ফেরত পাঠানো হলো আরো ৪৭ রোহিঙ্গাকে

টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে গতকাল শুক্রবার মিয়ানমারের আরো ৪৭ নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছেন বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে ৭৩১ জন অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানো হলো। এদিকে অনুপ্রবেশের চেষ্টা কমে আসার পাশাপাশি মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসার খবর পাওয়া গেছে।


গতকাল সেখানকার গ্রাম এলাকার মসজিদগুলোতে জুমার নামাজও আদায় করা হয়।
১৫ জুন শুক্রবার সকালে সেন্টমার্টিন কোস্টগার্ড ৪৭ মিয়ানমার অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠায়।
মিয়ানমারের আকিয়াবের ৪৩ রোহিঙ্গা ট্রলার নষ্ট হওয়ার কারণে বুধবার থেকে সেন্টমার্টিনে কোস্টগার্ড সদস্যদের প্রহরায় ছিল। দুই দিন চেষ্টা করেও ট্রলারটি সচল করা যায়নি। এর পর শুক্রবার টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ থেকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) আটক চার অনুপ্রবেশকারীসহ একটি ট্রলারে সেন্টমার্টিনে পাঠায়। ট্রলারটিতে করে সেন্টমার্টিনের ৪৩ জনসহ মোট ৪৭ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোস্টগার্ড কর্মকর্তা লে. কমান্ডার জসিমুজ্জামান।
এদিকে ৪২ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহিদ হাসান জানান, শাহপরীর দ্বীপে আরো ১৩ মিয়ানমার নাগরিক বিজিবি হেফাজতে রয়েছে। তাদের শুক্রবারের মধ্যেই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। এই ১৩ অনুপ্রবেশকারীকে বৃহস্পতিবার রাতে শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে বিজিবি। এরা বৃহস্পতিবার সকালে অনুপ্রবেশ করে বলে জানা যায়।
লে. কর্নেল জাহিদ হাসান কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, শান্ত হয়ে আসছে মিয়ানমারের সহিংস পরিস্থিতি। মিয়ানমার মংডু জেলার মুসলমানরা তাদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে। মংডু টাউনশিপে কিছু কিছু দোকানপাট খুলেছে। তিনি আরো জানান, গত শুক্রবার থেকে মিয়ানমারে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বিজিবি ও কোস্টগার্ড ৭৩১ মিয়ানমার নাগরিককে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। শাহপরীর দ্বীপে বিজিবির হেফাজতে থাকা ১৩ রোহিঙ্গাকে পর্যাপ্ত খাবার ও পানি দেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান। টেকনাফ সীমান্তে পরিবেশ শান্ত এবং নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জানিয়ে লে. কর্নেল জাহিদ হাসান বলেন, বিজিবি তাদের টহল জোরদারের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় মনখালীতে নতুন চেকপোস্ট বসিয়েছে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, দুই দিন দ্বীপে রাখার পর যে অনুপ্রবেশকারীদের গতকাল ফেরত পাঠানো হয় তাদের ভালো খাবার দেওয়া হয়েছে। এমনকি গতকাল তাদের নৌকায় তুলে দেওয়ার সময়ও শুকনো খাবার দেওয়া হয়। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, 'রোহিঙ্গাদের আমরা অনুপ্রবেশে বাধা দিচ্ছি এটা ঠিক, তবে তাদের দিকে সহায়তার হাতও বাড়াচ্ছি। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার যেমনি করা হচ্ছে, তেমনি প্রয়োজনীয় খাবারদাবার দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।'
জেলা প্রশাসক জানান, টেকনাফ উপকূলে তিন দিন ধরে প্রবল বর্ষণ অব্যাহত থাকায় সীমান্তের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আরাকানের পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় এবং সম্ভবত বর্ষণজনিত কারণে গতকাল সীমান্তে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ চেষ্টার ঘটনাও ঘটেনি।
এর আগে বৃহস্পতিবার টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে বিজিবি সদস্যরা অনুপ্রবেশের চেষ্টারত রোহিঙ্গাদের সহায়-সম্বল ডাকাতির অভিযোগে শাহপরীর চার বাসিন্দাকে আটক করে টেকনাফ থানায় সোপর্দ করে। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুল হক গতকাল জানান, আটককৃতদের শুক্রবার সকালে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক : গতকাল বিকেলে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের ফকিরা বাজার, সাহেব বাজার, বলি বাজার, ঢেকিবনিয়া, মংডুসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে, জরুরি আইন বলবৎ থাকায় দুজনের অধিক জনসমাগম নিষিদ্ধ। তাই শহরের বড় মসজিদগুলোতে জুমার জামায়াত হয়নি। তবে গ্রাম এলাকায় কয়েক হাজার মসজিদে যথারীতি জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগের শুক্রবারে জুমার নামাজের সময় সহিংসতায় বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানি ঘটে বলে জানা যায়।
গতকাল উখিয়ার পালংখালী ও বালুখালীর সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাংলাদেশ প্রান্তে লোকজন স্বাভাবিকভাবে নদীতে ও মাঠে দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজ করছে। এ সময় কয়েকজন গ্রামবাসী জানায়, সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। বালুখালী বিজিবি বিওপি কমান্ডার সুবেদার মোজাম্মেল বলেন, কিছু মহল দুই দেশের সীমান্ত পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করলেও এবার স্থানীয় জনসাধারণ ও সরকারের প্রশাসনের কঠোরতায় মিয়ানমার থেকে অধিক সংখ্যক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ টেকানো সম্ভব হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সতর্ক রয়েছে।
এদিকে সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সীমান্তের পয়েন্ট দিয়ে অবৈধভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি। বিজিবি ও গ্রামবাসী আগের মতো সীমান্ত এলাকায় কড়া সতর্কতায় পাহারা দিয়ে যাচ্ছে।
নিরাপত্তা জোরদার : অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য নিরাপত্তা শক্তি বাড়াতে আশপাশের জেলাগুলো থেকে কক্সবাজারে পুলিশ সদস্য তলব করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় বান্দরবান থেকেও পুলিশ সদস্য তলব করা হয়েছে। প্রথম দফায় ৫০ সদস্যের একটি পুলিশ দল শুক্রবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের এপারে ঘুনধুম-টেকনাফ পয়েন্টে বিজিবি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বান্দরবানের পুলিশ সুপার কামরুল আহসান এ তথ্য স্বীকার করে জানান, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কক্সবাজারে পুলিশ জওয়ান পাঠানো হচ্ছে।
দুই প্রান্তেই এখনো আটকা : সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় বৈধ পথে বাংলাদেশে আসা ২৭১ মিয়ানমার নাগরিকের মধ্যে ২৫৯ জন এখনো ফেরত যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমারে থাকা ৫৫ বাংলাদেশির মধ্যে ৪৯ জন ফিরে এলেও এখন পর্যন্ত সেখানে রয়ে গেছে ছয়জন। টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী ইউনাইটেড ল্যান্ডপোর্টের জিএম আবদুল মোহাইমেন জানিয়েছেন, সহিংসতার পর থেকে মিয়ানমার থেকে পণ্যবাহী কোনো জাহাজ টেকনাফ স্থলবন্দরে পৌঁছেনি। আগে আসা ট্রলারগুলো পণ্য খালাস করে বর্তমানে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া ইমিগ্রেশন ও ট্রানজিট যাতায়াত এখনো বন্ধ রয়েছে।
কক্সবাজার অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক, বান্দরবান এবং উখিয়া ও টেকনাফ প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.