রচারকেরা মহান সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত মহামানব হয়েও সদা মানবকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। ধর্মগ্রন্থগুলো হলো ধর্মীয় মূল্যবোধ তথা নির্দেশিকাগুলোর লিখিত বা সংকলিত রূপ। পবিত্র কোরআনের একাধিক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘আমরা প্রত্যেক গোত্রের কাছে সময়ে সময়ে পথ প্রদর্শকরূপে আমাদের মনোনীত ব্যক্তিকে পাঠিয়েছি, আর তাঁদের সহায়তা হিসেবে পাঠিয়েছি ঐশী বাণী।’ এ বাণী ওই সব নবি বা রাসুল যে সম্প্রদায়ের ছিলেন, তাঁদের সমসাময়িক সমস্যাকে কেন্দ্র বা উপলক্ষ করে তাঁদেরই ভাষায় প্রেরিত হয়। এ ঐশী বাণী গ্রন্থগুলোর অনুসরণে কিংবা যুগ-যুগান্তের অভিজ্ঞতার আলোকেও মানুষ নিজেও ধর্মীয় বিধানাবলি প্রণয়ন করেছে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত-৪)
ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি স্বীকৃত ও বিরাজমান থাকায় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা পারস্পরিক ভাববিনিময়, আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, কৃষ্টি-সভ্যতা, সংস্কৃতি প্রভৃতির চর্চা করতে পারে। এতে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের মাঝে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সংহতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আন্তধর্মীয় সংলাপের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হয়। একজন ধর্মভীরু লোক যখন অপর ধর্মের মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারবেন, তখন তাঁর মধ্যে ধর্মের উদার দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম নিতে পারে। এমনিভাবে বিভিন্ন ধর্মের মূল সুর বিশ্বশান্তি, ঐক্য, সম্প্রীতি, সহনশীলতা, মানবতাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, ন্যায়-নীতি, ক্ষমা, উদারতা, মহানুভবতা প্রভৃতি মানবজীবনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গুণাবলি বাস্তবজীবনে প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সুনিশ্চিত হতে পারে; যেভাবে বাংলাদেশে মুসলমান-খ্রিষ্টান-হিন্দু-বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে আন্তধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ন্যায়বিচার, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তধর্মীয় সংলাপের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণভাবে অন্য ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক রীতি-নীতি ও শিক্ষামূলক বিষয়াদির জ্ঞান লাভের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
মানুষের মধ্যে যেসব গুণাবলি থাকলে মানুষকে মানুষ বলা যায় এবং না থাকলে আর মানুষ বলা যায় না, সে সমস্ত গুণই মানুষের ধর্ম। ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’, ‘মানুষ সকল জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’ বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মানুষ-মানুষের সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই সব আইন, সব উত্তরণ ও উন্নয়ন, সব আনন্দ, সব সর্বনাশ। সমাজজীবনে মানুষ বিভিন্ন উপায়ে ও উপলক্ষে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। সম্প্রীতির ধর্ম ইসলাম মানবজাতির পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। সমাজজীবনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হলে সমাজের সব ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। দৈনন্দিন জীবনে আয়-উপার্জন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর কাফন-দাফন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি প্রভৃতি মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভর করে।
ইসলামের ন্যায়বিচার কোনো দেশ-কাল-জাতি বা মানুষ তথা মুসলিম-অমুসলিম ভেদে পক্ষপাতিত্ব করে না। ইসলাম গোত্রে-গোত্রে, মানুষে-মানুষে বর্ণবৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই অসংখ্য মানুষ বর্ণবাদ বা জাতিগত সমস্যায় অবিচার ও নিষ্ঠুরতার কারণে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। অথচ বিভিন্ন বর্ণ ও জাতি সৃষ্টির পেছনে উদ্দেশ্য হলো, যেন ধর্মপ্রাণ মানুষ একে অন্যকে জানতে পারে। মোটকথা, ইসলামের দৃষ্টিতে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী অমুসলিম নাগরিকদের ওপর কোনো জোর-জুলুম চলবে না এবং তাদের জীবন, সম্পদ, মানসম্মান, মানবিক অধিকার, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রতিটি ব্যাপারে অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে। প্রকৃত ধর্ম মাত্রেরই মূল লক্ষ্য, মানুষকে সত্য-সুন্দর-কল্যাণ ও ন্যায়নীতির পথপ্রদর্শন। ইসলামও মুলমানদের এ লক্ষ্যেই অগ্রসর হওয়ার তাগিদ দিয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুনির্দিষ্ট বিধান দিয়েছে ইসলাম।
পৃথিবীর সব দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করে। তাদের ধর্মবিশ্বাসে, আচার-আচরণ ও রীতি-নীতিতে পার্থক্য রয়েছে। এহেন বৈপরীত্যের জন্য তাদের মধ্যে পরস্পরকে ভালোভাবে জানতে পারে না সবাই। তাই বিশ্বব্যাপী শান্তি বিনির্মাণ, বিভিন্ন দ্বন্দ্ব নিরসন এবং আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আন্তধর্মীয় সংলাপ একান্ত প্রয়োজন। মানবজীবনের নানা সমস্যা সমাধানের জন্যই যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে। মানুষের জীবনযাপনে একটা নীতিশৃঙ্খলা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রেরণা থেকেই ধর্ম। সুতরাং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা মুখ্য। মানুষ ধর্মের জন্য নয়, ধর্মই মানুষের জন্য। দুনিয়ায় আগে মানুষ এসেছে, পরে তাদের যুগ-যুগান্তরের প্রয়োজনে নির্দেশিকা হিসেবে এসেছে বিভিন্ন ধর্মীয় মূল্যবোধ। সুতরাং ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ইহলৌকিক কল্যাণ তথা শান্তি বিনির্মাণ এবং আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হতে পারে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.