চারদিক-ছাদের মানুষ ও আমরা by তুহিন ওয়াদুদ

রংপুরের মডার্ন মোড়। আশ্বিন-কার্তিক মাস অথবা চৈত্র-বৈশাখ মাস। মোড়ে দাঁড়ালে চোখে পড়বে বাসের ছাদে অসংখ্য মানুষ। ছাদে মানুষ ওঠার চিত্র আমাদের বেশ পরিচিত। বিশেষ করে মুসলমানদের দুই ধর্মীয় উৎসবে ট্রেনের মধ্যেও এই বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়।


কিন্তু রংপুরের মডার্ন মোড়ে দাঁড়ালে বাসের ছাদে যে মানুষগুলো থাকেন, তাঁদের বাস্তবতা যেকোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষকে আহত করার মতো। বাসের ভেতর ছিট খালি থাকা সত্ত্বেও মানুষগুলো বাসের ছাদের ওপর বসে যান। শুধু যে বাসের ছাদে বসে যান তা নয়, পিকআপ ভ্যান, ট্রাক—সবকিছুরই ওপর উঠে যাচ্ছে একদল যাত্রী। এই যাত্রীদলের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁদের চোখ-মুখে হতাশার বলিরেখা স্পষ্টতই বোঝা যায়। পোশাকে অর্থকষ্টের ছাপ। অধিকাংশই লুঙ্গি ও শার্ট পরা; পোশাকস্বল্পতার কারণে হয়তো পরিষ্কার করতে হয় অনেক দিন পর। আচরণে নিরীহ। বাসে ওঠার সময় এমন আচরণ করেন যেন তাঁরা বাসের কন্ডাক্টরের করুণায় বাসের ছাদে একটুখানি স্থান পেয়েছেন। বাসের ভেতর যতজনের স্থানসংকুলান হয়, তার চেয়েও অনেক বেশি যাত্রী উঠছেন ছাদের ওপর। বাসের পেছনে সিঁড়ি আছে এসব যাত্রীর ছাদে ওঠার জন্য। কখনো কখনো তাঁদের রশি দিয়ে বেঁধে নেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়। সবার কাঁধে একটি করে জীর্ণ ব্যাগ কিংবা ঝোলা। হাতে বাঁশের তৈরি এক ধরনের লাঠি, যার দুই দিকে ধান বেঁধে বহন করা যায়। কাস্তেও আছে সঙ্গে। বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তানদের ছেড়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে গিয়ে কাজ খুঁজে নিতে হবে এই দুশ্চিন্তার ভারেও তাঁরা ভারাক্রান্ত। বাড়ি তাঁদের বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে। যাঁরা বাসের ছাদে বসে যাচ্ছেন, তাঁদেরকে অনেকে মফিজ অভিধা দিয়েছে। মফিজ বলে তাঁদের হেয় করায় কোনো কমতি নেই। কিন্তু মফিজ-জীবন থেকে তাঁদের বের করে নেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা নেই। ছাদের এই মানুষগুলোর জন্য কোনো সময়ই উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা কোনো সরকারকে নিতে দেখা যায়নি। বছরে দুই দফায় চারটি মাসই কেন এত মানুষকে বাসের ছাদে কিংবা ট্রাকে দেখা যায় তা নিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের কোনো কিছু করার আছে কি না তাও ভেবে দেখেনি বাংলাদেশের কোনো সরকার। রংপুরে যে মঙ্গার প্রচলন, তাও এই চার মাসে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি রংপুরে। এখানে শ্রম বিক্রি হয় মূলত কৃষিকাজকে কেন্দ্র করে। বছরে আশ্বিন-কার্তিক মাস এবং চৈত্র-বৈশাখ মাসে কোনো কৃষিকাজ থাকে না বলে তাঁদের বেকার জীবন কাটাতে হয়। এই সময়গুলোতে রংপুর অঞ্চলের চেয়ে মাস খানেক আগেই ধান ঘরে ওঠে বগুড়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল কিংবা কুমিল্লায়। ধান কাটার জন্য রংপুর অঞ্চলের দিনমজুরেরা ছুটে যান ওই অঞ্চলগুলোতে। তাঁদের যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া সব মিলিয়ে যে সামান্য অর্থ উপার্জন হয়, তাতে তাঁদের বাসের ভেতরে যাওয়া-আসার মতো টাকা থাকে না। তাই যত স্বল্পব্যয়ে তাঁদের যাওয়া-আসা সম্ভব হয়, তাঁরা সেই ব্যবস্থাই মেনে নেয়।
বাসের ছাদে মানুষের ওঠা আইনসিদ্ধ নয়। তারপরও আইন প্রয়োগকারীরা তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। অথবা তাঁদের প্রতি করুণা প্রদর্শিত হয়। বাসগুলো ক্ষমতার অধিক যাত্রী বহন করে বড় বড় দুর্ঘটনার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে প্রচুর থাকলেও ছাদের মানুষগুলোর জন্য কেউ কখনো কোনো আইন প্রয়োগ করেন না।
রংপুর অঞ্চল মঙ্গার এলাকা বলে পরিচিতি অর্জন করেছে। এক অর্থে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল এই দেশ বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে অনেক। সম্পদের সুষম বণ্টন না হওয়ার কারণে এবং সামগ্রিক অর্থনীতির সুষ্ঠু বিকাশ এখানে হয়নি। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশটাই তো মঙ্গার দেশ! লালমণিরহাট, কুড়িগ্রাম অঞ্চলের চরাঞ্চলের যে জীবন, ফরিদপুর কিংবা বরিশালের চরাঞ্চলের সেই জীবন। সেটা বিবেচনায় দেশের অনেক অঞ্চলে সমান অভাবের দৃশ্য দেখা গেলেও রংপুর অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ পশ্চাৎপদ। এ কথা ঠিক যে আগের মতো মানুষ আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় থাকে না। তাই বলে যে রংপুর অঞ্চলের মানুষের পশ্চাৎপদতা দূর হয়েছে, তাও নয়।
রংপুরের মানুষ নৃতাত্ত্বিকভাবেই অলসপ্রবণ। সেই সঙ্গে রংপুরে কোনো শিল্পায়ন না হওয়ার কারণে শ্রমের মূল্য থাকে অনেক কম। বিভিন্ন সময়ে যে পদ্ধতিতে সরকার পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা করেছে, তা তাদের ক্ষতির কারণ বলেই বিবেচিত। একসময় অনেক রিলিফ দেওয়া হয়েছে। এই রিলিফ প্রথা চালু না করে যদি তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেত, তাতে করে তারা স্বাবলম্বী হতে পারত। অনেক সময়ই দেখা গেছে দুই কেজি চাল রিলিফে পাওয়ার আশায় সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়েছিল একেকজন যুবক। হয়তো তারা ওই সময়ে শ্রম দিয়ে চার কেজি চাল উপার্জন করতে পারত। তারা তা না করে রিলিফের অপেক্ষা করত। মহাজোট সরকার দেশে যে ব্যাপক হারে বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য ন্যাশনাল সার্ভিসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা শুরুতেই কুড়িগ্রামে বাস্তবায়ন করে। ন্যাশনাল সার্ভিস হচ্ছে রিলিফের অন্য আঙ্গিক। ন্যাশনাল সার্ভিসের মাধ্যমে অনেক সম্ভাবনাময় যুবকের অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। দুই বছর মেয়াদি তাঁদের বেকারত্ব দূরীকরণে যে পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেছে, তাতে করে বেকার যুবকদের আরও স্থায়ীভাবে বেকার হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তাঁদের প্রায় ১০টি শাখায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদের অতিরিক্ত হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাঁদের শ্রম কাজে লাগানোর যে চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে তাঁদের এই দুই বছরের অভিজ্ঞতা তেমন কোনো কাজে আসবে না।
২ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ‘পত্রপত্রিকায়, টক শোতে দেশের এক চিত্র আর গ্রামে অন্য চিত্র’ উল্লেখ করে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। যে সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দিচ্ছেলেন, সেই সময়ও কুড়িগ্রাম লালমণিরহাটের অসংখ্য দিনমজুর নিশ্চয়ই বাসের ছাদে করে কাজের সন্ধানে দূরবর্তী কোনো জেলায় যাচ্ছিলেন কিংবা বাসের ছাদে জীবন বাজি রেখে বাড়ি ফিরছিলেন। রংপুর অঞ্চলের মানুষগুলো বছরে চার মাসে প্রচুর পরিমাণে বাসের ছাদে ওঠা বন্ধকরণকল্পে তাঁদের স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বাস, ট্রাক, পিকআপ ভ্যানসহ অন্য যত যানবাহনে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাদে ওঠে, তাও বন্ধ করার জন্য আইন প্রয়োগকারীদের আরও সচেষ্ট হতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ

No comments

Powered by Blogger.