আত্মশক্তির জোরে ঘুরে দাঁড়াতে হবে by লুৎফর রহমান রনো

স্মরণকালের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে গেল জাপানে কিছুদিন আগে। প্রচণ্ড ভূমিকম্পে ধসে গেল সহস্র ঘরবাড়ি, তারপর সুনামির প্রলয়ে ভেসে গেল উপকূলীয় শহরের বাড়ি-গাড়ি_মানববসতি নিশ্চিহ্ন হলো প্রায়। তাতেও থেমে থাকল না। বিস্ফোরণ ঘটল পারমাণবিক চুলি্লগুলোতে। জাপান বলে কথা।


তাই 'অপূরণীয় ক্ষতি' বলা যাচ্ছে না, শিগগিরই এ জাতি তাদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি, অর্থ-সামর্থ্য ও প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে ওপর ঘুরে দাঁড়াবে আরো শক্তিশালী হয়ে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মজবুত করে গড়ে তুলবে ভবিষ্যতের মিনার। জাপান পৃথিবীর অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তির দেশ। তাই জাপানের জাতীয় অর্থনীতির ওপর আকস্মিক এই ধাক্কা পৃথিবীর পুরো অর্থনীতির গতিবিধিকে প্রভাবিত না করে ছাড়ছে না।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ন্যক্কারজনক ইরাক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি সম্ভবত ঘটাতে যাচ্ছে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে। লিবিয়ার ঘটনা থেকে বিশ্ববাসীর সচেতন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চীন ও রাশিয়া ভেটো দেয়নি। সমর্থন না দিয়ে চুপ থাকার অর্থ পৃথিবীতে এখন একক পরাশক্তির আধিপত্য অপ্রতিরোধ্য। একের পর এক এই পরাশক্তি ও তার মিত্র দেশগুলো একেকটি দেশের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সে কি শুধু তেলের লড়াই! নাকি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের থাবা এমনই বেপরোয়া হয়ে উঠছে দিনকে দিন যে ভবিষ্যতে কোনো রাষ্ট্রই রক্ষা পাবে না, যদি তাদের সঙ্গে আপস করে না চলে কেউ। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া প্রভৃতি দেশের ওপর হামলা চালাচ্ছে নিরীহ নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য? যদি তা-ই হয়ে থাকে তবে ৫০ বছরেও একটিবার ফিলিস্তিনিদের জন্য ইসরায়েলকে একটি ধমক পর্যন্ত দিতে দেখা যায়নি কেন?
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নগ্ন হস্তক্ষেপ আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেকের বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট ধমক। বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এর প্রতিবাদ করলেও সুবিধাবাদী ও মৌলবাদী ছোট-বড় কোনো রাজনৈতিক দল তা গায়ে মাখেনি। এটা আমাদের রাজনৈতিক চরিত্রের সবচেয়ে ঘৃণ্য বিষয়। যারা ক্ষমতায় নেই, তারা ক্ষমতাসীন দলের ওপর দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিও যদি কোনো হুমকি আসে তাহলেও নীরবে তামাশা দেখে। কারণ এখানে রাজনীতি দেশের মানুষের জন্য নয়। তারা রাজনীতি করে জনগণের মুখের গ্রাস আত্মসাৎ ও দেশমাতৃকাকে অন্যের কাছে বিক্রি করে হলেও ধন-দৌলত সঞ্চয় করতে। ড. ইউনূস একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও শিল্পপতি। তাঁর ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক আছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে। তাঁর এই সম্পর্কের বদৌলতে বাংলাদেশের মানুষের কোনো উপকার কখনো হয়নি। তাঁর নিজের ও নিজের প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে। এটা দেশের মানুষ জানে, বোঝে। তাই তাঁর পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত কোনো জনসমর্থন নেই। যাঁরা তাঁর পেছনে রয়েছেন তাঁদের বিরাট ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে নিঃসন্দেহে। কিছুসংখ্যক 'বুদ্ধিজীবী' কোমর বেঁধে ড. ইউনূসের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। অথচ নোবেল বিজয়ীর পক্ষে খোদ আমেরিকা রয়েছে। কিন্তু দরিদ্র দেশের দীনহীন জনতার পক্ষে কে আছে? কী অদ্ভুত আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা, তাদের বিবেকের কী ভয়ানক বিকৃতি!
আমাদের দেশের সার্বিক অবস্থা এ সময় খুব ভালো যাচ্ছে না। আমাদের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী জাপানের বিপর্যয়, মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি রপ্তানিতে ভাটা, রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে আসা_এ সবই আমাদের উদ্বেগের কারণ। এ সময় ড. ইউনূস নিয়ে আমেরিকার হুমকি হজম করা ছাড়া যদি কোনো উপায় আমরা খুঁজে পেতে পারি, তবেই মাথা উঁচু করে এ জাতি একদিন দাঁড়াবে। আর যদি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আমাদের উন্নয়ন নির্ভরশীলতা আগেরই মতো থাকে, তাহলে ড. ইউনূসের সঙ্গে আপস করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অন্তত একটিবার যদি নিজেদের মেরুদণ্ডের ওপর আস্থা রেখে মার্কিনি ধমকের মোকাবিলা করা যায়, তবে লক্ষ্যপথ খুঁজে পেতে আর বেশি সময় লাগবে না। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা যদি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে পারেন একটি বিষয়ে, তা হলো দুর্নীতি চলবে না, কোনো তহবিল আত্মসাৎ হবে না। আমাদের যা আছে তা-ই নিয়ে আমরা ঘাম ও শ্রমের মধ্য দিয়ে দেশের ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করব। এমন অঙ্গীকারই একমাত্র উদ্ধারের পথ। তা করতে না পারলে এমনি সাদা 'ব্লেক'রা হুমকি-ধমকি দেবে। ব্যক্তিস্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এজেন্টদের মর্জি মোতাবেক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালিত হবে! এই অশুভ আবর্তন থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। জানি, এ কথা লিখতে যত সহজে বাক্য তৈরি হয়ে গেছে, তা বাস্তবায়ন তেমন নয়, এ দেশে দুরূহ, তবে অসম্ভব নয়। যদি দেশপ্রেমিক কোনো নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে তবেই কেবল তা সম্ভব হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.